X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ট্রান্সজেন্ডার পাঠ জরুরি নয় কেন?

লীনা পারভীন
২৫ জানুয়ারি ২০২৩, ২০:৪৩আপডেট : ২৫ জানুয়ারি ২০২৩, ২০:৪৩

প্রথমেই বলে নিই, আমি কোনও শিক্ষাবিদ বা শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ নই। কিন্তু বাংলাদেশে তো কোনও বিশেষায়িত বিষয় নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা করতে কোনও বিশেষজ্ঞ হওয়া লাগে না। সেই সাহস থেকেই আজকে আমার কলম ধরা।

সরকার এবারই প্রথম আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার অচলায়তন কাটাতে যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছে। কী সেই পদক্ষেপ? ৯৯ ভাগ মানুষ যারা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ‘গেলো গেলো’ বলে রব তুলছে তাদের কেউই আসলে কী ছিল আর কী এলো সেই ধারণা রাখেন কিনা সন্দেহ আছে। ফেসবুকের আলোচনা ধরেই সবাই হায় হায় করে মাথা চাপড়াচ্ছে।

আমিও ফেসবুকের একজনই। ফেসবুকেই জেনেছি কত কি ঘটে যাচ্ছে। কৌতূহলী হয়ে একটু পড়াশোনা করতে চাইলাম। পরিচিত দুই একজন আছেন, যারা এই কারিকুলাম কমিটিতে কাজ করেছেন। তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। কিছু ডকুমেন্ট নিয়েছি। জানার চেষ্টা করেছি সরকারের মোটিভ, কমিটির কার্যপরিধি আর কোন দৃষ্টিভঙ্গিকে ধারণ করে কনটেন্ট লেখা হয়েছে। পড়তে পড়তেই সামনে এলো বাংলা ট্রিবিউনের একটি কলাম। “সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য ট্রান্সজেন্ডার পাঠ কতটা জরুরি” এই কলামের দুটি দিক আমার নজরে এসেছে। লেখাটির অনেক কিছুর সঙ্গে আমার দ্বিমত আছে। আমি ভিন্নভাবে দেখার চেষ্টা করেছি। যদিও কলামের লেখক আমার চেয়ে নিশ্চয়ই পড়াশোনা বা জ্ঞানে অনেক এগিয়ে, তারপরও আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান থেকে কিছু কথা বলার প্রয়োজন বোধ করছি।

প্রথমেই আসি, বইটিতে লেখক যে অধ্যায় এবং যে গল্পটি নিয়ে আলোচনা করেছেন সেটি আমি পড়েছি। সেই অধ্যায়ে যে অনুশীলন পর্ব আছে সেটিও দেখেছি। বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে সংক্ষেপে আমি যা বুঝেছি তা হলো, এই অধ্যায়টি আমাদের কোমলমতি বাচ্চাদের মধ্যে সমাজে যে নারী পুরুষ বৈষম্যের ধারণা নিয়ে বেড়ে ওঠে সেই কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করবে। কীভাবে?

এক. আগে সমাজবিজ্ঞানে আমরা মুখস্থ করতাম পরিবার, সমাজ, পাড়া, প্রতিবেশী, আত্মীয় ইত্যাদির সংজ্ঞা। আর পড়তাম নারীরা কী পড়বে, পুরুষরা কী পড়বে তার বিবরণ। অর্থাৎ, সেখানে স্পষ্টই নারী পুরুষের জন্য যে সামাজিক পার্থক্য গড়ে তোলা হয়েছে সেটির শিক্ষাই দেওয়া হতো। কিন্তু নতুন বইয়ে বাচ্চারা শিখবে, নারী বা পুরুষের মধ্যে আসলে পার্থক্যটা সমাজই গড়ে দিয়েছে। নারী বা পুরুষের পছন্দের রঙ থেকে শুরু করে খেলনার জিনিসেও যে পার্থক্য আছে সেটি একটি ভুল ধারণা, যা আমাদের বিভাজিত করে। আর এই শিক্ষাটি কেমন করে দেওয়া হবে? দেওয়া হবে ক্লাসে শিক্ষক আলোচনা, প্রশ্ন, অনুশীলন আর বাস্তব উদাহরণের মাধ্যমে ।

