X
শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪
২০ বৈশাখ ১৪৩১

ধারা ৪০১: ক্ষমা ও ক্ষমতা

এস এম মাসুম বিল্লাহ 
০৭ অক্টোবর ২০২৩, ১৬:০৭আপডেট : ০৭ অক্টোবর ২০২৩, ১৬:৩০

খালেদা জিয়ার বিদেশ যাওয়ার আবেদন আবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। আবেদন কবুল না করে আইনমন্ত্রী ২০২১ সালের যুক্তিই পুনর্ব্যক্ত করেছেন। এবার (২০২৩) কেন জানি একটি কথা রাষ্ট্র হয়েছিল– সরকার এবার অনুমতি দিয়েও দিতে পারে! মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বরাবরের মতই অস্থির প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তিনি আগের বার বলেছিলেন, ‘এই বঞ্চনা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বহিঃপ্রকাশ’। এবার সরাসরি তিনি তীর ছুঁড়েছেন– “সরকার তাঁকে হত্যা করতে চায়।” 

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার শেখ হাসিনাকে এ যাবৎ ২২ বার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে।  খালেদা জিয়াকে কেউ কখনও হত্যা করতে চেয়েছে, এমনটা জানা যায় না। তাই সরকার খালেদা জিয়াকে হত্যা করতে চায় এমন উক্তি ভালো স্যাটায়ার মনে হতে পারে। কিছু মানুষ হয় এমন যারা নিজের গুন অন্যের মধ্যে দেখতে পেয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। মাওলানা রুমির এক কবিতায় আছে: ‘তোমার ক্রোধ আর অভাববোধের আয়নায় ওই গুণগুলো তুমি আমার মধ্যে আবিষ্কার করো /তুমি ঘূর্ণায়মান এক শিশুর মতো যে নিজে নিজে ঘুরতে ঘুরতে এক পর্যায়ে ভাবতে থাকে পুরো ঘরটাই ঘুরছে।’ 

আইন সমাজের আয়না। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারার আওতা ও প্রকৃতি এখন আলোচনায়। আমাদের ফৌজদারি সংহিতার (সিআরপিসি, ১৮৯৮) অধীনে সরকার  অপরাধীর সাজা স্থগিত বা  মওকুফ (আংশিক বা সম্পূর্ণ) করে  দিতে পারেন। আর সাংবিধানিক-বিধান রাষ্ট্রপতিকে দয়া দেখানোর অমোঘ ক্ষমতা দিয়েছে (অনুচ্ছেদ ৪৯)। 

যাহোক, খালেদা জিয়া মামলায় কিছু বিষয় নিবিড়ভাবে ভেবে দেখা দরকার। বিষয়টি শুধু আইনি নয়, এর সঙ্গে রাজনৈতিক সংস্কৃতির সম্পর্কও আছে। আইন প্রকৃতপক্ষে রাজনীতির পরিশীলিত  রূপ। তবুও এই বিষয়ে আমাদের আইনি বাহাসের ক্যানভাসটা আরও ঋদ্ধ হওয়া উচিত। শুধু এখনকার নয়, ভবিষ্যৎ প্রয়োজনেও।  

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সংবাদ সম্মেলনে (৪ অক্টোবর ২০২৩) খালেদা জিয়ার আবেদনটি না-মঞ্জুর করার পক্ষে একটা কমনসেন্স যুক্তির অবতারণা করেছেন। তা হলো খালেদা জিয়া ইতোমধ্যে সিআরপিসির ৪০১ ধারার সুবিধা পেয়েছেন। তার আবেদনের প্রেক্ষিতে সরকার তার ১৭ বছরের সাজা স্থগিত করে তাঁকে শর্তসাপেক্ষে নিজ বাসায় থাকার অনুমতি দিয়েছেন। এবং একই আবেদনের সুবিধা বারবার সময়ের দিক দিয়ে বাড়ছে মাত্র। 

