X
সোমবার, ২০ মে ২০২৪
৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

কেন ছাত্র রাজনীতি আর আশা জাগায় না?

এম আর ইসলাম
১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ২১:০৫আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৮:২৪

বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের যে রাজনৈতিক পরিক্রমা, তাতে সব থেকে বেশি অবদান বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের। তরুণ শিক্ষার্থীরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে শুধু দেশমাতৃকার জন্য আত্মাহুতি দিতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। ১৯৪৭-এর দেশ ভাগ, ১৯৪৮ থেকে সূচনা হওয়া যে ভাষা আন্দোলন, একই সময়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ গঠন, ১৯৪৯-এ বাংলাদেশ আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন, ১৯৫২-এ চূড়ান্ত ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪-এ যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে, পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬-এর ছয় দফা, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানসহ মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের ছাত্রদের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে ছাত্র আন্দোলন অস্ত্রবাজি, চাঁদাবাজি, দখলদারিত্বের দিকে ঝুঁকতে থাকে।

পরে ৮০ দশকের দিকে ছাত্ররাজনীতি চূড়ান্ত অবনতির দিকে চলে যায়। সামরিক সরকারগুলো তাদের অবস্থান মজবুত করতে সব থেকে বেশি ব্যবহার করেছে তাদের পোষ্য ছাত্র সংগঠনগুলোকে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো দখল করতে গিয়ে পেশিশক্তির ব্যবহারের যে সূত্রপাত তা খুন, ধর্ষণ, রাহাজানি, জমি দখল বা ভাড়াটিয়া বাহিনী হিসেবে ব্যবহৃত হতে হতে অসংখ্য অপরাধে জড়িয়ে গেছে ছাত্র সংগঠনগুলো। কিন্তু ১৯৯০-এর স্বৈরাচার পতনের যে আন্দোলন তাতে ছাত্র আন্দোলন সব থেকে বড় ভূমিকা রেখেছিল, তা ভুলে গেলে চলবে না। কিন্তু আফসোস, ৯০-এর পরবর্তী দশক থেকে ছাত্র রাজনীতি তার সেই আগের ঐতিহ্যবাহী আর ধরে রাখতে পারেনি! ছাত্র রাজনীতির যে বিপ্লবী ভূমিকা পরাধীন ও স্বাধীন বাংলাদেশ দেখেছে, তা নতুন প্রজন্মের কাছে আজ খানিকটা রূপকথার মতো শোনাবে।

ছাত্র রাজনীতি আজ শুধু ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বিরোধী দলগুলোর ছাত্র সংগঠনগুলোর তেমন একটা কার্যক্রম বর্তমানে পরিলক্ষিত হয় না। ছাত্র রাজনীতির অন্যতম ক্ষেত্র ছিল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। কিন্তু এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আজ ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠন দ্বারা একচ্ছত্রভাবে দখলকৃত। নেই প্রতিযোগিতামূলক ইতিবাচক আর সহনশীল রাজনীতির চর্চা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র সংগঠনগুলোর কোনও নির্বাচন হয় না। সেখানে অবকাঠামো উন্নয়নের বাজেটে ভাগ বসানো, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদা নেওয়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ বাণিজ্যের সুবিধা ভোগসহ এহেন কাজ নেই যেখানে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনগুলো করে না। এমনকি, ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনগুলোর বাম্পার ফলন এখন প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত বিস্তৃত। এমনকি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এহেন সর্বগ্রাসী ছোবল থেকে মুক্তি পায়নি। সরকারের পদস্থ দায়িত্বশীলদের মধ্য থেকে কাউকে কাউকে এর পক্ষে সাফাই গাইতেও দেখা গেছে। কিন্তু সাধারণ ছাত্রদের স্বার্থ সংরক্ষণে বৃহৎ ছাত্র সংগঠনের ভূমিকা এখন আর দেখা যায় না। ছাত্র রাজনীতির দোহাই দিয়ে যখন কোনও ছাত্রনেতা হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করার দুঃসাহস দেখায়, বা দামি ফ্ল্যাট আর গাড়িতে চড়ে ঘুরে বেড়ায়, তখন আর এই ছাত্র সংগঠনগুলো নিয়ে জাতীয় স্বার্থে উচ্ছ্বসিত হওয়ার কারণ থাকে না।    
বাংলাদেশে ছাত্র সংগঠন থাকার আর একটা সর্বজনীন ক্ষতির দিকে আলোকপাত করাই এই লেখার মূল উদ্দেশ্য। ছাত্র রাজনীতি অনেক মেধাবীদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে, দেশের বেকার বাড়ায় অথবা অনেক ক্ষেত্রেই অপরাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি করে। ছাত্ররা যখন তারুণ্যের শক্তিতে টগবগ করে, মস্তিষ্ক তখন একইভাবে চলতে নাও পারে। তাই তারুণ্যের শক্তিকে ভুল পথে পরিচালিত করার মতো নেতিবাচক রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাব নেই এ দেশে। নিজেদের সন্তানদের বিদেশে পাঠিয়ে, অন্যের সন্তান দিয়ে রাজনীতি করা এ দেশের এক পুরোনো সংস্কৃতি। চতুর আর বর্ষীয়ান রাজনীতিকরা তাদের চারপাশে তরুণ আর নবীন ছাত্রনেতাদের সাথে রেখে নিজেদের দাপট আর প্রভাব বিস্তার করে চলে। অন্যদিকে অনেক মেধাবী তরুণ পেশিশক্তির মোহে, নিজেদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জলাঞ্জলি দেয়। ছাত্র সংগঠন থেকে যুব সংগঠন, তারপর মূল সংগঠন করতে গিয়ে এরা হারিয়ে ফেলে জীবনের সোনালি সময়। যে সময়ে নিজেরা সুশিক্ষিত হয়ে দেশের সম্পদ হবার কথা ছিল, সেসময়ে অতিমাত্রায় পলিটিক্স করতে গিয়ে কোনও সম্মানজনক পেশাতে যাওয়ার সুযোগ আর এদের হয় না। অনেক স্বার্থান্বেষী রাজনীতিকদের সহচার্যে থেকে থেকে, অপরাজনীতির অন্ধগলিতে এরা যে কখন বিচরণ করে বসে, তা এরা নিজেরাই বুঝতে পারে না। এভাবে এরা একসময় হয়ে ওঠে ফুলটাইম পলিটিশিয়ান।

