X
বৃহস্পতিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩
২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩০

নারী ফুটবলারদের প্রতি আমাদের অনৈতিক ‘সংবেদনশীলতা’

ডা. জাহেদ উর রহমান
২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৮:১৫আপডেট : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৮:১৫

বাংলাদেশের নারী ফুটবল দলের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ট্রফি জয় করা নিয়ে ফেসবুকে যা যা হলো সেটা প্রত্যাশিতই ছিল। বিশেষ করে ‘হাফপ্যান্ট’ পরে মেয়েদের ফুটবল খেলা নিয়ে দুটো পক্ষ পরস্পরের বিরুদ্ধে নানা কথা বলে ঝাঁপিয়ে পড়বে, এটা নিশ্চয়ই পুরোপুরি অনুমানযোগ্যই ছিল।

সমাজে ঘটা প্রতিটি ঘটনা সেই সমাজকে চিনতে আমাদের সাহায্য করে। নারীদের ফুটবল খেলা উচিত কিনা, কিংবা হাফপ্যান্ট পরে শরিয়া লঙ্ঘন করা নারীরা কতটা ‘পাপ’ করেছেন সেই আলাপ আমাদের সমাজে থাকা দীর্ঘকালীন সংঘাতময় মানসিকতাকে নির্দেশ করে। আলাপে সমস্যা নেই, কিন্তু আমরা আবারও দেখলাম এই আলোচনার দুই পক্ষে যারা আছেন তারা একে অপরের প্রতি ভীষণ অসহিষ্ণু হয়ে পরস্পরকে আক্রমণ করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের সমাজে এই বিভক্তি বাড়ছে এবং ভীষণ কট্টর পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে। যৌক্তিকভাবেই অনুমান করা যায়, আগামী সময় কোনও একটা পরিস্থিতিতে এই দুই পক্ষ ভয়ংকরভাবে পরস্পরের বিরুদ্ধে কোনও নৃশংসতায় জড়িয়ে পড়বে।

এই দেশে কেউ কখনও কোনও কিছু যদি অর্জন করতে পারেন তখন আমরা তাকে নিয়ে ভীষণ মেতে উঠি। এর আগে হয়তো তাদের খোঁজও থাকে না আমাদের কাছে। বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল যখন সাফ চ্যাম্পিয়ন হলো তখন থেকেই আমরা তাদের নিয়ে ভীষণ মেতে উঠলাম। তাদের অজস্র খুঁটিনাটি আমাদের সামনে আসতে শুরু করলো। মূল ধারার মিডিয়া আমাদের দিয়ে যেতে থাকলো নানা তথ্য। এটাই হওয়ার কথা, যেহেতু এই দলটি এখন আমাদের মনোযোগের কেন্দ্রে আছে, তাই স্বাভাবিকভাবেই তাদের নিয়ে খবর আমাদের ‘খাওয়ানো’ বাণিজ্যের জন্য ভালো।

আমাদের সামনে এসেছে এই নারীরা কে কোথা থেকে উঠে এসেছেন, কতটা সংগ্রামী ছিল তাদের জীবন, নারীদের কোচ হওয়ায় দলটির কোচের টিটকারি-টিপ্পনীর শিকার হবার কথা। ফাইনালের আগে দলের একজনের দেওয়া ফেসবুক স্ট্যাটাস তো ভাইরাল হয়ে পড়ে। সেই ভাইরাল স্ট্যাটাসের ভিত্তিতে কার্টুন আঁকা হয় এবং সবশেষে বিআরটিসির বাসের ছাদ কেটে ছাদখোলা বাস বানানো হয়। সেই যাত্রা কোন রুটে, কীভাবে হলো, তাতে কোন খেলোয়াড় সাইনবোর্ডে মাথা ঠুকে আহত হলো, সেটার চিকিৎসায় কয়টা সেলাই লাগলো– এসব তথ্য আমাদের সামনে এসেছে।

