X
শনিবার, ০৪ মে ২০২৪
২১ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকা-১৭ উপনির্বাচন: কে জিতলেন, কে হারলেন?

আমীন আল রশীদ
২১ জুলাই ২০২৩, ১৭:৩৫আপডেট : ২১ জুলাই ২০২৩, ১৭:৩৫

সংসদ সদস্য আকবর হোসেন খান পাঠানের (চিত্রনায়ক ফারুক) মৃত্যুতে শূন্য হওয়া ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে জয়ী হয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোহাম্মদ এ আরাফাত। রাজধানীর অভিজাত গুলশান-বনানী-ক্যান্টনমেন্ট এলাকা নিয়ে গঠিত এই আসনের মোট ভোটার ৩ লাখ ২৫ হাজার ২০৫ জন। এরমধ্যে ২৮ হাজার ৮১৬ ভোট পেয়ে এমপি হয়েছেন আরাফাত। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী আলোচিত-সমালোচিত সোশ্যাল মিডিয়া কনটেন্ট ক্রিয়েটর মো. আশরাফুল আলম, যিনি হিরো আলম নামে পরিচিত, তিনি পেয়েছেন ৫ হাজার ৬০৯ ভোট।

এ আসনে উপনির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন মোট ৮ জন। আরাফাত ও হিরো আলম ছাড়া এখানে আরও একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী এবং জাতীয় পার্টি, জাকের পার্টি, তৃণমূল বিএনপি, বাংলাদেশ কংগ্রেস, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তি জোটের প্রার্থী ছিলেন। এই প্রার্থীদের মধ্যে জাতীয় পার্টির সিকদার আনিসুর রহমান পেয়েছেন ১ হাজার ৩২৮ ভোট, আর সবচেয়ে কম মাত্র ৫২ ভোট পেয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. তারিকুল ইসলাম।

প্রশ্ন হলো, জনপ্রিয়তা ও ভোট প্রাপ্তির দিক দিয়ে যে জাতীয় পার্টিকে বলা হয় দেশের তৃতীয় বৃহত্তম দল, সেই দলের ভোট হিরো আলমের চেয়েও কম, নাকি হিরো আলমের ভোট জাতীয় পার্টির চেয়েও বেশি? বিএনপি এই নির্বাচনে অংশ নিলে ফলাফল কি এরকমই হতো? জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যে প্রার্থী মাত্র ৫২ ভোট পেলেন, তিনি কেন নির্বাচনে দাঁড়ালেন? নির্বাচন কি এতই খেলো বিষয়? নির্বাচনটি এরকম খেলো বিষয়ে পরিণত হলো কেন?

যে হিরো আলম মূলত একজন ইউটিউবার এবং যার কনটেন্টগুলো মানুষ দেখে মূলত রসিকতা করার জন্য, সেরকম একজন ব্যক্তিও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রার্থী হয়ে যাচ্ছেন এবং সেখানে দেশের সংবিধান ও আইন যে কোনও বাধা দিচ্ছে না—এটি কি রাজনীতির জন্য খুব ভালো বিষয়? রাষ্ট্রের যেকোনও নাগরিক চাইলেই সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন এবং ভোটাররা চাইলে তিনি এমপিও হয়ে যেতে পারেন, এটি গণতন্ত্রের যেমন শক্তি বা সৌন্দর্য, একইসঙ্গে এটি কি গণতন্ত্রের দুর্বলতাও নয়?

