X
বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪
২৫ বৈশাখ ১৪৩১

তিব্বতে চীনের নবম বাঁধ, শুকিয়ে যাবে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা

সাজ্জাদুল ইসলাম নয়ন
১৯ আগস্ট ২০২৩, ২০:১০আপডেট : ১৯ আগস্ট ২০২৩, ২০:১৫

ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর একের পর এক বাঁধ নির্মাণ করে যাচ্ছে চীন। যা বাংলাদেশের সমগ্র পরিবেশ বিশেষ করে কৃষিকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে। ভারতের করা ফারাক্কা বাঁধের কারণে পদ্মা নদী শীর্ণকায় হয়ে গেছে। এবার চীনের কারণে মরতে বসছে আমাদের সবচেয়ে বড় নদটি।

আন্তঃসীমান্ত এবং শক্তিশালী নদী ব্রহ্মপুত্র বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন নামে পরিচিত। পথে এটি বিভিন্ন উপনদী দ্বারা যুক্ত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে এই নদীটি ভারতীয় উপমহাদেশের ভূ-রাজনীতির অন্যতম বিষয় হয়ে উঠেছে। 

বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে চীন আবারও তিব্বতের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখার (এলএসি) কাছাকাছি ইয়ারলুং-সাংপো নদীর (ভারতে ব্রহ্মপুত্র নামে পরিচিত) নিচের অংশে একটি ‘সুপার’ বাঁধ নির্মাণের কার্যক্রম শুরু করেছে। ভারত সীমান্তের কাছাকাছি চীনের মেগা প্রকল্প, ৬০ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতাসম্পন্ন এই বাঁধ বিশ্বের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ প্রকল্প।

এই বছরের জানুয়ারিতে, ভূ-স্থানীয় গোয়েন্দা গবেষক ড্যামিয়েন সাইমন, স্যাটেলাইট চিত্রের মাধ্যমে নিশ্চিত করেছেন যে এই ছোট বাঁধগুলোর মধ্যে একটি তিব্বতের মাবজা জাংবো (সাংপো) নদীতে ভারত-নেপালি-চীনা সীমান্ত ট্রাইজেকশনের মাত্র কয়েক কিলোমিটার উত্তরে নির্মিত হচ্ছে। এ বিষয়ে তার মন্তব্য, ‘যদিও কাঠামোটি সম্পূর্ণ না হয়, প্রকল্পটি এই অঞ্চলে জলের ওপর চীনের ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে উদ্বেগ বাড়াবে।’

মাঝে মাঝে, চীনের বাঁধ নির্মাণের কার্যকলাপের রিপোর্ট মিডিয়ায় বেরিয়ে আসে, কিন্তু চীন কখনই এই প্রকল্পগুলোর স্কেল এবং ভৌগোলিক ব্যাপ্তি স্পষ্ট করে না, সেগুলো রহস্যের মধ্যে আবৃত থাকে। এ বিষয়ে প্রখ্যাত ভূ-রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ ব্রহ্মা চেলানি বলেছেন, ‘চীন গোপনে বিশ্বের বৃহত্তম বাঁধ নির্মাণ চালিয়ে যেতে পারে না।’

এক প্রতিবেদনে তিনি বলেন, চীনের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত এই নদীটিতে আজ অবধি মোট নয়টি বাঁধ দেওয়া হয়েছে। রক্ষণশীল হিসাব অনুযায়ী, হিমালয়ের গ্লেসিয়ারগুলো থেকে যে তিব্বতে প্রবাহিত প্রধান নদীগুলো থেকে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য চীনের প্রায় ১০০টি বাঁধের পরিকল্পনা রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ব্রহ্মা চেলানির মতে, ‘চীন ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জল দখলে নিয়োজিত’। তিব্বত মালভূমি থেকে প্রবাহিত সমস্ত প্রধান নদীতে একাধিক বাঁধ নির্মাণ করছে দেশটি।