প্রতিটি বিষয় নিয়ে আমরা আলাপ করেছি, বিতর্ক করেছি। কোনও আলোচনা-বিতর্ক যদি হিংসা-বিদ্বেষের পর্যায়ে না চলে যায়, তাহলে সেটা এ সমাজে সুস্থতারই লক্ষণ। আমি বিশ্বাস করি যেসব বিষয়কে আমরা খুব খুঁটিনাটি বলে মনে করি সেগুলো আসলে তা নয়। বরং এই বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ-আলোচনা সমাজের একটা প্রতিচ্ছবি আমাদের সামনে নিয়ে আসে। এটা গুরুত্বপূর্ণ।

এই খুঁটিনাটি আলোচনার সূত্রে দুটি খবর নিয়ে আমি দুটো কথা বলতে চাই। প্রথম খবরটি হচ্ছে বিমানবন্দরে। অভিযোগ উঠেছে ঢাকায় বিমানবন্দরে ফুটবলার কৃষ্ণা রানি সরকার ও শামসুন্নাহারের লাগেজ থেকে বড় অঙ্কের ডলার, কাপড়চোপড় ও অন্য কিছু জিনিসপত্র চুরি হয়ে গেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ পরীক্ষা করে জানিয়েছিল এখানে তেমন কিছু হয়নি। ফলে এই আলোচনাও হয়েছে, তাহলে চুরি নেপালের এয়ারপোর্টেও তো হতে পারে। বাস্তবে তাদের লাগেজ থেকে চুরি কোথায়, কীভাবে হয়েছে সেটা আমার এই আলাপের সাথে জড়িত নয়। আমি বরং আলাপ করতে চাই আমরা যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখেছি সেটা নিয়ে।

এই ঘটনার সাথে সাথে বিমানবন্দরে এরকম ঘটনা যে আরও অনেক ঘটেছে এবং নিয়মিত ঘটছে, আমাদের অনেকেই সেটা সামনে এনেছেন। স্বাভাবিকভাবেই অনেকে বলেছেন এই বিমানবন্দরে নানা ধরনের অব্যবস্থাপনা-দুর্নীতি এবং এর প্রভাবে যাত্রীদের চরম হয়রানির কথা। তবে আমাদের এই কলামের আলোচনা করছি তাদের নিয়ে, যারা মনে করেন, ওই দুই খেলোয়াড়ের লাগেজে চুরি হয়েছে এবং সেটা ঢাকা এয়ারপোর্টেই। আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ তাদের মন্তব্য যারা মনে করছেন, চ্যাম্পিয়ন নারীর দল থেকেও লাগেজ চোররা ছাড় দিল না! যারা এভাবে ভাবছেন, তারা বুঝতে পারছেন, এই ঘটনাই প্রমাণ করে, এই জাতি কত খারাপ অবস্থায় চলে গেছে।

কথা ছিল বাংলাদেশ সাম্যের দেশ হবে। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে লিখে রাখা তিনটি অতি সুন্দর কথার মধ্যে প্রথমটিই ছিল সাম্য। কারণ, আমাদের ওপরে পশ্চিম পাকিস্তানের চাপিয়ে দেওয়া বৈষম্যই ছিল অসন্তোষের প্রধান কারণ। অথচ এই দেশে ‘সাম্য’ বিষয়টিই এখন সবচেয়ে উপেক্ষিত, অনুপস্থিত। এটি স্রেফ কথার কথা।

