X
সোমবার, ১২ মে ২০২৫
২৯ বৈশাখ ১৪৩২

বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ঝুঁকি: বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য কতটা দায়ী?

আবীর হোসেন কান্তা
১৮ মার্চ ২০২৪, ১৬:১৭আপডেট : ১৮ মার্চ ২০২৪, ১৬:৪৫

অনেকে মনে করেন, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ভূমিকম্পগুলো হয়তো জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে ঘটে থাকে। বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ঝুঁকির কারণগুলোর ওপর বেশ কয়েকটি গবেষণা এবং নিবন্ধগুলো পর্যালোচনা করলে এটা স্পষ্ট হয় যে এগুলো বেশিরভাগই কেবল উপাত্তভিত্তিক ভবিষ্যদ্বাণী এবং অনুমাননির্ভর। তবে, বিভিন্ন গবেষণার ভিত্তিতে এটি বলা যেতে পারে, বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান এবং জলবায়ুর ক্রমাগত পরিবর্তন ভূমিকম্পের ঝুঁকি সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছে। 

জলবায়ু পরিবর্তন একটি বড় উদ্বেগ হয়ে ওঠার অনেক আগে থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ভূমিকম্প হয়ে আসছে। পৃথিবীতে প্রতি মিনিটে মিনিটে ভূমিকম্প হচ্ছে। ভারতীয় উপমহাদেশের ভূমিকম্পের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় যে একটি শক্তিশালী ভূমিকম্প একটি নির্দিষ্ট এলাকায় ঘটতে ন্যূনতম ১০০-১৫০ বছরের প্রয়োজন হয়। এদিকে অনেক বিশেষজ্ঞের দাবি, বিগত ১৩০ বছরে ঢাকা উল্লেখযোগ্য ভূমিকম্প দেখেনি। তাই ধারণা করা হয়ে থাকে যে বাংলাদেশে নিকটবর্তী যেকোনও সময় শক্তিশালী ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা খুবই প্রবল। সাম্প্রতিক সময়ে ছোটখাটো ভূমিকম্পগুলো তারই পূর্বাভাস বলা যেতে পারে। 

বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞ মনে করে থাকেন, বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ঝুঁকি মূলত বৈশ্বিক উষ্ণতার চেয়ে ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বেশি তৈরি হচ্ছে। তবে সম্ভবত এটি বলা যায় যে দীর্ঘমেয়াদি জলবায়ু পরিবর্তন পৃথিবীর টেকটোনিক প্লেটের ঘূর্ণনকে প্রভাবিত করতে পারে, যা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও বাংলাদেশে ভূমিকম্পের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলতে পারে। তবে বর্তমানে এই দাবির সমর্থনে এখন পর্যন্ত পর্যাপ্ত বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই।

বাংলাদেশের ভূমিকম্প এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়নের মধ্যে সরাসরি কোনও সম্পর্ক আছে কিনা তা নির্ণয় করতে হলে আমাদের ভূমিকম্প সম্পর্কে আরও গভীর অধ্যয়ন করতে হবে। তুরস্ক, মরক্কো ও আফগানিস্তানে এই বছরের বিধ্বংসী ভূমিকম্পের পর ভূমিকম্পের জন্য পরবর্তী কোন দেশটি সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ তা নির্ধারণ করার চেষ্টা করছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রাচীন পৃথিবীর গতিবিধি, নদীর গতিপথে আকস্মিক ও বিপর্যয়কর পরিবর্তন এবং গভীরভাবে চাপা পড়ে থাকা সক্রিয় ফল্টের উপস্থিতির প্রমাণের ভিত্তিতে, বেশ কিছু ভূকম্পবিদ নির্ধারণ করেছেন যে বাংলাদেশ ভূমিকম্পের জন্য পরবর্তী সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। অন্যদিকে, বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে কয়েক বছর আগেই ভূমিকম্পের সম্ভাবনা নিয়ে আগাম বার্তা দিয়েছিলেন ভূকম্পবিদ লিওনার্দো সিবার। বাংলাদেশে অনেক সক্রিয় টেকটোনিক প্লেট সীমান্তের সংযোগস্থলে (সিলেট ও চট্টগ্রাম) অবস্থিত।