যেহেতু ৪০১ ধারা সরকার তার ক্ষেত্রে অনুশীলন করেছেন, দ্বিতীয়বার ভিন্ন যুক্তিতে আবার তা ভোগ করার সুযোগ নেই। এর একটা মানে এই হয় যে, নতুন সুবিধার (বিদেশ যাওয়ার) আবেদন মানে হলো আগের শর্তের বরখেলাপ। আর বরখেলাপি মানে দণ্ডিতের স্ট্যাটাস পূর্বের অবস্থায় ফায়ার যাওয়া। আমি মনে করি সরকারের এই ‘রিজোনিং’ আক্ষরিক ও প্রেক্ষাপটের দিক দিয়ে ঠিক আছে। কিন্তু বিএনপিমনারা বলেছেন ‘মানবিকতার’ কথা। আইন, মানবিকতা ও মানবাধিকার প্রশ্নে ভ্রান্তি ও বিভ্রান্তি লক্ষণীয়। এই ভ্রান্তি নিরসনে ধারা ৪০১ এর সঙ্গে যুক্ত আরও কিছু আইনি বিষয় আলোচনার পাদপ্রদীপে নিয়ে আসতে হবে। 

২. ক্ষমা প্রদর্শন বা শাস্তি কমানো বা মওকুফ করার সরকারের নির্বাহী বিভাগের একটা গুরুত্বপূর্ণ সার্বভৌম কাজের অনুশীলন। ক্ষমা ও ক্ষমতা দুটোই সরকারের হাতে। কোনও অনিশ্চিত বা অস্পষ্ট ব্যাপারে রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতা অনুশীলন করা বিতর্ক সাপেক্ষ। কেননা, বিভিন্ন দেশের ইমিগ্রেশন আইন বা ভিসা আইনে দণ্ডিত ব্যক্তিকে সাধারণত ভিসা দেওয়া হয় না। এজন্য দেখা যায়, ভিসা আবেদনে ‘ক্রিমিনাল রেকর্ড’- এর ব্যাপারে একটি প্রশ্ন থাকে। 

কোনও দেশ যদি এরকম ব্যক্তিকে ভিসা দেয়ও সেটি প্রতিষ্ঠিত কোনও ব্যতিক্রমের মধ্যে পড়তে হবে। অপরাধীর দণ্ড ফৌজদারি সংহিতার ৪০১-ধারা অনুশীলন করে স্থগিতকরণ বা হ্রাসকরণ অপরাধীকে নির্দোষ বানিয়ে দেয় না। দণ্ডাদেশ তাত্ত্বিকভাবে সক্রিয় থাকে। তাই ধরা যাক রাষ্ট্র যদি, কোনও দণ্ডিতের সাজা স্থগিত করে বা কমিয়ে তাকে বিদেশ যাওয়ার অনুমতি দেয়, খুবই সম্ভব যে, যে দেশে তিনি যাবেন সে দেশের ইমিগ্রেশন আইন ১৭ বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে ভিসা দিতে অস্বীকৃতি জানাতে পারে। 

এই অনিশ্চয়তার কারণে, ৪০১ ধারার  রাষ্ট্রীয় নির্বাহী-সার্বভৌম ক্ষমতা অন্য দেশের ভিসা আইনের মুখাপেক্ষী করা যায় না। প্রার্থী তার আবেদনে কোনও নির্দিষ্ট গন্তব্য-দেশের নাম উল্লেখ না করলে এই অনিশ্চয়তা বাড়ে। মার্জনা আবেদনে কোনও দেশের নাম নির্দিষ্ট করে বলা না থাকলে এই ভবিষ্যবাদিতা তীব্রতর হয়। সিআরপিসি ঘরোয়া আইন (territorial statute) হওয়ায় ধারা ৪০১-এর ক্ষমতা দেশের অভ্যন্তরে কার্যকরযোগ্য বলে ভাবতে হবে।  

৩.  এই  জটিলতার সঙ্গে যুক্ত হতে পারে পাসপোর্ট আইনের বিধান। পাসপোর্ট আদেশ ১৯৭৩-এর উদ্বোধনী বাক্যে বলা আছে যে, পাসপোর্ট ব্যবস্থা পরিচালিত হবে ‘জনস্বার্থে’। ওই আইনের ৬ (২) ধারায় বলা আছে যে,  নৈতিক স্খলনজনিত ফৌজদারি কোনও অপরাধে কমসে কম দুই বছর দণ্ডিত কোনও ব্যক্তি পাসপোর্ট পাবার যোগ্য নন (নবায়নের ক্ষেত্রেও একই)। 