এই যে বিমানবন্দরের এত ব্যবস্থাপনার কথা বলা হচ্ছে, সেখানেও নিশ্চিত হয় না সাম্য। সেখানে ভিআইপিদের জন্য একরকম ট্রিটমেন্ট, মধ্যবিত্ত উচ্চ-মধ্যবিত্ত, ধনীদের জন্য একরকম আর একেবারেই আলাদা রকম ট্রিটমেন্ট মধ্যপ্রাচ্যের কাজ করা শ্রমিকদের জন্য। দেশের অর্থনীতিকে আজ এই পর্যায়ে নিয়ে আসার পেছনে যে মানুষরা অবদান রেখেছেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছেন মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী কোটি কোটি শ্রমিক। এদের মাথায় তুলে রাখার কথা ছিল আমাদের, বিমানবন্দরের সবচেয়ে বড় ভিআইপি তাদের হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু না, তাদের হয়রানি প্রতি মুহূর্তের ব্যাপার।

যে লাগেজে চোরেরা চুরি করেছে, জানি না তারা জানতো কিনা এটা কাদের ব্যাগ। যদি জেনে থাকে তাহলে বিমানবন্দরের এই চোর বরং সাম্য প্রতিষ্ঠিত করেছে।

বাংলা ট্রিবিউনেই একবার আমি একটা কলাম লিখেছিলাম, বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ছাত্রদের চিকিৎসার জন্য ডোনেশন চাওয়ার ক্ষেত্রে সবার নামের সাথে মেধাবী যোগ করা হয়। সেই কলামে প্রশ্ন করেছিলাম, একজন কিশোর বা তরুণ অর্থাৎ তরতাজা একটি প্রাণ মারা যাচ্ছে এটুকু তথ্য কি আমাদের বিবেককে যথেষ্ট জাগায় না? আমাদের বিবেক কি কিছুটা বেশি জাগ্রত হয় যদি সেই ছাত্রটি মেধাবী হয়?

ঠিক একই মানসিকতা দেখছি এখানেও। আজ একজন সাধারণ মানুষের চুরিকে নিশ্চয়ই আমরা সমর্থন করতাম না কিন্তু এটা তো নিশ্চিত বিজয়ী নারীদের ওপরে চুরিটাকে আমাদের কাছে আরও বেশি বড় অপরাধ বলে মনে হচ্ছে। তাহলে প্রশ্ন আসতেই পারে, এই নারীরা যদি সাফ টুর্নামেন্টে খুব খারাপ ফলাফল করে, ট্রফি না জিতে ফিরে আসতো এবং তাদের ব্যাগে চুরি হতো, তাহলে সেটাকে আমরা কীভাবে দেখতাম?

একই সময়ে ঘটেছে আরেকটি ঘটনা, এটাকেও এর সাথে যুক্ত করা জরুরি। ট্রফিজয়ী দলটির এক সদস্য আঁখি সদস্য ছিলেন বাংলাদেশের অনূর্ধ্ব-১৫ ফুটবল দলটিরও। সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে গোল্ডেন বুট জেতায় আঁখি একবার সরকার থেকে জমি বরাদ্দ পেয়েছিলেন। সেই জমি নিয়ে সমস্যা হয়। পরে সেটা পরিবর্তন করে দেওয়া হয় অন্য জমি এবং পরিবর্তিত জমি নিয়েও সমস্যা থেকেই যায়। এই ঘটনার খুঁটিনাটি আমাদের প্রয়োজন নেই। এটুকু জেনে রাখি, সেই জমির সমস্যা নিয়ে আদালতের একটি রায় জানাতে গিয়ে সেই থানার এএসআই এবং আরও কয়েকজন পুলিশ আঁখির বাবার সাথে দুর্ব্যবহার করেন।

বাংলাদেশের বর্তমান নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়ন দলটির বেশিরভাগ সদস্য এসেছেন দরিদ্র-প্রান্তিক পরিবার থেকে। অনেককেই দেখছি ফেসবুকে তাদের সাথে এই শব্দগুলো ব্যবহার করা নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করছেন। আসলে আমরা এই সমাজে দারিদ্র্যকে এখন লজ্জার বিষয় মনে করি বলেই এভাবে বলি। আমি বরং বলতে চাই, দরিদ্র-প্রান্তিক পরিবার থেকে উঠে আসা তাদের এই লড়াইকে আরও বেশি মহিমান্বিত করে, গৌরবান্বিত করে।