যেমন, বইয়ে দেখানো হয়েছে, অনুশীলন পর্বে খুশি আপা টেবিলে কিছু খেলনা, সাজগোজের জিনিস আর পোশাকের ছবি রাখলেন। ছেলে ও মেয়েদের দুটি গ্রুপে ভাগ হতে বললেন। ছেলেদের ও মেয়েদের জিনিসগুলো নিজের মতো করে বেছে নিতে বললেন এবং নিশ্চিত করলেন যে তারা সেটি করেছে। ভাগাভাগির পরে দেখা গেলো দুটি স্কুল ব্যাগের দুটি দুই গ্রুপ কোনও বিরোধ ছাড়াই নিয়েছে।

কেন এই প্রশ্ন করলে উত্তর পাওয়া গেলো, ছেলেরা নীল পছন্দ করে তাই নীল রঙ আর মেয়েরা গোলাপি পছন্দ করে তাই গোলাপি রঙ নিয়েছে, যার কারণে ডিজাইন নিয়ে কোনও বিরোধ হয়নি। উত্তরে খুশি আপা বললেন, আমি নীল রঙ পছন্দ করি, তাই শাড়িও পরেছি নীল। তাহলে কি তার পছন্দ ছেলেদের মতো?

এই প্রশ্নে সবাই অবাক হয়ে গেলো। বোঝানো হলো যে রঙের পছন্দটি একান্তই ব্যক্তির রুচির ওপর নির্ভর করছে। রঙের কোনও শ্রেণিবিভাজন হতে পারে না। আবার সেখানে খেলায় কোনও নারী পুরুষ পার্থক্য নেই বোঝাতে বাংলাদেশের নারী ফুটবল ও ক্রিকেট দলের উদাহরণও আনা হয়েছে। সরকারের নেওয়া নীতিমালার কথা আনা হয়েছে, যেটি আমাদের রাষ্ট্রের বিশ্বাস ও চর্চাকেই পরিচিত করবে।

এই যে গল্পটা, এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রশ্ন এসেছে। তারা ভেবেছে আর শিখেছে জেন্ডার আসলে পুরোটাই সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়। এরমধ্যে বিজ্ঞানের কোনও ভিত্তি নেই। আর এই জেন্ডার পার্থক্যই সমাজে নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর এগিয়ে যাওয়াকে রুখে দিচ্ছে। কেবল জেন্ডার পার্থক্যের কারণে আমাদের ছেলেমেয়েরা বিভাজিত শিক্ষা পাচ্ছে। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রম সমাজ থেকে হাজার বছরের চলে আসা এই ভুল ধারণাকে আঘাত করবে বলেই আমার বিশ্বাস।

সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন বিষয়টা প্রাকৃতিক, যার ওপর মানুষের হাত নেই। আর এই জেন্ডার, সেক্স-এর ধারণা মোটেই নারীবাদীদের তৈরি নয়। এটি সমাজবিজ্ঞানের একটি বিষয়, যাকে আমরা অবৈজ্ঞানিক বলতে পারি না। সমাজবিজ্ঞান অবৈজ্ঞানিক কোনও ভিত্তির ওপরে দাঁড়ানো নয়। পার্থক্য কেবল এতদিন ট্র্যাডিশনাল বিশ্বাসের ভিত্তিতে পড়ানো হতো আর এখন পড়ানো হবে পরিবর্তিত বিশ্বাসকে ধারণ করে। তাই সেক্স ও জেন্ডার ইস্যুগুলো নারীবাদের আলোচ্য বিষয় হলেও এটি তাত্ত্বিকভাবে সামাজিক বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত বিষয়।