তাই যেখানে আইনের আজ্ঞামূলক নিষেধ দেখতে পাচ্ছি, সেখানে একেবারে ইউ-টার্ন নিয়ে কোনও দণ্ডিত ব্যক্তিকে পাসপোর্ট রি-ইস্যু করে সামগ্রিক আইনি কাঠামোর  বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া কোনও ‘জনস্বার্থ’ যুক্তিতে পড়ে না। বিশেষত দণ্ডিত ব্যক্তি যদি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হন, এবং খুবই সম্ভাবনা থাকে যে, তিনি বিদেশে গিয়ে আরেকজন পলাতক দণ্ডিত ব্যক্তির সঙ্গে রাজনৈতিক কার্যক্রমে যুক্ত হবেন। অথবা তার অনুসারীরা এটাকে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে ব্যবহার করবেন। এক আইনের ধারা প্রয়োগ করতে গিয়ে অন্য আইনের প্রতিষ্ঠিত ধারাকে কি লঙ্ঘন করা যায়, সে এক বড় প্রশ্ন।

৪. ফৌজদারি আইনে শাস্তি স্থগিত বা হ্রাস বা ক্ষমা করার বিধান একই আইনে বাতলে দেওয়া নিয়মিত অন্যান্য বিধানের সমকক্ষ নয়। যদি তাই হয়, তাহলে বিচার/শাস্তির ধারাগুলো অর্থহীন হয়ে পড়ে। আবার, ৪০১ ধারা সিআরপিসির সমতলে বিচ্ছিন্ন কোনও দ্বীপও নয়। অপরাধ আইনের কঠোর ব্যাখ্যা  হয় অভিযুক্তের পক্ষে। আর ৪০১ ধারার  মতো কল্যাণমূলক ধারাগুলো অভিযুক্তের পক্ষে নয়, দণ্ডিতের ক্ষেত্রে পরম ব্যতিক্রম ক্ষেত্রে ব্যবহার করার একটা পথ। 

অনেকটা সংবিধানের ১০৪-এ যেমন ‘সম্পূর্ণ ন্যায়বিচার’ ধারণার মতো। সম্পূর্ণ ন্যায়বিচারের অজুহাতে আদালতের মূল রায়কে খাটো করা যায় না। সেজন্যই, ৪০১ ধারার সিদ্ধান্ত নিতে, সংশ্লিষ্ট আদালতের সুচিন্তিত লিখিত মতামত নেওয়ার বিধান আছে। সিআরপিসির ৪০১ আর সংবিধানের ১০৪ কী এক ইশারা তৈরি করলো, বলুন!  এইসব বিধান রাখা হয় এই জন্য যে, অন্যান্য আইনের মতো ফৌজদারি আইনকেও জীবনের আইন হতে হয়। ‘অন্তবিহীন পথে চলে জীবন, শুধু জীবনের কথা বলে জীবন!’ তবে এটার ব্যবহার হতে হয় পরম সার্বভৌমিক ও সামগ্রিক। এর একককে প্রয়োগ বৈষম্য সৃষ্টি করতে পারে। এবং এর জলের দরের মতন ব্যবহার করার আবেদন সিআরপিসির অন্যান্য বিধানের প্রয়োজনীয়তাকে ম্লান ও অর্থহীন করে দিতে পারে। 

অনেকে মনে করেন ক্ষমা ও ক্ষমতা দুটোই যেহেতু সরকারের হাতে, তাই সরকার ইচ্ছে করলেই খালেদা জিয়াকে বিদেশ যেতে দিতে পারেন। সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক আইনে ৪০১ ধারার অধীনে সরকারের যেকোনও সিদ্ধান্ত বিচারিকভাবে যাচাইযোগ্য (justiciable)। তাই ৪০১ ধারাকে ‘সরকার ইচ্ছে করলে ব্যবহার করতে পারেন’ মতবাদে ফেলার সুযোগ নেই। ৪০১ ধারার মানে হলো সরকার ‘পারেন’ কিন্তু ‘ইচ্ছে করলেই’ পারেন না। 

