X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

নিজেদের ব্যান্ডউইথ আইটিসির কাছে বিক্রি করতে হবে কেন?

রেজা সেলিম
০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৯:২৪আপডেট : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৯:২৪

বাংলা ট্রিবিউনে ২ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত “শতকোটি টাকা রাজস্ব হারানোর শঙ্কা- নিয়মের বাইরে আইটিসির কাছে ব্যান্ডউইথ বেচতে চায় সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানি” শীর্ষক রিপোর্টটি পড়ে একজন সাধারণ কৌতূহলী নাগরিকের মতো আমার মনে প্রশ্ন জেগেছে আমাদের দেশে কি আমরা ব্যান্ডউইথ সংগ্রহে, বিতরণে ও ব্যবস্থাপনায় খুব ভালো দক্ষতা অর্জন করে ফেলেছি? প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী আমরা বিদেশ থেকে ব্যান্ডউইথ আনি আবার সেটা বিদেশে রফতানি করতে চাইছি, উদ্যোগও প্রায় নেওয়া শেষ!

সংশ্লিষ্ট দফতর ও গুটি কয় কোম্পানি বলছে দেশের অনেক ব্যান্ডউইথ এখন উদ্বৃত্ত, সেটা বিদেশে বিক্রি করে ফেলাই ভালো! প্রতিবেদক লিখেছেন, “নিয়ম নেই, তারপরও আইটিসির কাছে ব্যান্ডউইথ বিক্রি করতে চায় বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানি (বিএসসিপিএলসি)। এতে করে সরকারি ব্যান্ডউইথ রফতানির সুযোগ পেতে যাচ্ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ফাইবার অ্যাট হোম গ্লোবাল লিমিটেড। এই সিদ্ধান্তে সরকারের শতকোটি টাকা রাজস্ব হারানোর শঙ্কা তৈরি হয়েছে” ।

কেন এরকম হচ্ছে? যুক্তি হলো, আমাদের ব্যান্ডউইথ চাহিদা ৫ হাজার ২০০ জিবিপিএস, আর আমাদের সক্ষমতা বা আছে ৭ হাজার ২০০ জিবিপিএস। এর মধ্যে মজার বিষয় হলো চাহিদার ৩ হাজার জিবিপিএস কিন্তু আমরা বিদেশ থেকে আমদানি করি আর ২ হাজার ২০০ জিবিপিএস আমাদের দেশের কোম্পানি যুক্ত করে। তাহলে এখন এই সক্ষমতার বাড়তি ব্যান্ডউইথ কী হবে? সরল অংকের হিসাবে এই ২ হাজার জিবিপিএস চলেন বিক্রি দেই!

এরকম হিসাব আমরা করছি কারণ ব্যান্ডউইথ বাণিজ্যের স্বার্থ যারা রক্ষা করে তাদের কাছে ব্যবসাটাই মুখ্য কিন্তু আমাদের নীতির মানুষদের হাতে কী আছে? যারা নিয়ন্ত্রক, যারা দেশের মানুষের প্রতিনিধি, যারা দেশটাকে ভালোবাসেন তাদের এই নিয়ে মাথাব্যথা থাকবে না কেন?

আমাদের দেশের দুর্ভাগ্য, যারা আমাদের ইন্টারনেট সেবাসুবিধা নিয়ন্ত্রণ করেন, তারাই ‘ফেলে রাখা’ বা ‘উদ্বৃত্ত’ শব্দ দুটি ব্যবহার করছেন। ইন্টারনেট সেবা দিয়ে এই দেশের কী উপকার করা সম্ভব, তা বোঝার জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা তাদের আছে। তারপরও তারা সরকারকে ভুল বুঝিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে দিতে চাইছেন, যাতে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ হয়ে স্মার্ট বাংলাদেশ’ রূপকল্প বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশে ইন্টারনেট মোটেই উদ্বৃত্ত নেই। চাহিদার সামান্য অংশ মাত্র আমাদের কাছে পৌঁছাতে পেরেছে।