ব্রহ্মপুত্রের উৎপত্তি হিমালয় পর্বতমালার কৈলাস শৃঙ্গের জিমা ইয়ংজং হিমবাহে। এটি তিব্বতের পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত।   সাং পো নামে তিব্বতে পুর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে এটি অরুণাচল প্রদেশে ভারতে প্রবেশ করেছে। সেখানে এর নাম হয়ে যায় সিয়ং। তারপর আসামের ওপর দিয়ে দিহং নামে বয়ে যাবার সময় এতে দিবং এবং লোহিত নামে আরো দুটি বড় নদী যোগ দেয়। ভারতে প্রবেশের পরে ব্রহ্মপুত্রে চারটি বড় বাধ নির্মিত হয়েছে। এগুলো হলো– সুবানসিরি লোয়ার ড্যাম, রঙ্গনদী বাঁধ, রঙ্গিত বাঁধ এবং ভারতের ব্রহ্মপুত্র নদী ব্যবস্থার ওপর দিবাং বাঁধ। এই চারটি বাঁধ ছাড়াও নয়টি বড় সেতু নির্মাণ করেছে ভারত। এরপর থেকে সমতলে এসে চওড়া হয়ে এর নাম হয় ব্রহ্মপুত্র। তারপর এটি ময়মনসিংহ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে।

উৎপত্তিস্থল থেকে এর দৈর্ঘ্য ২৯০০ কিলোমিটার। ব্রহ্মপুত্রের প্রধান শাখা হচ্ছে যমুনা। এক কালের প্রশস্ত ব্রহ্মপুত্র নদ বর্তমানে ২০১১ কিলোমিটারে এসে ঠেকেছে। বিভিন্ন সূত্রমতে এশিয়ান পরাশক্তি ইতিমধ্যে ব্রহ্মপুত্র নদের নিম্নাঞ্চলে আটটি জলবিদ্যুৎ বাঁধ নির্মাণ করেছে। এখন আবার তিব্বতের লিনজাইতে অবস্থিত নদীর মোড়ে নবম বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। এতে উত্তর-পূর্ব ভারতে পানি সংকটের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবিদ ও সংশ্লিষ্ট মহল।

এই প্রকল্প সমন্ধে পাওয়ার কনস্ট্রাকশন করপোরেশন অব চায়না বা পাওয়ারচিনার চেয়ারম্যান ঘোষণা করেছিলেন, ‘প্রকল্পটি হবে চীনা জলবিদ্যুৎ শিল্পের জন্য একটি ঐতিহাসিক সুযোগ’। তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে বাঁধটি বার্ষিক ৩০০ বিলিয়ন  কিলোওয়াট ঘণ্টা (kWh)  পরিচ্ছন্ন, পুনর্নবীকরণযোগ্য এবং শূন্য-কার্বন বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে যা বেইজিংকে তার পরিচ্ছন্ন শক্তির লক্ষ্য পূরণে সাহায্য করবে। তবে সম্ভাবনা রয়েছে যে চীন দেশের ভেতরে কিছু অংশে পানির ঘাটতি প্রশমিত করতে নদীটিকে উত্তর দিকে ঘুরিয়ে দিতে পারে। যে কারণে ভারত ও বাংলাদেশের জন্য প্রভাব হবে ভয়াবহ পরিবেশগত বিপর্যয় বা জলপ্রবাহ হ্রাস। এ কারণে শুকিয়ে যেতে পারে বাংলাদেশের ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, আগের কয়েকটি বাঁধের কাজ চলছে এবং বাকিগুলোর কাজও চলমান রয়েছে। তাই এই বিশাল নদীর ওপর নির্মিত বাঁধ বাংলাদেশের জন্য বিপর্যয়কর হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ, বাংলাদেশের যখন পানির প্রয়োজন নেই- তখন এই নদী দিয়ে অতিরিক্ত পানি প্রবাহিত হতে পারে। এবং যখন জলের প্রয়োজন হয়, তখন এটি শুকনো থাকতে পারে। ফলস্বরূপ, বাংলাদেশ বন্যা এবং খরা প্রবণ হতে পারে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশের একজন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ বলেছেন, অভিন্ন আন্তর্জাতিক নদীর প্রবাহ পরিবর্তন করতে পারে এমন কোনও কাঠামো তৈরির আগে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা করার নিয়ম থাকালেও চীন এক্ষেত্রে তা করেনি। তিনি  আরও বলেন, ভারত ও চীনের মধ্যে একটি ন্যায্য জলবণ্টন চুক্তির অনুপস্থিতি এশিয়ার দুই পরাশক্তির মধ্যে নতুন দ্বন্দ্বের ইন্ধন জোগাবে। আর সেই চুক্তিতে বাংলাদেশের অংশ নিশ্চিত না হলে ফারাক্কা ও তিস্তা বাঁধের মতো বড় ধরনের পানি বঞ্চিত হবে দেশটি।