এই ‘ইচ্ছে’ শুধু সিআরপিসি বলে নয়, রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ও অন্যান্য আইন সাপেক্ষ। এটা এমন নয় যে,  খন্দকার মোশতাক নামের একজন খুনি শাসক ইচ্ছে করলেন আর বঙ্গবন্ধুর খুনি ফারুক-রশিদ-ডালিম-হুদাদের পরিবারসহ প্লেনে উঠিয়ে ব্যংকক বা ত্রিপোলি পাঠিয়ে দিলেন। বা জেনারেল জিয়া নামের একজন সামরিক শাসক এসব খুনিদের কোথাও রাষ্ট্রদূত বা এই জাতীয় কিছু একটা বানিয়ে  দিলেন। অথবা খুনিদের নিষ্কৃতি দিয়ে জারি করা মুশতাকের অধ্যাদেশ জেনারেল জিয়া সংবিধানে ঢুকিয়ে খুনিদের রক্ষাকবজ দিলেন। অথবা অপারেশন ‘ক্লিন হার্ট’ চালিয়ে বলে দিলেন এই অভিযানের ভিকটিমরা বিচার চাইতে পারবেন না।  

খুনির ইনডেমনিটিকে যারা আইনের শাসন ও সংবিধানিকতা ভাবেন, বা সে ব্যাপারে অপরূপ নীরবতা পালন করেন, কেবল তাদের পক্ষেই ৪০১ ধারার অমন মানে ভাবা সম্ভব, তারা ভাবেন যে খুন করে বা অপরাধ করে বিদেশে গেলে তা দেশের আইনে জায়েজ থাকা উচিত। টিপ্পনিতে বলে রাখি, জোসেফ কেসে, জোসেফ ১৯ বছর জেল খেটে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা পেয়েছিল। আর সেটি ছিল রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক ক্ষমা, ধারা ৪০১-এর মার্জনা নয়।  

৫. বেগম খালেদা জিয়া যদি সত্যিই বিদেশ যেতে চান, এবং তার মেডিকেল সাক্ষ্য সাপোর্ট করে (ড্যাব বা রাজনৈতিক নেতাদের মেডিক্যাল মতামত নয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, বিএনপি নেতাদের মুখে এ যাবৎ অনেকবার শোনা গিয়েছে যে, খালেদা জিয়া জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণে রয়েছেন)। খালেদা জিয়া বারবার সুস্থ হয়ে বিএনপি নেতাদের হতাশ করেছেন। 

যদি মেডিক্যাল রিপোর্টের ভিত্তিতে দৃশ্যমানভাবে প্রতীয়মান হয়, অমুক দেশ ছাড়া এই রোগের  চিকিৎসা সম্ভব নয় তাহলে একটাই আইনি পথ খোলা আছে। যদিও তার সফলতা কিছু ব্যাপারের ওপর নির্ভর করছে। তাহলো সংবিধানের ৪৯ নং অনুচ্ছেদ অনুসারে রাষ্ট্রপতির কাছে দাক্ষিণ্য আবেদন করা (mercy petition)। ৪০১ ধারার অধীনে সরকারের (এখানে প্রধানমন্ত্রীর) কাছে দণ্ড মওকুফের আবেদন সম্ভব। কিন্তু আইনমন্ত্রীর যুক্তির বাগড়া এবং ওপরে উল্লেখিত কারণে সেটি আর তেমন খোলা নেই। ৪০১-এর অধীনে মওকুফের আবেদন কোনও কাজে আসবে না। কারণ, ৪০১ এর মওকুফ আবেদনকারীকে নির্দোষ করে না। এ বিষয়ের জটিলতা আমি এই লেখার শুরুতেই বলেছি। 

