X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

‘লু হাওয়া’

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
১৮ জানুয়ারি ২০২৩, ১৭:৩৭আপডেট : ১৮ জানুয়ারি ২০২৩, ১৭:৩৭

প্রকৃতিতে শুকনো গরম হাওয়া যখন শুষে নেয় জীবনীশক্তি তখন একে বলে ‘লু হাওয়া’। বাংলাদেশের রাজনীতিতেও ‘লু হাওয়া’ থাকে বরাবর। কেউ বিরোধী অবস্থানে থেকে আগ্রাসী উচ্চারণে ঝড় তোলেন, কেউ শাসক দলের তরফে মাটিতে পদ্ম ফোটাতে দিনরাত এক করেন। কেউ আবার এই দুয়েরই ঘোর বিরোধী হয়ে বিকল্প পথ খোঁজেন।

দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশি দেশের হস্তক্ষেপ নিয়ে বিস্তর আলোচনা আছে। বিশেষ করে নির্বাচন যখন ঘনিয়ে আসে তখন এই তৎপরতা বেশি দেখা যায়। যারা বিরোধী অবস্থানে থাকেন, তারা বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে যান, নানা প্রকার নালিশ জানান। আমরা দেখি বিদেশিরাও বাংলাদেশের নির্বাচন, গণতন্ত্র, আইনের শাসন নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন। ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস নাখালপাড়ায় একজন নিখোঁজ বিএনপি নেতার বাসায় চলে গিয়েছেন এবং তাকে সেখানে কিছুটা বিব্রতকর অবস্থায়ও পড়তে হয়েছে। বিষয়টি বিব্রতকর ছিল সরকারের জন্যও। এ নিয়ে খোদ ওয়াশিংটনে কথা হয়েছে এবং বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীরাও বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন।

এই ঘটনাসহ র‌্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করা নিয়ে সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে কিছুটা টানাপোড়েন দেখছিলাম আমরা। এবং এই পরিস্থিতিতে বিরোধী শিবিরে একটা উল্লাসের চেহারা ছিল। তাদের কথা ও আচরণে আভাস পাওয়া যাচ্ছিল যে আমেরিকার সঙ্গে সরকারের বৈরিতা মানে তাদের ক্ষমতায় আসার পথ প্রশস্ত হওয়া।

ঠিক এমন এক রাজনৈতিক লু হাওয়ায় ঢাকা ঘুরে গেলেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। এবং এই সফরের পর থেকে সরকারের ভেতর একটা স্বস্তির ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। সফরের মাধ্যমে দুই দেশের সম্পর্কের সম্পৃক্ততা আরও বাড়ার ইঙ্গিত পাওয়া গেলো। উভয় পক্ষ বর্তমান দূরত্ব ঘোচানোর প্রয়াস চালিয়ে যাবে বলেই মনে করা হচ্ছে।

বরাবরই যে বিষয়গুলো সবসময় আলোচনায় প্রাধান্য পায় এবারও তাই ছিল– গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা। উভয় তরফে বলা হয়, এই চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলেছেন। এবং বলেছেন বাংলাদেশে গণতন্ত্র নিখুঁত নয় এবং এই চ্যালেঞ্জটা তার নিজের দেশের বেলায়ও প্রযোজ্য। সমস্যার বিষয়ে কথা বলতে হলে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য না দিয়ে, খোলামনে কথা বলে সমস্যার সমাধান করা সম্ভব বলেই তিনি মনে করেন।

বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কথা বলে, গণতন্ত্র, মানবাধিকার নিয়ে কথা বলে। কিন্তু দেশ অনুযায়ী তার নীতি আসলে ভিন্ন। এমন অনেক দেশ আছে, যেমন সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো, ভিয়েতনামসহ অনেক দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের চমৎকার সম্পর্ক, যেখানে গণতন্ত্র, মানবাধিকারের চিহ্ন নেই। আসল কথাটা হলো স্বার্থ এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ও সামরিক স্বার্থ। ডোনাল্ড লু সাহেবও এবারের আলোচনায় সামরিক কৌশলগত দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন। কারণ, ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র।

বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের মধ্যকার জোট ‘কোয়াড’-এ এখনও অংশ নেয়নি এবং নেবে কিনা তাও স্পষ্ট করেনি। তবে বোঝা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সুপারিশের বিষয় এখন আর সরাসরি নাকচ করছে না বাংলাদেশ। বরং বিভিন্ন বিষয়ে পর্যালোচনা করছে। নির্বাচন প্রশ্নে সরকার তার অবস্থান পরিষ্কার করেই জানিয়ে দিয়েছে, সাংবিধানিক ব্যবস্থার বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়।

নির্বাচন, রাজনীতি ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশ্যে মন্তব্য করাকে বাংলাদেশ সরকার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বলে বিবেচনা করে। বাইডেন প্রশাসনের এই প্রবণতা নিয়ে প্রকাশ্যে ক্ষোভও জানিয়েছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে উভয় পক্ষেরই সুর নরম। গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে ডোনাল্ড লু স্পষ্ট করে বলেছেন, এক দলকে সরিয়ে অন্য দলকে যুক্তরাষ্ট্র ক্ষমতায় বসাবে, এটা ভুল ধারণা। ক্ষমতায় কে যাবে, সেটা বাংলাদেশের জনগণই ঠিক করে দেবে।

ঠিক এ জায়গাকেই নিজেদের পক্ষে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে আওয়ামী লীগ। দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে যে ওয়াশিংটন গুরুত্ব দেয়, সেটিও স্পষ্ট হয়েছে এই সফরে। বিচারবহির্ভূত হত্যা কমে যাওয়ায় ডোনাল্ড লু র‌্যাবের প্রশংসা করেছেন।

ডোনাল্ড লু’র সফরকে সামগ্রিকভাবে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেই দেখতে হবে। রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বৈরিতা তার মিত্র দেশগুলোকে (যত ছোটই হোক তারা) অন্য পক্ষে ঠেলে দেয় কিনা সেই বিবেচনা তাদের আছে। এই অঞ্চলকে ঘিরে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয় যুক্তরাষ্ট্র।

ফলে বাংলাদেশের নির্বাচনের এক বছর আগে এই সফর এবং সামনে অনুষ্ঠিতব্য আরও মার্কিন কর্মকর্তার সফরকে শুধু রাজনৈতিক জায়গা থেকে নয়, বহুমাত্রিক প্রেক্ষাপট থেকে দেখতে হবে। এবং এখানে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গিও যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখে। একটি স্বাধীন বিদেশনীতি যেকোনও সার্বভৌম রাজনৈতিক সরকারের স্মারকচিহ্ন। বাংলাদেশ সে জায়গায় নিজের অবস্থান সংহত করেই পথ চলছে একটি জটিল ভূ-রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতের মধ্যে থেকেও।

লেখক: সাংবাদিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
জেফারকে সিনেমায় নিয়েছে ফারুকীকন্যা ইলহাম!
জেফারকে সিনেমায় নিয়েছে ফারুকীকন্যা ইলহাম!
‘জুনের মধ্যে ১০ হাজার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ সম্পন্ন হবে’
‘জুনের মধ্যে ১০ হাজার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ সম্পন্ন হবে’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