X
সোমবার, ০৬ মে ২০২৪
২৩ বৈশাখ ১৪৩১

কোথায় থামতে হয়, তা জানতে হবে

ড. জেবউননেছা
১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৮:১৪আপডেট : ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৮:১৪

আজ দুপুরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ক্লাস শেষ করে ফিরছিলাম। মুঠোফোনে সামাজিক মাধ্যম হাতড়াতে গিয়ে দেখি দেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে বীর মুক্তিযোদ্ধা সাহাবুদ্দিন চুপ্পুকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দিয়েছে। নামটি শুনে ভালোই লাগলো। আমি তাকে একজন প্রাবন্ধিক হিসেবে চিনি। কারণ, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সাহাবুদ্দিন চুপ্পু বেশ কয়েকটি লেখা লিখেছেন। যাহোক, সামাজিক মাধ্যমে একজন উষ্মা প্রকাশ করে বলেছেন– বীর মুক্তিযোদ্ধা সাহাবুদ্দিন চুপ্পু নাকি তার কাছে অপরিচিত একজন মানুষ।

আমি তার টাইমলাইনে মন্তব্য দিলাম, কাউকে নিয়ে কথা বলার সময় সম্মান দিয়ে কথা বলতে হয়। আর কারও সম্পর্কে মতামত প্রদান করতে চাইলে আগে একটু খোঁজ-খবর নিয়েও করতে হয়। পরক্ষণেই আর একজন লিখলেন, ‘কী করে ওনাকে চিনবো? কী বই লিখেছেন? ওনার কি কোনও উইকিপিডিয়া আছে? ওনার কি ফেসবুক আছে? তেমন কোনও ছবিই তো খুঁজে পাচ্ছি না’। এ ধরনের আরও অনেক কথা।

আমি মনে মনে হাসি আর ভাবি– হায়রে! কী এক দুঃসময়ে আছি আমরা, সস্তা জনপ্রিয়তা এবং চটকদারিতে অভ্যস্ত হতে হতে গুণী মানুষদের চিনতে ভুলে যাচ্ছি। এরপর নিজ উদ্যোগে গুগল অনুসন্ধান করে আগামীর রাষ্ট্রপতি সম্পর্কে পড়াশোনা করলাম। দেখা গেলো পাবনার সন্তান মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর জন্ম ১৯৪৯ সালে। ছাত্রজীবনে পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ও সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি পেশায় একজন আইনজীবী এবং বর্তমানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য। তিনি ইতোপূর্বে জেলা ও দায়রা জজ এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের একজন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা উপ-কমিটি সভাপতি এবং ১৯৭৪ সালে পাবনা জেলা আওয়ামী যুবলীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭১ সালে পাবনা জেলার স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৮২ সালে বিসিএস ক্যাডার হিসেবে বিচার বিভাগে যোগদান করেন এবং ১৯৯৫ সালে জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব নির্বাচিত হন। তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় আইন মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিযুক্ত সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচন পরবর্তী সময়ে বিএনপি-জামায়াত জোটের নেতাকর্মী দ্বারা সংঘটিত হত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠন  এবং মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড অনুসন্ধানে গঠিত বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছাত্রজীবনে পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি এবং ১৯৭৪ সালে পাবনা জেলা যুবলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর কারাবরণ করেন। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের  সর্বশেষ জাতীয় কাউন্সিলে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

শুধু তাই নয়, সাহাবুদ্দিন চুপ্পু নিয়মিত জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখেন। সম্প্রতি তাঁর লেখা ১৩ জানুয়ারি, ২০২৩ইং তারিখে ‘বিজয়ীর বেশে ফিরেন বঙ্গবন্ধু’ শিরোনামে একটি চমৎকার প্রবন্ধ দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত হয়েছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, কারও যদি উইকিপিডিয়া থাকে, সামাজিক মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ ফলোয়ার আর শত শত বন্ধু থাকে তাহলেই কি তিনি পৃথিবীর সবকিছু সম্পর্কে জানেন এবং বিখ্যাত? আর উইকিপিডিয়াই কি পরিচিতির প্রধান মাধ্যম? অথবা উইকিপিডিয়ায় যেসব তথ্য থাকে সবই সঠিক?