সুতরাং বাকি থাকলো সংবিধানের ৪৯ নং অনুচ্ছেদের অধীনে ক্ষমা আবেদন। আর এটার জন্যে তাঁর আইনজীবীদের প্রথমেই আদালতের রায় মেনে নিতে হবে। মজার ব্যাপার হলো, খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা যতটা না খালেদা জিয়ার আইনজীবী, তার চেয়ে বেশি বিএনপির আইনজীবী। তাই তারা কখনোই গ্রহণ করেন না যে, বেগম জিয়ার আইন অনুযায়ী বিচার হয়েছে। তারা তাকে নির্দোষ প্রমাণ করার চেয়ে প্রমাণ করতে চান যে, তিনি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে বিনা কারণে জেলে আছেন। মির্জা ফখরুল একবার জামিনের ব্যাপারে বলেছিলেন যে, আমাদের বিচার বিভাগের ‘দ্বৈত নীতি’ বেগম জিয়ার জামিন না পাবার জন্যে দায়ী। অবশ্য ‘দ্বৈত নীতি’ বলতে তিনি কি বুঝিয়েছিলেন তা ভেঙে বলেননি। বাংলাদেশের আদালত সম্ভবত অন্যতম আদালত যেটি প্রতিনিয়ত সরকারবিরোধী রুলিং দিয়ে থাকে। 

তবে আমাদের বিচারিক সিস্টেমের কাঠামোগত ও কার্যগত দুর্বলতা যেগুলো আছে তা  কলোনিয়াল আমলের পিছুটানমাত্র (colonial legacy)। অনেকে মনে করতে পারেন, বিএনপির নেতারা বা আইনজীবীরা খালেদা জিয়ার জেলে থাকা প্রসূত জনপ্রিয়তা খরচ করতে চেয়েছেন। স্মরণ করতে পারি, তার জামিন আবেদনের সময় হাজার হাজার আইনজীবী মিছিল নিয়ে আদালতে যুক্তির চেয়ে হট্টগোল করেছেন বেশি। শত শত পৃষ্ঠার আবেদন দিয়েছেন। 

 ফৌজদারি বিচারে জামিন প্রথার চর্চা একটা মৌলিক নীতি থেকে জাত। আইনের তালেবে এলেমরা একে প্রিজাম্পশন অব ইনোসেন্স নামে ডাকেন। এর অর্থ হলো বিচারে অপরাধী সাব্যস্ত না হওয়া অবধি একজন মানুষ নির্দোষ। সেই জন্য বিচার চলাকালীন কিছু ব্যতিক্রম বাদে একজন মানুষ স্বাভাবিক জীবনে থেকে বিচারের কাছে নিজেকে সমর্পন করতে থাকবেন। হাজিরা নিশ্চিতের শর্তে জিম্মাদার এর মুচলেকায় বা নিজের প্রতিশ্রুতির প্রেক্ষিতে আদালত থেকে এই অধিকার দেওয়া হয়।

বিচারক তাঁর প্রজ্ঞা বলে, আইনে সেঁটে দেয়া মানদণ্ডের আলোকে অভিযুক্তকে জামিন দিতে পারেন। কিন্তু অভিযোগ প্রমাণিত হয়ে দণ্ড হয়ে গেলে জামিনের এভিন্যু আর মসৃণ থাকে না। খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে দুটি মামলায় হাইকোর্ট বিভাগ অবধি দণ্ড নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলো। তাই জামিনের একেবারে মৌলিক নীতি ‘প্রিজাম্পশন অব ইনোসেন্স’ আর অবশিষ্ট ছিল না। খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা যেসব আবেদন করেছিলেন তা ছিল জামিন আবদেন নামের ভ্রান্তি বিলাস–কমেডি অব এরর্স।  

৫. রাষ্ট্রপতির কাছে মার্সি পিটিশন দিতে হলে, আবেদনকারীকে রায় মাথা পেতে নিতে হবে। উচ্চ আদালতে আপিল প্রত্যাহার করতে হবে। অনেকের মতে প্রত্যাহার না করলেও চলে। রাষ্ট্রপতির অনুকম্পা পেলেই কেবল, ফৌজদারি দণ্ড প্রশমন হয়, এবং দণ্ডিত ব্যক্তি তার হারানো দেওয়ানি অধিকারগুলো ফেরত পান। তখন আর সেটা ইমিগ্রেশন আইন বা ভিসা আইন বা রাষ্ট্রীক ও অতিরাষ্ট্রীক অন্য কোনও আইনের সাথে সাংঘর্ষিক হয় না। তখন আবেদনকারী বিদেশ যাওয়াসহ অন্য অধিকার অনুশীলন করতে পারেন। 