যেহেতু বিদ্যমান নির্বাচনি ব্যবস্থায় ন্যূনতম কত শতাংশ ভোট পেতে হবে তার কোনও সীমারেখা নেই, সেহেতু ৮-১০ শতাংশ ভোটারের ম্যান্ডেট নিয়েও যে কেউ জনপ্রতিনিধি হতে পারেন। একইসঙ্গে এই নির্বাচনকে সাংবিধানিক বা আইনগতভাবে চ্যালেঞ্জ করারও সুযোগ নেই। সুতরাং ঢাকা-১৭ আসনে মাত্র ৮ শতাংশ ভোট পেয়েও যে মোহাম্মদ আরাফাত সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেন, এটি আইনত বৈধ হলেও কেন এই ভোট নিয়ে মানুষের আগ্রহ ছিল না বা কেন এত কম সংখ্যক লোক ভোট দিতে এলেন এবং কেন এত সামান্য ভোট পেয়ে তাকে নির্বাচিত হতে হলো, তার কারণ বিশ্লেষণ করা জরুরি।

ধারণা করা যায়, এই নির্বাচন নিয়ে মূলত দুই কারণে ভোটারের আগ্রহ কম ছিল।

১. নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি অংশ নেয়নি এবং ২. এই সংসদের মেয়াদ আছে আর ৫ মাসের মতো। এত অল্প সময়ের জন্য একজন এমপি নির্বাচিত হয়ে তিনি যে খুব বেশি কাজ করতে পারবেন না, সেটি ভোটাররা তো বটেই, বিজয়ী প্রার্থীও জানেন।

এর বাইরে আরও অনেক কারণে ভোটের ব্যাপারে মানুষের আগ্রহ কমছে। অনেকে মনে করেন, আমি ভোট না দিলে কী হবে? অনেকে ভোটের দিন তার এলাকায় সাধারণ ছুটি থাকে বলে পরিবার-পরিজনের সঙ্গে সময় কাটান। কেউ কেউ ঘুরতেও চলে যান। ফলে একেবারে দলের ডেডিকেটেড কর্মী এবং প্রার্থীদের নিজস্ব লোকের বাইরে খুব বেশি ভোটারকে কেন্দ্রে আনা কঠিন। অনেকে ঝামেলা এড়ানোর জন্যও ভোট দিতে যান না। উপরন্তু মানুষ নানা কারণেই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। নিজের বাইরে সে খুব বেশি কিছু ভাবতে চায় না। ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার এটিও একটি কারণ।

তবে ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে যে কারণেই ভোটার উপস্থিতি কম হোক না কেন এবং নির্বাচনটি যত কম গুরুত্বপূর্ণই হোক না কেন, এই নির্বাচনের প্রধান ‘আকর্ষণ’ ছিলেন ‘হিরো আলম’। ভোটের দিন কিছু লোক তার ওপর হামলা করেন। শোনা যাচ্ছে, তিনি বেশ কিছু সমর্থকসহ কেন্দ্রের ভেতর ঢোকার চেষ্টা করেছিলেন। তার সঙ্গে অনেক ইউটিউবারও ছিলেন। যেখানে কেবল বৈধ কার্ডধারীদের ঢোকার অনুমতি ছিল। এ নিয়ে হয়তো তর্ক-বিতর্কের জেরে তার ওপর হামলা হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, হিরো আলম এবং তার অনুসারীরা যদি অবৈধভাবে কেন্দ্রে প্রবেশের চেষ্টা করেও থাকেন, তাহলে তাদের বাধা দেওয়ার এখতিয়ার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। কোনও প্রার্থীর বা দলের লোকজন তার ওপর হামলা করবেন কেন? অবশ্য এই ঘটনার পরে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেছেন, হিরো আলমের ওপর হামলাকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

