X
বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪
১৯ বৈশাখ ১৪৩১

মত প্রকাশের মার্কিন স্টাইল!

প্রভাষ আমিন
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৭:১০আপডেট : ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৭:১০

বাংলাদেশের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নতুন ভিসানীতির ঘোষণা দেয় মে মাসে। তার ঠিক চার মাস পর সেপ্টেম্বরে সেই ভিসানীতি প্রয়োগের ঘোষণা দেয়। এই ভিসানীতি নিয়ে এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে তোলপাড় চলছে। এই তোলপাড়ের মধ্যে নতুন টুইস্ট এনেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত ব্যক্তিদের মার্কিন ভিসা দেওয়া হবে না, এটাই নতুন ভিসানীতির মূল কথা। ভিসানীতি ঘোষণার সময় বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা, সরকার সমর্থক এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা এই ভিসানীতির আওতায় পড়বেন। ভিসানীতি প্রয়োগের সময়ও কারা এর আওতায় পড়বেন, তা পুনরায় উল্লেখ করা হয়।

২৪ মে প্রথমে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন টুইট করে তাদের নতুন ভিসানীতির কথা জানান। পরে এ বিষয়ে বিস্তারিত বিবৃতি মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। তবে ভিসানীতির ব্যাপারে বিস্তারিত জানিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার। ভিসানীতি প্রয়োগের ঘোষণাও দিয়েছেন ম্যাথু মিলার। কিন্তু ভিসানীতি প্রয়োগের ঘোষণার দুদিন পর ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বাংলাদেশের একটি টিভি টকশোতে গিয়ে জানালেন, গণমাধ্যমও ভিসানীতির আওতায় পড়বে। ব্লিঙ্কেনের টুইট, মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের বিবৃতি, ম্যাথু মিলারের বিবৃতি ও ব্রিফিং, কোথাও ভিসানীতিতে গণমাধ্যমের অন্তর্ভুক্তির কথা নেই। পিটার হাস কোন যুক্তিতে গণমাধ্যমকেও ভিসানীতির আওতাভুক্ত করলেন তার কোনও ব্যাখ্যা নেই।

এখন আমরা কি ব্লিঙ্কেনের কথা বিশ্বাস করবো, ম্যাথু মিলারের কথা বিশ্বাস করবো, নাকি পিটার হাসের কথা বিশ্বাস করবো?

পিটার হাসের বক্তব্য শুনে আমার একটা কথাই মনে হয়েছে, ‘সূর্যের চেয়ে বালি গরম’। তবে তার এই অতি উৎসাহের দায় আমাদের, মানে সবার। দিনের পর দিন বাড়তি গুরুত্ব দিয়ে দিয়ে আমরা মার্কিন রাষ্ট্রদূতদের ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বানিয়েছি। এখন সেই ফ্রাঙ্কেনস্টাইন গিলে খেতে বসেছে আমাদের রাজনীতি, গণমাধ্যম, সবকিছু। পিটার হাস এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে ব্যস্ত মানুষদের একজন। তিনি নানান জায়গায় ছুটে যাচ্ছেন। রাজনীতিবিদ এবং সুশীল সমাজ তার বাসায় ছুটে যাচ্ছে। তবে শুধু পিটার হাস নন, বরাবরই বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূতরা বাড়তি গুরুত্ব পেয়ে থাকেন। অগণতান্ত্রিক ১/১১ সরকারকে এনেছিলেন তখনকার মার্কিন রাষ্ট্রদূতসহ অন্য কূটনীতিকরা। মার্কিন রাষ্ট্রদূতই যেন বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন। বিশ্বের আর কোনও দেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত এমন ভিআইপি মর্যাদা পান না।

গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে এমন ব্যক্তিদের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের ভিসানীতি ঘোষণা ও প্রয়োগ করেছে। সে কারণেই নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদেরই এর আওতায় আনা হয়েছে। একটি দেশের গণমাধ্যম কোনোভাবেই নির্বাচনি প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। সেটা শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের কোথাও গণমাধ্যম নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে না। বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে, অনেক চ্যালেঞ্জ আছে, কিন্তু গণমাধ্যম কোথাও নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন সৃষ্টি করেছে, এমন অভিযোগ কেউ কখনও করেনি। অনেক সমস্যা, অনেক চ্যালেঞ্জ, অনেক ভীতি, অনেক সেলফ সেন্সরশিপ সত্ত্বেও বাংলাদেশের গণমাধ্যম তার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। ২০১৪ বা ২০১৮ সালের নির্বাচনের যত অনিয়ম, যত বিচ্যুতি, সবই গণমাধ্যম তুলে ধরেছে।

সাম্প্রতিক বিভিন্ন স্থানীয় সরকার ও উপনির্বাচনের চিত্রও দেশবাসী জেনেছে গণমাধ্যম থেকেই। ঢাকায় হিরো আলমের ওপর হামলা বা বরিশালে চরমোনাই পীরের ওপর হামলার ছবিও দেশবাসী দেখেছেন গণমাধ্যম থেকেই। নানামুখী চাপ সত্ত্বেও সরকারের নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, টাকা পাচারের তথ্য তুলে ধরে গণমাধ্যমই। বিরোধী দলের মত প্রকাশের সবচেয়ে বড় জানালা টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর প্রতিদিনকার টকশো। বাংলাদেশের গণমাধ্যম নির্বাচনি প্রক্রিয়ার প্রতিবন্ধক তো নয়ই, বরং সহায়ক। সেখানে পিটার হাস আগ বাড়িয়ে গণমাধ্যমও ভিসানীতির আওতায় আসতে পারে বলে বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে এক ধরনের হুমকি দিলেন।