ধারা ৪০১ রাষ্ট্রপতির ক্ষমা করার বিশেষাধিকার কেড়ে নেয় নাই, নিতেও পারে না, কেননা এটা সংবিধানস্বীকৃত রাজার বিশেষ প্রাধিকার (royal prerogative) যা অনুশীলনের আওতা প্রায় প্রশ্নাতীত (sovereign inviolability)। তবে ৪০১ (৫এ) ধারা মতে, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা শর্তসাপেক্ষও হতে পারে। সেমতে, কোনও শর্ত যদি রাষ্ট্রপতি ক্ষমিত ব্যক্তিকে দেন, তা দণ্ডদানকারী আদালতের আদেশের সমান ফোর্স পাবে। অবশ্য কোনও আবেদনের প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতি ক্ষমা প্রদর্শন করবেন কিনা তার নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। সেটা একটা মঙ্গল ইঙ্গিতের প্রশ্ন ( gesture of goodness)। 

৫. আমি বিএনপির আইনজীবীদের প্রতিক্রিয়াতে আইনি উপাদান কম পাই। তারা নিশ্চয়ই বেনিন, বিন্দ্রা,  ম্যাক্সওয়েল, মাহমুদুল ইসলাম, রুপার্ট ক্রস এসব ব্যাখ্যাগুরুদের লেখা পড়ে থাকেন। পড়লে প্রথমত: অবশ্য ‘তিন বারের প্রধানমন্ত্রী’ যুক্তি প্রযুক্ত করতেন না।  এরকম যুক্তি জ্ঞাত আইনবিজ্ঞানের কোনও ফর্মুলায় পড়ে না। বরং ‘তিনবারের প্রধানমন্ত্রী’ হবার কারণেই তার ক্ষেত্রে ৪০১ ধারা সতর্কভাবে প্রয়োগ হওয়া উচিত। সুতরাং, ওই পয়েন্টে বার বার তারা হেরে যাবেন। মনে রাখতে হবে, তিন বারের প্রধানমন্ত্রীর ব্যাপারে চারবারের প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন। 

দ্বিতীয়ত: মানবিক গ্রাউন্ড কথাটা সঠিক হয় না। ৪০১ ধারা নিজেই একটা মানবিক ধারা, যার মানবিক অনুশীলন বেগম জিয়াকে জেলের বাইরে নিজ বাড়িতে থাকার সুযোগ দিয়েছে। মনে রাখতে হবে, এটা স্কুলের টিউশন ফি কমানোর কোনও দরখাস্ত নয়। প্রকৃতপক্ষে, ক্ষেত্রগুলো হতে পারতো, মানবাধিকার প্রসূত। বিএনপির আইনজীবীরা একটু পড়াশুনা করলেই, বেগম জিয়ার বর্তমান বয়স, আনফোরসিন করোনা সার্কামস্টেন্সেস, রাইট টু লাইফ, রাইট টু হেলথ, রাইট টু ডিউ প্রসেস, প্রিজাম্পশন অব ইনোসেন্স, বেনিফিট অব টু কনস্ট্রাকশন ইত্যদি গ্রাউন্ডে ৪০১ এর পিটিশন করতে পারতেন। সেটি তারা আদালতেই করুন। বা সরকারকে আবেদন করে বলুন যে, এক্ষেত্রে সরকার আদালতের মতামত নিলে তারা তা মানবেন। এ যদি তারা না করতে চান, মনোযোগ দিয়ে তার মামলাগুলো লড়ে সাক্ষ্যপ্রমাণ দিয়ে আপিল বিভাগের রায় তাদের পক্ষে নিতে চেষ্টা করতে পারেন।  