প্রশ্ন হলো, হিরো আলমকে কারা মারলেন? আওয়ামী লীগের প্রার্থী জেতার জন্যই তাকে মেরেছেন নাকি সেখানে এমন কোনও পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যাতে তিনি আক্রমণের শিকার হয়েছেন? অর্থাৎ নৌকার প্রার্থীর জয়ের জন্য কি হিরো আলমের ওপর আক্রমণের কোনও প্রয়োজন ছিল? গণমাধ্যমের খবর বলছে, নৌকার ব্যাজধারী কিছু লোক তাকে মারধর করেছেন। যদিও নৌকার প্রার্থী মোহাম্মদ আরাফাতও এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। তাহলে হিরো আলমকে কারা মারলেন? তারা কি আরাফাতের শুভাকাঙ্ক্ষী নাকি তারা এরকম একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করলেন? এই ঘটনায় হিরো আলম এবং তার সঙ্গে থাকা লোকজনের ভূমিকা কী ছিল—এসব বিষয়ে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। কেননা, নানা কারণেই এই নির্বাচনে ভোট কম পড়েছে। যেহেতু মাঠের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি এই নির্বাচনে অংশ নেয়নি, ফলে স্বাভাবিক হিসেবেই এখানে নৌকার প্রার্থীর জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি ছিল। সেখানে একজন আলোচিত স্বতন্ত্র প্রার্থীর ওপর হামলা করতে হবে কেন? তাদের উদ্দেশ্য কী? এই মারধরের মধ্য দিয়ে তারা কাকে জেতাতে চাইলেন বা কাকে হারাতে চাইলেন?

অনেক শিক্ষিত ও গুরুত্বপূর্ণ মানুষও হিরো আলমকে ‘সাবঅল্টার্ন ইতিহাসের নির্মাতা’ বলে অভিহিত করেছেন। যে কারণে হিরো আলমের সমালোচনাকে অনেকে ‘বর্ণবাদী’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। প্রশ্ন হলো, হিরো আলমকে এভাবে মূল্যায়ন করাটা যৌক্তিক কিনা? তাছাড়া হিরো আলমকে যে শুধু তার সামাজিক অবস্থান, তার শিক্ষা কিংবা তার গায়ের রঙ দিয়ে বিচার করা হচ্ছে না—সেটিও বোঝা দরকার। কেননা, এর আগে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ, অর্থাৎ হিজড়া সম্প্রদায়ের মানুষও জনপ্রতিনিধি হয়েছেন। তাকে নিয়ে হিরো আলমের মতো কোনও সমালোচনা হয়নি। বরং মানুষ তার প্রশংসা করেছে। গণমাধ্যমে তাকে নিয়ে প্রতিবেদন হয়েছে। সমাজের একেবারে প্রান্তিক আরও অনেকে নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। মানুষ তারও প্রশংসা করেছে। কিন্তু তাদের সঙ্গে হিরো আলমের তুলনার কোনও সুযোগ আছে কিনা, সেটিও ভেবে দেখা দরকার।

হিরো আলম সারা দেশে পরিচিতি পেয়েছেন তার ভাঁড়ামির কারণে। তার ‘মানহীন’ ভিডিও কনটেন্টের কারণে। তার কনটেন্ট মানুষ যে খুব ভালোবেসে দেখে তাও নয়। মানুষ আসলে মজা নেয়। এই মজা নিতে গিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় আশরাফুল আলম এখন ‘হিরো আলম’। শুধু তাই নয়, তিনি রাজনীতিতেও নেমেছেন এবং সংসদ সদস্য হতে চান। ভোটাররা ভোট দিয়ে তাকে নির্বাচিত করলে সেটি আইনত বৈধ। কিন্তু যে কেউ চাইলেই সংসদ সদস্য হতে পারবে; এখানে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক মানের কোনও বাছবিচারের যে প্রয়োজন হয় না—এটি কি রাজনীতির জন্য কল্যাণকর? এটি কি দেশের রাজনীতি ও নির্বাচনি ব্যবস্থার এক ধরনের ব্যর্থতা নয়? কারা আইনপ্রণেতা হবেন বা হতে পারবেন, তার একটি মানদণ্ড কি থাকা উচিত নয়? এসব বিষয়ে প্রশ্ন করলেও অনেকে ভাবেন হিরো আলমের বিরোধিতা। হিরো আলমের বিরোধিতা মানেই তারা মনে করেন সরকারের দালালি। অথচ প্রশ্নগুলো অ্যাকাডেমিক। কিন্তু এখন অ্যাকাডেমিক প্রশ্ন করলেও সেগুলোর বিরোধিতা করা হচ্ছে মূলত সরকার ও সরকারি দলের নানা কর্মকাণ্ডের বিরোধিতার অংশ হিসেবে।