সমুদ্রপৃষ্ঠের সান্নিধ্য এবং বিশ্বের বৃহত্তম ব-দ্বীপের অবস্থান এ দেশকে সুনামি এবং ভূমিকম্পের মতো ভয়ানক দুর্যোগের ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে।

ভূমিকম্পের জন্য বাংলাদেশের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হলো সিলেট জেলার জৈন্তিয়াপুর উপজেলা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলা। ঢাকা এই ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলগুলো থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত হওয়া সত্ত্বেও রিখটার স্কেলে ৭-৮ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকা একটি বড় বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে পারে। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ২০২২ এবং ২০২৩ সালে তিনবার ৫ মাত্রার বেশি ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। এদের মাত্রা যথাক্রমে ছিল ৫.১, ৫.২ এবং ৫.৩ । বাংলাদেশ গত ২০ বছরে ৫.৫-এর বেশি মাত্রার কোনও ভূমিকম্প দেখিনি।

সব মিলিয়ে গত এক বছরে বাংলাদেশে মোট ১৭টি ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৪ থেকে ৫-এর মধ্যে। এর মধ্যে প্রায় ১০টি ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকায়। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতর (বিএমডি)-এর অধীন ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রের কর্মকর্তা রুবায়েত করিম বলেন, “সাধারণত দেশের অভ্যন্তরে সৃষ্ট ভূমিকম্পের মাত্রা ৪ থেকে ৫-এর মধ্যে থাকে। ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় গত ১২ বছরে মোট আটটি ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়েছে। এসব ভূমিকম্পের বেশিরভাগ কেন্দ্রস্থল ছিল সিলেট ও চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ, মানিকগঞ্জ, নরসিংদী ও দোহার।

পৃথিবীর ভূত্বক কেবল মাটির মিশ্রণ নয় বরং একাধিক ভূস্তরে সজ্জিত। ভূস্তরগুলো ধীরে ধীরে স্থান পরিবর্তন করছে, তবে সামষ্টিক অবস্থান মোটামুটি একই রয়েছে। স্থান পরিবর্তনের ফলে ভূস্তর সংলগ্ন কঠিন খনিজের গঠন পাল্টাচ্ছে। স্প্রিং বা রাবারকে টানলে যেমন এর মাঝে কিছু বিভব শক্তি জমা হয়, তেমনি এই পরিবর্তিত কঠিন খনিজগুলোতেও বিভব শক্তি জমা হয়। স্প্রিং বা রাবারের মতো এখানে হঠাৎ শক্তি নির্গত হতে পারে যখন ভূস্তরের সিস্টেম ভেঙে পড়ে কিংবা যথেষ্ট পরিবর্তন ঘটে। ফল্টের অভ্যন্তরীণ বা পারিপার্শ্বিক কঠিন খনিজগুলোর পরিবর্তন বা গঠনের হার সম্ভবত ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার হারের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কযুক্ত। এই সিস্টেম সম্পর্কে আগাম অনুমান করা কঠিন আবার কতদিন পরপর ঘটবে সেটাও নির্ধারিত নয়। কেননা, কঠিন খনিজের প্রকৃতি সরল সিস্টেমে চলে না। তাই ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার হার পরিসংখ্যানিক সম্ভাব্যতার নিয়মে বিবেচনা করা হয়। 

অতীতে জলবায়ু প্রাকৃতিকভাবে পরিবর্তিত হয়েছিল, এবং পৃথিবী একটি বরফ যুগ থেকে বের হয়ে এসেছিল। তখন পৃথিবীর বেশিরভাগ অংশকে ঢেকে রাখা বড় বরফের চাদর এত ভারী ছিল যে পৃথিবী এর ভূত্বকের ওপর চাপের ফলে এই বরফের ভারকে ‘বাউন্স ব্যাক’ করে ভূমিকম্প, এমনকি পূর্ব-বিদ্যমান ফল্ট লাইন বরাবর আগ্নেয়গিরি সক্রিয় হয়। এই মুহূর্তে পৃথিবী এখনও প্রায় ২০ হাজার বছর আগে শেষ হওয়া বরফ যুগের শেষের দিকে সাড়া দিচ্ছে। সে কারণেই হয়তো ভূতাত্ত্বিক ম্যাকগুয়ারের বলেন, যদি মানব সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তন গ্রিনল্যান্ডের মতো বড় বরফের শিটগুলোকে অদৃশ্য করে দেয় তবে এটি আরও ভূমিকম্পের কারণ হতে পারে।

অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির একজন গবেষক বলেছেন, মৌসুমি বৃষ্টি প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পায়, যা ভারতীয় প্লেটের গতি বছরে এক সেন্টিমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি করতে পারে। গ্রীষ্মকালীন বর্ষা মৌসুমের অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ভূত্বককে উল্লম্ব এবং আনুভূমিকভাবে একসঙ্গে সংকুচিত এবং স্থিতিশীল করে। যখন বৃষ্টির পানি শীতকালে কমে যায়, তখন কার্যকরী ‘প্রতিক্ষেপণ’ অঞ্চলটিকে অস্থিতিশীল করে এবং ভূমিকম্পের সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়। তাই বলা যায়, জলবায়ু পরিবর্তন এই ঘটনার তীব্রতা আরও বাড়াতে পারে।

অন্যদিকে, বিভিন্ন জলবায়ু মডেলগুলো থেকে আমরা ধারণা পাই যে ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তন দক্ষিণ এশিয়ায় মৌসুমি বৃষ্টিপাতের তীব্রতা অনেকটুকু বৃদ্ধি করতে পারে। এটি সম্ভাব্য শীতকালীন তাপমাত্রার পরিবর্তনের কারণে আরও ভূমিকম্প সংঘটিত হতে পারে। তাই বলা যায়, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বাংলাদেশে ভূমিকম্পের সম্ভাবনা কিছুটা বাড়িয়ে দিতে পারে। তবে এটিই যে একমাত্র কারণ তা এখনও পুরোপুরি নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না।

বিজ্ঞানীরা এখনও ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়ার বিভিন্ন পদ্ধতি শনাক্ত করতে ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ভবিষ্যতে কোনও একসময়ে সক্রিয় প্লেটগুলোর স্থানচ্যুতিতে যেকোনও আকারের ভূমিকম্প ঘটতে পারে, এই ব্যাপারে মোটামুটি অনেকেই অবগত, কিন্তু কখন ঘটবে তা তারা ভবিষ্যদ্বাণী করতে অক্ষম। 

বৈশ্বিক উষ্ণতা আসলে বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে কিনা এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধির উপাত্ত ব্যবহার করে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়া যায় কিনা এই দুটো প্রশ্নের উত্তর এখনও সঠিকভাবে কেউ দিতে পারেনি। তাই বিজ্ঞানী এবং গবেষকদের উচিত ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং ভূমিকম্পের ঝুঁকি বাড়ার সঙ্গে কোনোভাবে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়া যায় কিনা তাও খতিয়ে দেখা।

বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের ওয়েবসাইটে ভূমিকম্প এবং সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে আরও বিশদ বিবরণ যোগ করা উচিত, যাতে দেশের মানুষ এ বিষয়ে আরও জানতে পারেন। ভূমিকম্পের ঝুঁকি সম্পর্কিত গবেষণা এবং এর ফলাফলগুলো ব্যবহার করে কীভাবে এই ঝুঁকি থেকে উত্তরণ মিলবে, এ ব্যাপারে আমাদের দেশের সব শ্রেণির গবেষকদের এখনই নজর দেওয়া দরকার।

লেখক: গবেষক (এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ), বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল রিসার্চ ট্রাস্ট

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
অতিরিক্ত ঘাম কমাতে এই ১১ টিপস মেনে চলুন
অতিরিক্ত ঘাম কমাতে এই ১১ টিপস মেনে চলুন
এক মার্কিন-ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দেবে হামাস
গাজায় যুদ্ধবিরতির চেষ্টাএক মার্কিন-ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দেবে হামাস
একাত্তরে গণহত্যায় সহযোগিতায় অভিযুক্তদের রাজনৈতিক অবস্থান ব্যাখ্যার আহ্বান এনসিপি’র
একাত্তরে গণহত্যায় সহযোগিতায় অভিযুক্তদের রাজনৈতিক অবস্থান ব্যাখ্যার আহ্বান এনসিপি’র
আসন্ন বাজেটে নতুন কী থাকছে
আসন্ন বাজেটে নতুন কী থাকছে
সর্বশেষসর্বাধিক