ফুলটাইম পলিটিক্স করে দেশ বা সমাজের কি লাভ হয় সেটা গবেষণার বিষয় বৈকি! কিন্তু, বর্তমানের প্রেক্ষাপটে, তা খুব একটা আলোকিত পেশা নয়, তা বলা বাহুল্য। অর্থ আর বৈভব তৈরি করতে গিয়ে, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, পদ-বাণিজ্য, নিয়োগ-বাণিজ্য, উন্নয়ন বরাদ্দের কমিশনসহ যাবতীয় অনৈতিক কাজে ছন্দ খুঁজে পায়। রাজনীতি তাদের কাছে তখন হয়ে ওঠে সবচেয়ে বেশি লাভজনক ব্যবসা।  

এ দেশে ছাত্র সংগঠন করতে গিয়ে, যাদের কোনও পেশাগত ক্যারিয়ার হয়নি, তারা তাদের জীবন জীবিকার জন্য এই মূলধারার রাজনীতির ওপরই নির্ভর করে থাকে। তাই তো জনকল্যাণের রাজনীতির চেয়ে, এ দেশে ক্ষমতায় যাওয়ার রাজনীতিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। জীবনের যাবতীয় লস এরা তুলে নিতে চায় রাষ্ট্রক্ষমতায় উপনীত হয়ে। জনস্বার্থের জন্য রাষ্ট্রীয় বরাদ্দগুলোর মধ্যে ভাগ বসাতে এদের হাত কাঁপে না। ক্ষমতায় না যেতে পারলে, এরা নিজেদের বেকার মনে করে। অন্যদিকে ক্ষমতায় বসলে, যেন হাতের মুঠোয় চলে আসে সোনার হরিণ। তাইতো, জনগণের স্বার্থে এ দেশে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয় না। কীভাবে নির্বাচন হলে ক্ষমতা ধরে রাখা যাবে, অথবা ক্ষমতায় যাওয়া যাবে, এটাই থাকে মূল উপজীব্য। ক্ষমতার পালাবদল এ দেশে রাজনৈতিক সুবিধাবাদীদের স্বার্থের রদবদল মাত্র। জনগণের ইচ্ছা বা জনস্বার্থ এখানে মূল্যহীন।      

ঋষি সুনাক (যুক্তরাজ্য), জাস্টিন ট্রুডো (কানাডা), জেসিন্ডা আরডার্ন (নিউজিল্যান্ড), ইমানুয়েল ম্যাক্রো (ফ্রান্স)-এর মতো তরুণ রাজনীতিকদের উন্নত রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে যেতে মূলধারার রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর লেজুড়ভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি করে অসময়ে রাজনীতির ময়দান কাঁপাতে হয়নি। বরং, নিজেদের যথেষ্ট শিক্ষিত ও যোগ্য করে তারা রাজনীতির ক্ষেত্রে বিচরণ করে আজ সার্থক।

অথচ এ দেশে সরকারি চাকরি করা রাষ্ট্রের কর্মচারীরাও নিজেদের ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের প্রাক্তন কর্মী বা নেতা হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। যৌক্তিক বোধশূন্য এরা। যে প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন জনস্বার্থের রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, রাজনৈতিক পদ পদবি নিয়ে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত বা বুর্জোয়া রাজনীতিতে মত্ত, সেই রাজনীতি নিয়ে কতখানি আশ্বস্ত হওয়া সম্ভব?  

লেখক: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ডাটাবেজ প্রজেক্টের নামে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ নিষ্পত্তির নির্দেশ
ডাটাবেজ প্রজেক্টের নামে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ নিষ্পত্তির নির্দেশ
১৪ দলের বৈঠক ডেকেছেন শেখ হাসিনা, কী থাকবে এজেন্ডায়?
১৪ দলের বৈঠক ডেকেছেন শেখ হাসিনা, কী থাকবে এজেন্ডায়?
রংপুর মেডিক্যাল ও নরসিংদীর পাঁচদোনা ভূমি অফিসে দুদকের অভিযান
রংপুর মেডিক্যাল ও নরসিংদীর পাঁচদোনা ভূমি অফিসে দুদকের অভিযান
কাঁচা আম খেলে মিলবে এই ১০ উপকারিতা
কাঁচা আম খেলে মিলবে এই ১০ উপকারিতা
সর্বশেষসর্বাধিক