বাংলাদেশের গণমাধ্যম নিজস্ব এথিক্স এবং দেশের প্রচলিত আইনের আওতায় পেশাদারিত্বের সঙ্গে পরিচালিত হচ্ছে। কোনও আইন মত প্রকাশের স্বাধীনতার পথে বাধা হলে সাংবাদিকরাই সবচেয়ে সোচ্চার কণ্ঠে প্রতিবাদ করেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের শুরু থেকেই সাংবাদিকরা প্রতিবাদ করেছেন। এমনকি এখন যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করে সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট করা হচ্ছে, তার বিভিন্ন ধারা নিয়েও সাংবাদিকরা তাদের শঙ্কার কথা বলে আসছেন।

নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় যারা বাধা সৃষ্টি করবে তাদের জন্যই ভিসানীতি। আর এই নীতি ঘোষণার সময় সুস্পষ্টভাবে বাধা সৃষ্টির ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। ভোট কারচুপি, ভোটারদের ভয় দেখানো, জনগণকে সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার চর্চাকে সহিংসতার মাধ্যমে বাধাদানকে নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় বাধা দেওয়া বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর কোনোটাই গণমাধ্যমের পক্ষে করা সম্ভব নয়, কখনও করেওনি।

পিটার হাস কোন বিবেচনায় গণমাধ্যমও ভিসানীতির অন্তর্ভুক্ত হতে পারে বলেছেন, তার কোনও ব্যাখ্যা নেই। তবে আমি মনে করি, এটা সুস্পষ্টভাবে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের প্রতি হুমকি। বাংলাদেশের গণমাধ্যম ভয়ের ঊর্ধ্বে উঠে দায়িত্ব পালন করছে, এমনটি নয়। তবে তাদের কিছু নিয়ম-নীতি আছে। সাংবাদিকদের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ থাকতেই পারে। কিন্তু বাংলাদেশের কোনও গণমাধ্যমই ঘোষণা দিয়ে কোনও রাজনৈতিক দলের পক্ষে অবস্থান নেয় না। অথচ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে মার্কিন গণমাধ্যম ঘোষণা দিয়ে একটি দলের পক্ষে অবস্থান নেয়। বাংলাদেশের গণমাধ্যম এতটা অপেশাদার এখনও হয়ে উঠতে পারেনি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সবসময় মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলে। কিন্তু পিটার হাসের বক্তব্য সরাসরি মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিপক্ষে। ভিসানীতির ভয়ে যদি বাংলাদেশের গণমাধ্যম আরও সংকুচিত হয়ে যায়, তাহলে কি পিটার হাস খুশি হবেন? নাকি আসলে সেটাই তারা চাইছেন? বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার মানদণ্ড কি মার্কিন রাষ্ট্রদূত ঠিক করে দেবেন? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো আগামী নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের গণমাধ্যম যদি ঘোষণা দিয়ে আওয়ামী লীগ বা বিএনপির পক্ষে অবস্থান নেয়, তাহলে কি সন্তুষ্ট হবেন পিটার হাস?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কাকে ভিসা দেবে না বা দেবে সেটা তাদের ব্যাপার। কিন্তু বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে ভয় দেখানো আর মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলা স্পষ্ট স্ববিরোধিতা। মার্কিন ভিসা পাওয়ার জন্য কি বাংলাদেশের সাংবাদিকদের তাদের মনমতো নিউজ করতে হবে? আমাদের কি তবে মত প্রকাশের ‘মার্কিন স্টাইল’ ফলো করতে হবে?

পিটার হাসের বক্তব্যের দুদিন পর মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলারের নিয়মিত ব্রিফিংয়েও প্রসঙ্গটি উঠেছিল। ম্যাথু মিলার স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন, বাংলাদেশের গণমাধ্যম ভিসানীতির আওতাভুক্ত নয়। পিটার হাসের বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছেন বাংলাদেশের গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বরা। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচিত তাকে ডেকে এর ব্যাখ্যা দাবি করা। তারচেয়ে বড় কথা, মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরেরই উচিত ভিসানীতি নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির দায়ে পিটার হাসের কাছে জবাবদিহি চাওয়া। বিভিন্ন বক্তব্যে পিটার হাস এরইমধ্যে বাংলাদেশে একটি দলের প্রতি তার পক্ষপাতিত্ব প্রমাণ করেছেন। বাংলাদেশের নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় গণমাধ্যম নয়, পিটার হাসই বড় বাধা। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের উচিত, আগ বাড়িয়ে কথা বলে বিভ্রান্তি সৃষ্টির দায়ে পিটার হাসকে প্রত্যাহার করা। নইলে বাংলাদেশে নির্বাচনি প্রক্রিয়া পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে থাকবে।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
তিন মামলায় মিল্টনের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
তিন মামলায় মিল্টনের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
ভারতের ভোটে বিজেপির পক্ষে কি ‘৪০০ পেরোনো’ আদৌ সম্ভব?  
ভারতের ভোটে বিজেপির পক্ষে কি ‘৪০০ পেরোনো’ আদৌ সম্ভব?  
বিশ্বকাপ দল নিয়ে লুকোচুরি কেন?
বিশ্বকাপ দল নিয়ে লুকোচুরি কেন?
টাইমস হায়ার এডুকেশন র‌্যাংকিং:  বাংলাদেশ থেকে শীর্ষে বুয়েট, বেসরকারিতে নর্থ সাউথ
টাইমস হায়ার এডুকেশন র‌্যাংকিং: বাংলাদেশ থেকে শীর্ষে বুয়েট, বেসরকারিতে নর্থ সাউথ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