দুই. এবারই প্রথম বইয়ে ট্রান্সজেন্ডার বিষয়টিকে যুক্ত করা হয়েছে। এর আগে আমাদের দেশে নারী বা পুরুষের বাইরেও যে কিছু মানুষের অস্তিত্ব থাকে সেটি সম্পর্কে কোনও ধারণাই ছিল না। অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণকে সাবলীল ভঙ্গিতে বইতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যে শরীফা গল্প নিয়ে লেখক আপত্তি করেছেন যে ট্রান্সজেন্ডারের মতো বিষয় এত ছোট বাচ্চাদের পড়ানো কতটা প্রয়োজনীয় সেখানেই প্রশ্নটা আসে। ট্রান্সজেন্ডার কিন্তু নির্দিষ্ট বয়সের বিষয় নয়। এর প্রকাশ মানবশরীরের কারও জন্মের পর আবার কারও বয়ঃসন্ধিকালের সঙ্গে প্রকাশিত হয়। আর আমরা এটাও জানি যে বয়ঃসন্ধিকালের এখন আর কোনও বয়সসীমা নেই। শরীফার গল্পটি এখানে দিতে গেলে লেখা অনেক লম্বা হয়ে যাবে। তবে ছোট করে বলি যে একটি দারুণ গল্পের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা তাদের প্রচলিত নারী, পুরুষ ধারণার বাইরে আরেকটি ধারণার সঙ্গে পরিচিত হবে। শরীফা এখানে একটি চরিত্র, যে কখন, কেমন করে নিজেকে ভিন্ন ভাবতে শুরু করলো সেই গল্পটা জানা যাবে। দেখতে নারী হলেও সে ভেতরে পুরুষ বা পুরুষ হয়েও একজন নারীসত্তা নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে। আর এটিই হচ্ছে ট্রান্সজেন্ডারের বিষয়। ট্রান্সজেন্ডাররা যে পরিবারে বাস করতে পারে না এবং এই না পারার কারণে তারা কতটা অমানবিকতার শিকার হয় সেই গল্পটি উঠে এসেছে শরীফার মুখ দিয়ে। ক্লাসে শিক্ষক শরীফার মুখ দিয়ে সমাজে প্রচলিত ট্রান্সজেন্ডার, হিজড়ারা কেমন করে পারিবারিক, সামাজিক বৈষম্যের শিকার হয় সেই গল্প জানাবেন। শরীফার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর এক জায়গায় দেখা যাবে সহপাঠীরা নিজেরা নিজেরা প্রশ্ন করছে আবার উত্তরও দিচ্ছে নিজের মতো করে। শরীফার পরিবার বিচ্ছিন্নতা, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তারা যে স্বাভাবিক সুবিধাবঞ্চিত থাকে এই গল্প শুনে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের মানবিকতার প্রকাশও দেখা গেছে।

জেন্ডার, সেক্স, হিজড়া, ট্রান্সজেন্ডার ইত্যাদি সম্পর্কে গল্পের মাধ্যমে পড়ানো ছাড়াও শিক্ষক, শিক্ষার্থী সবাই মিলে প্রশ্ন করছে, উত্তর দিচ্ছে এমন বিষয়ও সম্পৃক্ত আছে। প্রশ্নোত্তর পর্বটি অত্যন্ত মজাদার ও জ্ঞানের জন্ম দেবে।

এই যেমন– ক্লাসে ম্যাডাম প্রশ্ন করে জানতে চাইছেন, ছেলে ও মেয়েদের পোশাক, চলাফেরা, খেলাধুলা ইত্যাদির মধ্যে যে পার্থক্য, এটি কেন? এর উত্তর দিতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই বুঝে নিলো যে এটির আসলে স্বতঃসিদ্ধ কোনও নিয়ম নেই। সবটাই মানুষের সৃষ্ট বিষয়। এক জায়গায় তারা আলাপ করছে, ‘তাহলে ছেলে ও মেয়ে ছাড়াও ভিন্ন রকমের মানুষ হয়?’

