X
মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪
৩০ বৈশাখ ১৪৩১

কাজী শাহেদ আহমেদ: বনস্পতির ছায়া দিলেন সারা জীবন

অঞ্জন রায়
২৯ আগস্ট ২০২৩, ১৫:৫৫আপডেট : ২৯ আগস্ট ২০২৩, ২০:৩৭

সন্ধ্যায় ফোনটা এলো। জানলাম কাজী শাহেদ আহমেদের প্রস্থানের কথা। কতদিন, কতদিন পর চোখ থেকে পানি ঝরলো জানি না। এখনও স্মৃতির মন্তাজ- জিগাতলা বাসস্ট্যান্ড, আমাদের অফিস, সাদা ধবধবে পোশাকে আসছেন কাজী শাহেদ আহমেদ। আমরা অতি নবীন হলেও তার কাছে গুরুত্ব পাচ্ছি, শুনছেন– পরামর্শ করছেন। এমনকি লড়ছেনও একইসঙ্গে। আদরে আগলে রাখছেন, করেছেন শাসনও।

১৯৯৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। কয়েক দিন আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে এসে রিপোর্ট লিখলাম–‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের সশস্ত্র প্রস্তুতি, গানপাউডার জোগান দিচ্ছেন এক শিক্ষক।’ রিপোর্ট প্রকাশ হলো ‘লিড নিউজ’ হিসাবে। সকাল থেকেই একের পর এক ফোনে চলছে হুমকি। আমরা বুঝেছিলাম মৌচাকে আঘাত করেছে রিপোর্ট, চলবে হুমকি। বিকালে হঠাৎ হামলা হলো আজকের কাগজের জিগাতলা অফিসে। বোমা-গুলি চললো কয়েক মিনিট। আমি বাইরে ছিলাম। অফিসের গেটে রিকশা থেকে নামতেই আমাকে টেনে সোজা দোতলায় নিয়ে গেলেন শহীদুজ্জামান ভাই। বললেন, খবরদার নিচে নামবে না। বসে আছি, সদ্য জেলা প্রতিনিধির দায়িত্ব ছেড়ে সমর দা’র অনুরোধে কাজের সুযোগ পেয়েছি। ভাবছিলাম–আমার রিপোর্ট নিয়ে এত ঝামেলা। আর বোধহয় কাজ করা হলো না।

এমন সময়েই প্রকাশক ও সম্পাদক কাজী শাহেদ আহমেদ এলেন অফিসে। সেই সফেদ পোশাক, হাতে একটা ছড়ি। বললেন– অঞ্জনকে ডাকো। বাদলদা এলেন, স্যার তোমাকে ডাকছে জানাতেই প্রচণ্ড শঙ্কা নিয়ে তার সামনে গেলাম। তাঁর প্রথম প্রশ্ন, ‘ভয় পেয়েছো?’ বললাম–‘না’।

তিনি বললেন– ‘আরও লিখবে’। সাহসের পারদ চড়লো আমার। বার্তা সম্পাদক রেজা আরেফিন ভাই বললেন– এখনই ফোন করে বিশিষ্টজনদের প্রতিক্রিয়া নাও, স্টোরি করো। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, কবি শামসুর রাহমান, ড. আহমেদ শরীফ, অধ্যাপক নীলিমা ইব্রাহীমসহ অনেকের প্রতিক্রিয়া নিয়ে স্টোরি রেডি করে রেজা ভাইকে দিলাম। কপির ওপর থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক লেখাটি কেটে দিয়ে রেজা ভাই কপিটা আমাকে দিলেন। ভাবলাম কিছু একটা ভুল করেছি লেখায়। তাকালাম তার দিকে, রেজা ভাই বললেন–‘নিজের নাম লেখ’। লিখলাম।

রাত গভীর হচ্ছে, সবাই চলে যাচ্ছেন। ঠিক তখনই আমাকে আবু বকর সিদ্দিকী ভাই জানালেন– সম্পাদক কাজী শাহেদ আহমেদ বলে দিয়েছেন, আমাকে কয়েক দিন অফিসেই থাকতে। মাঝরাতে অফিসের ফোনে পাবনা থেকে মা ফোন দিলেন, বাপীও কথা বললেন।

তারা জানালেন সম্পাদক কাজী শাহেদ আহমেদ ফোন করে বাপীকে বলেছেন– ‘ছেলেটাকে আমি নিয়ে নিলাম। আপনারা চিন্তা করবেন না। ওর কোনও ক্ষতি হতে দেবো না’।

অবাক হলাম। মাত্র এক সপ্তাহ কাজ করছি– সেই আমার প্রতি সম্পাদকের অতটা মমত্ব? হ্যাঁ, এই মমত্ব ছিল বলেই তিনি কাজী শাহেদ আহমেদ। যার কাছে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের ঋণ থাকবে আরও অনেক অনেক বছর।

এরপর শুরু হলো মামলা, কাজী শাহেদ আহমেদ, শহীদুজ্জামান ভাই, কার্টুনিস্ট দুলাল চন্দ্র গাইনের নামে সারা দেশে জামায়েতের প্রায় ২০টা মামলা। জেলা থেকে জেলায় হাজিরা। শেষে আমরা গেলাম হাইকোর্টে। জামিন হলো। সংসদে সেই সময়ে বিরোধীদল আওয়ামী লীগ, সেখানেও উঠলো ঝড়।