দক্ষিণ এশিয়ায়, বাংলাদেশ বৃহত্তম নদীমাতৃক দেশ এবং অর্থনীতি সহ সকল ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক নদীর ওপর অত্যন্ত নির্ভরশীল। এদেশের নদীমাতৃক মানুষ তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্যও সম্পূর্ণভাবে নদীর ওপর নির্ভরশীল। এর মধ্যে ব্রহ্মপুত্র নদ অন্যতম। তিব্বতে এই নদীর বাঁধ ভারত ও বাংলাদেশ উভয়ের জন্যই উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাঁধের কারণে শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ কমে যেতে পারে, যা এখানকার মানুষের জীবন ও জীববৈচিত্র্যে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারে।

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ডেইলি মিরর জানিয়েছে, চীনের এসব জলবিদ্যুৎ বাঁধ নিয়ে উদ্বিগ্ন বাংলাদেশ। এটি একটি সমবায় ইস্যু না হয়ে বিতর্কের বিষয় হয়ে উঠছে। ডেইলি মিরর আরও জানিয়েছে যে নদটি তিনটি দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হলেও বাংলাদেশ, ভারত এবং চীনের মধ্যে কোনও জলবণ্টন চুক্তি নেই। বিশেষজ্ঞরা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে কোনও পরামর্শ ছাড়াই ব্রহ্মপুত্রে চীনের বাঁধ নির্মাণ দেশের জন্য বিপর্যয়কর এবং জীববৈচিত্র্যের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।

জানা যায়, বাংলাদেশে শুষ্ক মৌসুমে পাওয়া পানির ৬০ শতাংশ আসে ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে। জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য জংবো নদীর পানি প্রত্যাহার করা হলে ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশেও তীব্র পানি সংকট দেখা দিতে পারে। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক নদী প্রবাহ নিয়ন্ত্রণকে ভূ-রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে দুর্বল ও নিম্নধারার দেশগুলোকে খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে ফেলতে পারে, ভারত-বাংলাদেশের পানি রাজনীতির তিক্ত অভিজ্ঞতা তার প্রমাণ।

লেখক: সাংবাদিক

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত উৎসব শুরু আজ থেকে
জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত উৎসব শুরু আজ থেকে
আজিজ মোহাম্মদসহ ৯ জনের মৃত্যুদণ্ড চায় রাষ্ট্রপক্ষ, খালাসের দাবি আসামিপক্ষের
চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যাআজিজ মোহাম্মদসহ ৯ জনের মৃত্যুদণ্ড চায় রাষ্ট্রপক্ষ, খালাসের দাবি আসামিপক্ষের
প্রথম জেলা শাখা হিসেবে নোয়াখালীতে উন্মুক্ত লাইব্রেরির যাত্রা শুরু
প্রথম জেলা শাখা হিসেবে নোয়াখালীতে উন্মুক্ত লাইব্রেরির যাত্রা শুরু
ফ্রিজের আয়ু বাড়বে এই ৫ টিপস মানলে
ফ্রিজের আয়ু বাড়বে এই ৫ টিপস মানলে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