যাহোক, আঁখিও এমন পরিবারেরই সন্তান। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার এক গ্রামে মাত্র ১ শতাংশ জমিতে একটি দোচালা ঘরের বাস করে তার পরিবার।

আঁখির পরিবারের আর্থিক অবস্থা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, এরকম পরিবারের কারও বাড়িতে গিয়ে পুলিশ কারও সাথে দুর্ব্যবহার করা তো বটেই, চড়-থাপ্পড় এমন কি বেধড়ক পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে দিয়ে এলেও তাতে পুলিশের কিছু আসে যায় না। কিন্তু না, আঁখি এখন একটি চ্যাম্পিয়ন ফুটবল দলের সদস্য, তাই ওই এসআই এবং কনস্টেবলকে আঁখির বাবার কাছে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করা হয়েছে। শুধু সেটাই নয়, তাদের প্রত্যাহার করা হয়েছে ওই থানা থেকে।

এই ঘটনাটিকে নারী ফুটবলের বিজয়ীদের প্রতি এক ধরনের সম্মান হিসেবে দেখতে পারেন যারা তাদের লাগেজ থেকে চুরি করা চোরদের অনেকটা বেশি সমালোচনা করেছিলেন। এটা আমাদের সমাজের এই গভীর ক্ষতকেই উন্মোচিত করেছে। এটা এই সমাজের সাম্য এবং ন্যায়বিচারের অনুপস্থিতিকেই প্রমাণ করে। সচেতনভাবে স্বীকার না করলেও আমরা অনেকেই মনে করি, প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে মানুষে মানুষে আচরণ ভিন্ন হবে।

নানা সময়ে আমরা এমনভাবে চিন্তা করি, মন্তব্য করি, আচরণ করি, যা আসলে এই সমাজের ন্যায়বিচারের পরিপন্থি । সরকারের দিক থেকেও নেওয়া আপাত ভালো অনেক পদক্ষেপও আসলে ন্যায়বিচারের বিরুদ্ধেই যায়।

মানুষের প্রতি মানুষের সংবেদনশীলতা মনুষ্যত্বের লক্ষণ, সভ্য সমাজের লক্ষণ। সেটার চর্চা হতে দেখা এই সমাজের বাসিন্দা হিসেবে আমাদের কাছে আনন্দেরই হবার কথা। কিন্তু বেছে বেছে প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সংবেদনশীলতা প্রকাশ কিংবা প্রকাশের মাত্রার তারতম্য করার মধ্যে একটা অনৈতিকতা আছে। সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশের নারী ফুটবল দলের যে দুটি ঘটনা নিয়ে এখানে কথা বললাম, সেই দুটি ক্ষেত্রে আমাদের সংবেদনশীল হবার মাত্রার মধ্যে যে অনৈতিকতা আছে, সেটা কি দেখতে পাচ্ছি আমরা?

লেখক: শিক্ষক ও অ্যাকটিভিস্ট

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
গাইবান্ধায় আ.লীগের প্রার্থীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ
গাইবান্ধায় আ.লীগের প্রার্থীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ
আ.লীগের সঙ্গে জাপা নেতাদের ৩ দফায় বৈঠক, যা জানা গেলো
আ.লীগের সঙ্গে জাপা নেতাদের ৩ দফায় বৈঠক, যা জানা গেলো
চালককে মারধর করে পিকআপভ্যানে আগুন, পুড়ে মরলো কয়েকশ মুরগির বাচ্চা
চালককে মারধর করে পিকআপভ্যানে আগুন, পুড়ে মরলো কয়েকশ মুরগির বাচ্চা
মোটরসাইকেলে বাড়ি ফেরার পথে প্রাণ গেলো ২ বন্ধুর
মোটরসাইকেলে বাড়ি ফেরার পথে প্রাণ গেলো ২ বন্ধুর
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