ইন্টারনেটের বিতরণব্যবস্থা যাদের হাতে, তারাই বাড়ি, শিক্ষাকেন্দ্র আর কর্মস্থলে সেই সেবা পৌঁছাতে টালবাহানা করছেন। সময় ক্ষেপণের কৌশলে প্রমাণ করতে চাইছেন দেশে চাহিদা নেই, বিদেশে বিক্রি করে দেওয়া ভালো। বিতরণ ব্যবস্থার অসঙ্গতির কারণে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি ভাগ্য উন্নয়নে। কেউ একজন এই নিয়ে একটু তত্ত্ব-তালাশ করলে এই চাহিদা নিরূপণ ও বিতরণ ব্যবস্থার প্রচুর অব্যবস্থাপনা ও অদূরদর্শিতার প্রমাণ পাবেন।

আমাদের বাস্তবজ্ঞান ও মাঠের কৌশল বাস্তবায়নের উপযুক্ত নির্দেশনা তৈরি করতে না পারায় বিটিসিএল ঢাকা বাদে দেশের সর্বত্র হাস্যকর কারণিক পদ্ধতিতে ইন্টারনেট সেবা সংযোগ দিয়ে যাচ্ছে। ব্রডব্যান্ডের (উচ্চগতির সংযোগ) ক্ষেত্রে দরখাস্ত করতে হবে। তারা যাচাই-বাছাই করে ‘ডিমান্ড নোট’ দেবে। সেই কাগজ নিয়ে নির্ধারিত ব্যাংকে টাকা জমা দিলে বিটিসিএল সংযোগ দেবে। এর মধ্যে চলে যাবে অন্তত দুই মাস! তাও ঠিক আছে, কিন্তু সংযোগ পেতে হলে আপনার কর্মস্থল পর্যন্ত নিজ খরচে তার টেনে নিতে হবে বিটিসিএল এক্সচেঞ্জ থেকে— তা যত কিলোমিটার দূরত্বই হোক! সঙ্গে আপনাকে কিনে দিতে হবে সংযোগের জন্য প্রয়োজনীয় দুই পাশের আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি। সঙ্গে চলতে থাকবে তদবির! শেষে ঢাকা মগবাজার এক্সচেঞ্জ থেকে আইপি নিতে বলবে। আবার দরখাস্ত, আবার ডিমান্ড নোট। আইপি পেলেন তো সংযোগ নেই, সংযোগ আছে তো আইপি ঠিক নেই। এ রকম করে করে ন্যূনতম ছয় মাস সময়ে আপনি চাহিদামতো সংযোগ পেলেও পেতে পারেন।

আর এই সুযোগে তথ্য-প্রযুক্তির ভুল স্বপ্ন দেখিয়ে ছেলেমেয়েদের হাতে দিয়ে দেওয়া হয়েছে মোবাইল ফোন আর ফোরজি, ইউটিউবার বানাবার মহাকৌশল! এতে আয় হলেই হলো, কনটেন্ট যা হয় হোক। সারা দেশটা মিথ্যা আর গুজবের তথ্য পরিবেশন ও অনাচারে ছেয়ে দেওয়া হয়েছে, এসবের নিয়ন্ত্রণ তো দূরের কথা কোনও প্রতিকারও নেই।

ঝিলংঝা আর কূয়াকাটা থেকে নেমে আসা ইন্টারনেট সারাদেশে যেসব পথে প্রান্তরে জমি-রাস্তা খুড়ে নেওয়া হলো সেসবের পরিমাণ দেখানো হয় হাজার কিলোমিটারের হিসাবে। সরকারি দফতরের তথ্য অনুযায়ী (সূত্র- ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের ওয়েব সাইটে দেওয়া ‘সরকারের উন্নয়ন, অগ্রগতি ও সাফল্য সংক্রান্ত প্রতিবেদন’), ২০২৩ সালে এসে আমাদের অপটিক্যাল ফাইবারের বিস্তৃতি ঘটেছে ১ লাখ ৬১ হাজার ৯৬৬ কিলোমিটার। এর সাথে ম্যাপ নিয়ে বসলে জানা যাবে পথের দুইপাশে কতগুলো গ্রাম, শহর, স্কুল, কলেজ, কমিউনিটি স্বাস্থ্য ক্লিনিক আর বাজার। কয় জায়গায় ইন্টারনেট সংযোগ আছে কেউ সে হিসাব জানাতে পারবেন?