কোনও একটি দল দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে এমনিতেই জনগণের একটি বিরাট অংশের বিরাগভাজন হয়। অনেক ভালো কাজ করলেও সরকার এমন সব কাজও করে যাতে জনগণ নাখোশ হয়। বর্তমান সরকারের অনেক সাফল্য যেমন আছে, তেমনি নিশ্চয়ই তার সমালোচনারও অনেক জায়গা আছে। কিন্তু সেই অসন্তুষ্টি বা নাখোশের বদলা নিতে হবে হিরো আলমের কাঁধে বন্দুক রেখে? রাজনৈতিক বিরোধিতা রাজনীতির মধ্য দিয়েই হতে হয়। হিরো আলম কি সেই রাজনীতির মানুষ? তিনি কি রাজনীতির মানুষ হয়ে উঠতে পেরেছেন বা তিনি কি আদৌ সেটি চান, নাকি তিনি এসব ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে মূলত সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচিত হতে চান? তাকে নিয়ে রসিকতা করতে করতে তিনি যে এখন আন্তর্জাতিক ফিগারে পরিণত হলেন, এর দ্বারা কে লাভবান হচ্ছে? সাধারণ মানুষের মধ্যে রাজনীতি ও নির্বাচন সম্পর্কে কী বার্তা যাচ্ছে?

ভোটের হিসাবে ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনের মোহাম্মদ এ আরাফাত জিতেছেন। কিন্তু এখানে হিরো আলমেরও কিছু বিজয় হয়েছে। অর্থাৎ তিনি যা চেয়েছেন তা-ই পেয়েছেন। সম্ভবত তিনি নিজেও এটা বিশ্বাস করেন যে সংসদ সদস্য হওয়ার যোগ্যতা তার নেই। কিন্তু তারপরও মানুষ যেহেতু তাকে নিয়ে মজা নেয় এবং সেই মজা নেওয়ার ফলে তিনি এখন সেলিব্রিটি এবং তিনি সোশ্যাল মিডিয়ার জন্য কনটেন্ট তৈরি করে টাকা উপার্জন করতে পারছেন—সেই ধারাবাহিকতায় তিনি এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এখন আন্তর্জাতিক চরিত্র। তার ওপর হামলার নিন্দা জানিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জাতিসংঘ। এর মধ্য দিয়ে বিদেশে বাংলাদেশ সম্পর্কে কী বার্তা গেলো? বাংলাদেশের সরকার, রাজনীতি ও নির্বাচনি ব্যবস্থার কোনও লাভ না হলেও অন্তত হিরো আলমের লাভ হয়েছে। তিনি হয়তো আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তার জন্মস্থান বগুড়ার কোনও আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন এবং তখনও তিনি সোশ্যাল মিডিয়া তো বটেই, গণমাধ্যমেরও শিরোনাম হবেন।

লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন। 

/এসএএস/ওএমএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শোইগুর সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে পুতিনের?
শোইগুর সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে পুতিনের?
বাড্ডায় নারীর মরদেহ উদ্ধার
বাড্ডায় নারীর মরদেহ উদ্ধার
ম্যানসিটির ওপর চাপ ধরে রাখলো আর্সেনাল
ম্যানসিটির ওপর চাপ ধরে রাখলো আর্সেনাল
এবার এক লাফে স্বর্ণের ভরিতে বাড়লো ৬ হাজার টাকার বেশি
এবার এক লাফে স্বর্ণের ভরিতে বাড়লো ৬ হাজার টাকার বেশি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