সামাজিক মাধ্যম এবং ভার্চুয়াল জগতে প্রবেশের পর আমাদের কাগুজে বই পড়ার অভ্যাস কমেছে। দু-একটা লেখা লিখে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দিয়েই আমরা নামকরা কিছু একটা বনে যাচ্ছি বলে সত্যিকারের মানুষগুলো হারানোর পথে। আমরা গভীরভাবে অনুসন্ধান করে শক্তিশালী যুক্তি দিয়ে এখন তর্কবিতর্ক করি না। যা করছি যা শিখছি সব ভাসা ভাসা। জ্ঞান অনুসন্ধানের কোনও ইচ্ছাই আমাদের নেই।

ছেলেবেলা আমার বাবাকে দেখেছি, তিনি যখন কোনও বই পড়তেন, তখন হাতে কলম রাখতেন, কোনও মূল্যবান তথ্য পেলে সেটা দাগ দিয়ে রাখবেন তাই। আমার বাবাকে অনুসরণ করে আমিও তা-ই করি। আমিও আমার ছেলের হাতে গল্পের বই তুলে দিয়েছি, মুঠোফোন দেইনি। জন্মের পর থেকে বহু প্রতিভাবান কবি-লেখক-সাহিত্যিক-রাজনীতিবিদ দেখেছি, যারা নীরবে কাজ করে গেছেন। কোনও ধরনের উইকিপিডিয়ায় নিজেকে রাখার জন্য কাজ করেননি। তাদের ধ্যানে জ্ঞানে ছিল সাধনা। নিজেকে আলোকিত করার সাধনা। তখন সামাজিক মাধ্যম নামক মেকি দুনিয়া ছিল না।

আমরা এখন না পড়ি নিয়মিত কাগজের পত্রিকা, না পড়ি কাগজের বই। যদি নিয়মিত পত্রিকা পড়তাম তাহলে মনোনীত রাষ্ট্রপতিকে চিনে ফেলতাম সহজেই।

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজের নাম উইকিপিডিয়ায় রাখার জন্য বছরের পর বছর কারাবরণ করেননি। শত শত বীর মুক্তিযোদ্ধা দেশের জন্য জীবন দিয়ে লড়াই করেছেন, নিজের নাম উইকিপিডিয়া বা গুগলে আনার জন্য করেননি।

আমি মাঝে মাঝে আমার বাবাকে বলি, ৬৩ বছর ধরে নীরবে সাহিত্য সাধনা করে গেলে, তোমার হাতে কত শিষ্যের জন্ম হলো। তারা এখন সামাজিক মাধ্যমে বিরাট বিরাট কবি সাহিত্যিক তকমা লাগিয়ে ফলোয়ার বাড়িয়ে যাচ্ছেন। দু-একজন ছাড়া কেউ তো বলেও না যে হাতে-কলমে তাদের লিখতে শিখিয়েছো তুমি। আর সেই তুমি নিশ্চুপ কাজ করে গেলে। আমার বাবার একটাই কথা– বিখ্যাত হওয়ার জন্য লিখিনি, লিখেছি মনের খোরাকের জন্য।

কয়েক দিন আগে আমার ছেলে বলছিল, মামণি তোমাকে তো কবি বলা যায়। আমি প্রশ্ন করলাম, কেন? সে উত্তরে বললো, তোমার প্রকাশিত দুটি কবিতার বই আছে। আর একটি কবিতার বই প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। আমি তাকে বললাম, আমি কবি নই। আমি শখের বশে লিখি। কবি হওয়া এত সহজ নয়। কবি হতে হলে কবিতা লেখার নিয়ম, কবিতা লেখার ব্যাকরণ জানতে হয়। আমি তো জানিই না কবিতা লেখার নিয়ম, তাহলে আমি কবি হলাম কী করে। আমার ছেলে চুপ করে থাকে।

যাহোক, প্রসঙ্গে ফিরে আসি। যেভাবে সামাজিক মাধ্যম থেকে আমরা শিক্ষিত হওয়ার চেষ্টা করছি, যেন সামাজিক মাধ্যম এখন আমাদের অনলাইন শিক্ষক। এই অবস্থা চলতে থাকলে একসময় আমাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে। একটি আলোকিত জাতি তৈরি হয় বই পড়ে। কিন্তু আমাদের প্রজন্ম কয়টা বই পড়ে? বইমেলায় এত এত দর্শনার্থী। কয়জন বই কিনি। মেলায় হাঁটতে হাঁটতে ধুলো ওড়ানো আর সামাজিক মাধ্যমে ছবি দেওয়া ছাড়া আর কোনও কাজ নেই বইমেলায়। আমরা এখন মুখস্থসর্বস্ব হয়ে গেছি। কারও সম্পর্কে না জেনে মন্তব্য করে ফেলি। কোথায় কী বলতে হবে না ভেবেই বলে ফেলি। আমরা ভুলে গেছি কোথায় থামতে হয়। কার সাথে কীভাবে কথা বলতে হয়। ভুলে গেছি, কেউ যদি অপরিচিতও হয়, তাকে সম্মান করে কথা বলতে হয়।