ওই সরকারি তথ্য অনুযায়ী ২০২৩ সালে এসে আমাদের ইন্টারনেট গ্রাহক ১৩ কোটি ১৯ লাখ ও পেনিট্রেশন ৭৪.৭৪ শতাংশ। এখন এই শতাংশ হিসেবেই আমাদের জানা দরকার কত শতাংশ করে ওইসব খাতে সারা দেশের ৫ হাজার ২০০ চাহিদা বিতরণ করা হচ্ছে? কোন দফতর দিতে পারবে? পারলে পত্রিকায় প্রকাশ করে আমাদের জানানো উচিত।

ইতোমধ্যে ভারতে ও নেপালে ব্যান্ডউইথ রফতানি শুরু হলেও আমরা আশা করি আমাদের সামর্থ্যের ৫ হাজার ২০০ বিতরণ ও ব্যবহারের চুলচেরা হিসাব না করে দেশের ব্যান্ডউইথ আরও রফতানি করা উচিত হবে না।

কারণ ভালো গতির ইন্টারনেট না পাওয়ার ফলে আমরা অনেক কাজ করতে পারি না। দূরস্বাস্থ্য সেবা, শিক্ষাকেন্দ্রে মাল্টিমিডিয়া শ্রেণি ব্যবস্থাপনা, গ্রামের তথ্য, দ্বারপ্রান্তের ভূমি ব্যবস্থাপনা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ডিজিটাল সেবার পরিধি বাড়ানো এরকম শত উদাহরণ দেওয়া যাবে যেগুলো অসমাপ্ত। এগুলো আগে থেকে নিশ্চিত না করে ২/১টা দেনাদার কোম্পানির কথায় (কিছু কোম্পানির কাছে সরকার অনেক টাকা পায়, তারা তা শোধ না করে নতুন-নতুন বেচা কেনার প্রস্তাব দেয়) যা খুশি সিদ্ধান্ত নেওয়াও কিন্তু ভালো সক্ষমতার পরিচয় নয়। আর এতে ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ বলে একটা কথা আছে, তার সুফল থেকে দেশ বঞ্চিত হবে।

সবচেয়ে জরুরি হলো আমরা ব্যান্ডউইথ সুবিধা শেষ প্রান্ত পর্যন্ত যখন নিতে পেরেছি তখন ব্যবহার ও গ্রাহকবান্ধব একটি বিতরণ নীতিমালা করে দেখি না অন্তত দুই-এক বছরে আমাদের ছেলেমেয়েরা সুযোগ পেয়ে নিজেদের পাশাপাশি দেশ ও দশের উপকার করে কী না। ফলাফল ভালো না হলে আমাদের গুটিয়ে নেবার সুযোগ তো থাকবেই। তবুও অন্তত অন্তর্মুখী মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারের সঙ্কুচিত জগত থেকে জাতির ভবিষ্যৎ তরুণ সমাজকে উচ্চ গতির ব্রডব্যান্ড পৌঁছে দিয়ে উদ্ভাবনের উন্মুক্ত জগতে মুক্ত করে নিয়ে আসা যায় কী না সে চেষ্টা আমাদের করা উচিত।

লেখক: পরিচালক, আমাদের গ্রাম
ই-মেইলঃ [email protected]

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
অটোরিকশার ধাক্কায় মায়ের কোল থেকে ছিটকে পড়ে শিশুর মৃত্যু
অটোরিকশার ধাক্কায় মায়ের কোল থেকে ছিটকে পড়ে শিশুর মৃত্যু
উন্নয়নের ভেলকিবাজিতে বাংলাদেশ এখন ডেথ ভ্যালি: রিজভী
উন্নয়নের ভেলকিবাজিতে বাংলাদেশ এখন ডেথ ভ্যালি: রিজভী
ময়মনসিংহে বাস-অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষ, দম্পতি নিহত
ময়মনসিংহে বাস-অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষ, দম্পতি নিহত
নিউইয়র্কে সাকিবের ব্যবহারে মুগ্ধ বাংলাদেশের সাবেক গোলকিপার 
নিউইয়র্কে সাকিবের ব্যবহারে মুগ্ধ বাংলাদেশের সাবেক গোলকিপার 
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