৬. আমার কাছে একটা জিনিস খুব অবাক লাগে। আমি বিএনপি-ঘরানার অনেক মানুষকে চিনি যারা বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার নামটি পর্যন্ত সম্মানের সাথে উচ্চারণ করেন না। কুরুচিপূর্ণ-অশ্রাব্য সম্বোধন তারা ব্যবহার করেন। তারা বঙ্গবন্ধুকে জাতির জনক মানেন না, বঙ্গবন্ধু শব্দটিও বিকৃত উচ্চারণে বলতে ও লিখতে দেখি। আবার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নে এরকম মানুষেরা বলেন যে, ‘কেন, শেখ মুজিব তো তাদের ক্ষমা করে দিয়ে গেছেন, আবার বিচার কেন?’  

সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তনয় তারেক রহমানের বিরুদ্ধে একুশে আগস্টে  (২০০৪ ) বোমা হামলা করে শেখ হাসিনাকে হত্যা করার ওজনদার প্রমাণাদী রয়েছে। রায়ও হয়েছে। অথচ খালেদা জিয়াকে ক্ষমা করে বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ দিয়ে মানবিকতা দেখাতে আহ্বান জানাচ্ছে বিএনপি। এতো সেই আরব বেদুঈনের গল্পের মতো, যে তার ছেলের হত্যাকারীকে আশ্রয় দিয়েছিলো, এবং উপঢৌকন দিয়ে বিদায় দেওয়ার মুহূর্তে জানতে পেরছিলো যে, আশ্রিত ব্যক্তি তার সন্তানের খুনি! বেদুঈন তখন বললেন যে, ‘যাও তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম’। বিএনপি ঘরানার মানুষজন শেখ হাসিনার কাছে ওই বেদুঈন দৃষ্টান্ত থেকেও বেশি চাইছেন– নিজের খুন-উদ্যোক্তাকে ক্ষমা করে বিদেশ পাঠানো হোক। 

খালেদা জিয়া বর্ষীয়ান হয়েছেন। এখন তার অসুস্থতা অন্যান্য কারণের মধ্যে বয়স প্রসূতও হবে। তিনি দেশে (বা বিদেশে, বা দেশে বসে প্রযুক্তির মাধ্যমে বিদেশের) মানসম্পন্ন চিকৎিসা গ্রহণ করুন এও আমাদের প্রার্থনা। তার সুস্থ হয়ে ওঠাটা বর্তমানের বিতর্ক কমিয়ে আনবে। পার্থক্যটা ধারণা ও বোধের। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপকেই বিএনপি আইনসম্মত মনে করে না। তিনি তাই বিএনপির চোখে দণ্ডিতই নন। তাই তার আইনজীবীরা বা পরিবারের সদস্যরা ৪০১-এর দরখাস্ত কি মনে করে করেন তা বোধগম্য নয়। 

আপাতত এইটুকুই বলা। ফৌজদারি সংহিতার ৪০১ ধারার ব্যাপ্তি নাঙা  নয়। এর ব্যবহার অতি সীমিত এবং সতর্কমুখী। আর আছে সাংবিধানিক ৪৯ নম্বর অনুচ্ছেদের মার্সি পিটিশন। বিএনপির তরফে তা নিশ্চয় ঊনপঞ্চাশ বায়ু! ক্ষমা ও ক্ষমতা এক সম্মিলনী মহাবিদ্যালয়!  

লেখক: অধ্যাপক ও ডিন, আইন অনুষদ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

ই-মেইল: [email protected]

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শর্টকাটে বড়লোক হতে গিয়ে
শর্টকাটে বড়লোক হতে গিয়ে
নারী ফুটবল লিগ থেকে চারটি দলের ভোটাধিকার থাকছে!
নারী ফুটবল লিগ থেকে চারটি দলের ভোটাধিকার থাকছে!
থেমে থাকা ট্রাকে পিকআপের ধাক্কা, ২ জন নিহত
থেমে থাকা ট্রাকে পিকআপের ধাক্কা, ২ জন নিহত
প্রতিদিন মা হারাচ্ছে ৩৭ ফিলিস্তিনি শিশু
প্রতিদিন মা হারাচ্ছে ৩৭ ফিলিস্তিনি শিশু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