ফাস্টফুড দোকানে বসে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের বাতাস উপভোগ করতে করতে, সেই সঙ্গে মেয়নেজ মাখা বার্গার খেতে খেতে সামাজিক মাধ্যম স্ক্রল করতে করতে যা শিখছি, তা প্রকৃত শিক্ষা নয়।

শিক্ষা হলো প্রদীপ শিখা। যা জ্বলতে থাকে। মাধ্যমিকে শিখেছিলাম, মানুষ স্বভাবতই দ্বিজ, একবার পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেন, আর একবার জন্মগ্রহণ করেন জ্ঞান, বিদ্যা বুদ্ধি দিয়ে। সর্বত্র মুঠোফোন সর্বস্ব এই যুগে জ্ঞান, বিদ্যার আলো কতটা ছড়াচ্ছে তাই এখন ভাবার বিষয়। সামাজিক মাধ্যমের আবির্ভাব ঘটেছিল একটি বলিষ্ঠ যোগাযোগের জন্য। সেই সামাজিক মাধ্যম এখন হয়েছে বিখ্যাত হওয়ার মাধ্যম। যার যত বেশি ফ্যান ফলোয়ার, তিনিই এখন সমাজে বিখ্যাত। তিনিই সবজান্তা। যার লেখায় যত মন্তব্য আসবে, তিনিই নমস্ব, তপস্ব। আর যারা বছরের পর বছর দিনের পর দিন এই দেশটাকে, সমাজটাকে নিয়ে কাজ করে গেছেন, তারা এখন  অপরিচিত, অখ্যাত।

তাদের কেউ চিনতে চায় না, খুঁজতে যায় না। যে কারণে মনোনয়নপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতিকে অনেকের চিনতে অসুবিধা হচ্ছে। কারণ, সামাজিক মাধ্যমে ওনার তেমন কোনও উল্লেখযোগ্য ফ্যান-ফলোয়ার নেই। কী আশ্চর্য আমরা। ভাবতে অবাক লাগছে। অথচ পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলে গোল্ডেন এ- প্লাসের জোয়ার। এত গোল্ডেন চারপাশে, অথচ সুদূরপ্রসারী ভাবনা চিন্তার পথ প্রদর্শকের বড্ড বেশি অভাব।

বঙ্গবন্ধু দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘বাঙালি পরশ্রীকাতর জাতি’। আজ কেন যেন এই কথাটি খুব মনে পড়ছে।

সত্যি বলতে কী জহুরি সঠিক হীরা চিনে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একজন জহুরি বলেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের বন্ধু মহামান্য রাষ্ট্রপতি হিসেবে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা সাহাবুদ্দিন চুপ্পুকে মনোনয়ন দিয়েছেন। এখনই মুখ্য সময় দলের সঠিক মানুষগুলোকে মূল্যায়ন করার। নইলে শত কোটি দুধের মাছির মাঝে হারিয়ে যাবে দুঃসময়ে হাল ধরা মানুষগুলো। যারা কিছু পাওয়ার জন্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে ভালোবাসেননি, তাদের খুঁজে বের করা সময়ের দাবি। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে যারা হাত বাড়িয়েছিলেন, তাদের মূল্যায়ন করা সময়ের দাবি।

বঙ্গবন্ধু ১৮ জানুয়ারি, ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক অধিবেশনের ভাষণের একপর্যায়ে বলেছিলেন, ‘রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের চারটি জিনিসের প্রয়োজন এবং তা হচ্ছে নেতৃত্ব, আদর্শ, নিঃস্বার্থ কর্মী এবং সংগঠন।’ আগামীর মহামান্য রাষ্ট্রপতির দীর্ঘজীবনের জন্য প্রার্থনা করছি এই শুভলগ্নে।

 
লেখক: অধ্যাপক, লোক-প্রশাসন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আমান উল্লাহ আমানকে বিদেশ যাওয়ার অনুমতি দিলেন আপিল বিভাগ
আমান উল্লাহ আমানকে বিদেশ যাওয়ার অনুমতি দিলেন আপিল বিভাগ
বুধবার থেকে ঢাবিতে ক্লাস ও পরীক্ষা সশরীরে
বুধবার থেকে ঢাবিতে ক্লাস ও পরীক্ষা সশরীরে
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতলে ১ লাখ ডলার পাবেন বাবররা!
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতলে ১ লাখ ডলার পাবেন বাবররা!
সিলেটে বজ্রাঘাতে একজনের মৃত্যু
সিলেটে বজ্রাঘাতে একজনের মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