এত মামলার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করে দেওয়া হলো সরকারি বিজ্ঞাপন। অর্থাৎ যেকোনোভাবে আজকের কাগজ বন্ধ করে দেওয়ার জন্য রাষ্ট্র নিজেই তৎপর হলো। আমরা তখন দেখেছি–শুধুমাত্র পাঠকের শক্তিতে কীভাবে একটা কাগজ চলতে পারে। আর একজন কর্মী ছাঁটাই না করেও প্রকাশক সম্পাদক কীভাবে বছর ধরে ভর্তুকি দিতে পারেন হাসিমুখে।

একদিকে যখন কাগজের বিজ্ঞাপন বন্ধ, অন্যদিকে তখন কাগজের নতুন পৃষ্ঠা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলেন সম্পাদক কাজী শাহেদ আহমেদ। আজকের কাগজ তখন হয়ে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করা যোদ্ধা। লিখছেন দেশের শ্রেষ্ঠ মানুষগুলো। একই সাথে আমাদের সাপ্তাহিক খবরের কাগজেও একের পরে এক বিস্ফোরণ ঘটছে লেখার। দৈনিকে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ বইটি ধারাবাহিকভাবে লিখছেন প্রয়াত ড. এমএ ওয়াজেদ মিয়া। সাহিত্য পাতায় ড. হুমায়ুন আজাদের ধারাবাহিক উপন্যাস–‘ছাপান্নোহাজার বর্গমাইল’ ছাপা হচ্ছে। লিখছেন– ড. আহমদ শরীফ, অধ্যাপক নীলিমা ইব্রাহীমসহ অজস্র মান্য লেখক। সাপ্তাহিক কাগজে নিয়মিত কলাম লিখছেন তসলিমা নাসরিন, অজয় রায়, কে এম সোবহান। পাকিস্তানের জন্ম ও মৃত্যু দর্শন লিখছেন অধ্যাপক যতীন সরকার। সে এক আগুন সময়। বয়োজ্যেষ্ঠ থেকে তরুণ– সবার লেখায় সমৃদ্ধ আজকের কাগজ।

এই সময়েই সম্পাদক কাজী শাহেদ আহমেদের সাথে আরও একবার এক অসামান্য স্মৃতির সম্পদ জমে যায় আমার জন্য। সেই সময়ে সারের দাবিতে পুলিশের গুলিতে খুন হয়েছে কৃষকেরা। যারা আমাদের অন্নদাতা তারা অন্ন জোগাতে খুন হচ্ছেন রাষ্ট্রের বুলেটে। প্রচণ্ড দগ্ধ সময়। অনেকটা নিজের তাগিদেই অ্যাসাইনমেন্ট চেয়ে নিয়ে সাপ্তাহিক কাগজে কাভার স্টোরি লিখলাম–‘আসছে নবান্ন হবে রক্তে ধোয়া ধানে।’ মনে আছে লেখাটা সেই সময় ফটোকপি হয়ে হাতে বিলি হয়েছিল সারা দেশে। লেখাটা ছাপার এক বা দুদিন পর সম্পাদক কাজী শাহেদ আহমেদ আবারও আমাকে ডাকলেন।

অসম্ভব স্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। বকর ভাইকে বললেন– বকর, অঞ্জনকে একটা পৃষ্ঠা দিয়ে দাও। ও কলাম লিখুক। শুরু হলো আমার নিয়মিত লেখা ‘মানচিত্রের মানুষ’। লিখেছি অনেক দিন।

এরপর সময়ের রথে চেপে অনেকটা পথচলা। কিন্তু এই আমার পথচলার একমাত্র, হ্যাঁ আবারও বলছি একমাত্র সত্যিকারের আশ্রয়দাতা ছিলেন আমার জীবনের প্রথম প্রকাশক ও সম্পাদক কাজী শাহেদ আহমেদ। তিনি আমার জীবনের সেই আশ্রয় বনস্পতি–যার ছায়াতে প্রথম নিজেকে চিনতে পেরেছি। আজ নামের আগে গণমাধ্যমকর্মী লিখতে পারছি। তার এই প্রস্থান আমার কাছেও আরেক দফা নিজেকে একা করে দেওয়া। ২৮ আগস্ট সন্ধ্যার পর সেই বৃক্ষটির ছায়া হারালাম, যার কাছে সামান্য আমি নই– বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম ঋণী থাকবে। অনেক সম্পাদক ও প্রকাশক আছেন, থাকবেন, হবেন। কিন্তু আরেকজন কাজী শাহেদ আহমেদ বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে আর কখনোই আসবেন না।

লেখক: সাবেক স্টাফ রিপোর্টার, আজকের কাগজ।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় বিএনপি নেতাকে শোকজ
নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় বিএনপি নেতাকে শোকজ
শিক্ষার্থীকে মারধর করে শিক্ষক বললেন, ‘শাসন করেছি’
শিক্ষার্থীকে মারধর করে শিক্ষক বললেন, ‘শাসন করেছি’
বিমানবন্দর ও টঙ্গী থেকে ৭ ছিনতাইকারী গ্রেফতার
বিমানবন্দর ও টঙ্গী থেকে ৭ ছিনতাইকারী গ্রেফতার
রংপুরের চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে অভিযোগ
রংপুরের চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে অভিযোগ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