আবার আরেকজন প্রশ্ন করছে, ‘আমার জানতে ইচ্ছে করছে, আমাদের সময় ছেলে ও মেয়েদের পোশাক, কাজকর্ম, আচরণ যেমন দেখি, প্রাচীন মানুষেরও কি তেমন ছিল? সামনের দিনেও কি এমনটা থাকবে?’ এই আলোচনার একপর্যায়ে নীলা নামের এক শিক্ষার্থী শেয়ার করছে যে তার মা তাকে বেগম রোকেয়ার “সুলতানার স্বপ্ন” গল্পটি পড়ে শুনিয়েছে, যেখানে ছেলে ও মেয়ের প্রচলিত ভূমিকা উলটে গিয়েছে।

একজন অভিভাবক হিসেবে আমি অবশ্যই চাই আমাদের সন্তানেরা আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞান নিয়ে বেড়ে উঠবে। তাদের মধ্যে বাস করবে না কোনও কূপমণ্ডূক ধারণা বা এমন কোনও বিশ্বাস নিয়ে থাকবে না যা তাদের বৈশ্বিক মানব হতে বাধা দেবে।

আসলে শিক্ষা বা জ্ঞানলাভের কোনও বয়স বা সীমা থাকা উচিত না। ট্রান্সজেন্ডার সমাজের বাইরের কোনও বিষয় নয়। ক্লাস সেভেনের বাচ্চারা এখন যথেষ্ট পরিপক্ব হয়। তাই সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে যে বিষয়গুলো যুক্ত করা হয়েছে এবং যে মডেলে শেখানো হবে সেটি একটু যুগান্তকারী ঘটনা। এখানে কেবল বিষয়বস্তু যুক্ত করেই ছেড়ে দেওয়া হয়নি। শিক্ষক কেমন করে পড়াবে, কেমন করে পাঠ্যবিষয়ের মূল্যায়ন হবে, পড়ানো কতটা বাস্তবভিত্তিক করতে হবে, এসব বিষয় একটি নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসা হয়েছে, যার ফলে শিক্ষকদের ব্যক্তিগত বিশ্বাস বা চর্চা এরমধ্যে আসার কোনও সুযোগ আর থাকবে না।

এই পাঠ্যক্রম একটি অভিন্ন চিন্তার জাতিগঠনে ভূমিকা রাখবে। আমরা সবাই সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের কথা বলি আর সেই পরিবর্তনের শিক্ষাব্যবস্থা একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। আমাদের সমাজে বহুধারার শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলনের কারণে বৈষম্য ও চিন্তার বিভক্তি বজায় আছে। আশা করছি সরকার এই দিকটিও গুরুত্ব দিয়ে ভাববে। এক দেশ, এক জাতি ও একই বিশ্বাসের মানবসমাজ গঠনে একই ধারার শিক্ষা ব্যবস্থার কোনও বিকল্প নাই। তাই শিক্ষার্থীদের বৈজ্ঞানিক উপায়ে সবকিছু শিখানোতেই মুক্তি মিলতে পারে সামাজিক বন্ধ্যত্বের।  

লেখক: কলামিস্ট
 
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দোকান থেকেই বছরে ২ লাখ কোটি টাকার ভ্যাট আদায় সম্ভব
দোকান থেকেই বছরে ২ লাখ কোটি টাকার ভ্যাট আদায় সম্ভব
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে অতীত ফিরিয়ে আনলেন শান্ত-রানারা
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে অতীত ফিরিয়ে আনলেন শান্ত-রানারা
হিট স্ট্রোক প্রতিরোধে করণীয় ও বিশেষজ্ঞ পরামর্শ জেনে নিন
হিট স্ট্রোক প্রতিরোধে করণীয় ও বিশেষজ্ঞ পরামর্শ জেনে নিন
হাতিরঝিলে ভাসমান অবস্থায় যুবকের মরদেহ
হাতিরঝিলে ভাসমান অবস্থায় যুবকের মরদেহ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