X
সোমবার, ২০ মে ২০২৪
৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

চাকরির শুরু এবং শেষ হোক আনন্দময়

পলাশ আহসান
০৯ মে ২০২৪, ১৯:১১আপডেট : ০৯ মে ২০২৪, ১৯:১১

সরকারি চাকরির বয়স ৩০ বছর থেকে বাড়িয়ে ৩৫ করার দাবিতে আন্দোলন চলছে দীর্ঘদিন। এই দাবির সঙ্গে একমত হয়ে সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী সুপারিশ করেছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। চাকরির এই বয়সসীমা নিয়ে নানা মত-দ্বিমত রয়েছে। নানা বিবেচনায় ঢোকার বয়স বাড়ানোর পক্ষেই যুক্তি বেশি। তবে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের মেয়াদ নিয়ে যত কথা হচ্ছে, অবসর নিয়ে কিন্তু এত কথা হচ্ছে না। যদিও দুটো বিষয় ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই আলোচনা যেহেতু উঠেছে, সেহেতু দুটো বিষয় নিয়ে একসঙ্গেই হওয়া দরকার ছিল।  

এরইমধ্যে জনপ্রশাসনমন্ত্রী সংসদে জানিয়েছেন চাকরিতে প্রবেশের বয়স নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হবে, পর্যালোচনা হবে। কারণ এটা নীতিগত সিদ্ধান্তের বিষয়। আমিও এই ‘পর্যালোচনা’ থেকেই লেখাটি শুরু করতে চাই। পাশাপাশি আমার আলোচনায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের একটি দাবিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে চাই। সেটা হলো ‘বয়স নয়, যোগ্যতাই চাকরির প্রধান বিবেচ্য হওয়া উচিত’। তাই আসলেই চাকরির নীতিমালা নিয়ে এখন সূক্ষ্ম আলোচনা পর্যালোচনা হওয়া দরকার।

১৯৯১ সালে চাকরির বয়সসীমা ২৭ থেকে ৩০ বছর করা হয়। যখন গড় আয়ু ছিল ৫৭ বছর। এখন গড় আয়ু বেড়ে ৭৩ বছর হয়েছে। তাই চাকরিতে প্রবেশ এবং অবসরের মেয়াদ বাড়াতে নীতিগত কোনও বাধা থাকার কথা নয়। কারণ আমরা বারবার বলছি জনশক্তিকে রাষ্ট্রশক্তিতে রূপান্তর করতে হবে। ২০ কোটি মানুষের দেশে জনশক্তিই প্রধান সম্পদ সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা দরকার। আমার মনে হয় এই বয়স নির্ধারণের বিষয়টি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনারই অংশ।

সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোয় কোনও সমস্যা দেখছেন না সরকারি কর্ম কমিশন-পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান ইকরাম আহমেদ। তিনি সেইসঙ্গে অবসরের বয়সও বাড়ানোরও পক্ষপাতী। গণমাধ্যমে তিনি বলেছেন, অনেকেই সময়মতো পড়ালেখা শেষ করতে পারে না। আবার সরকারি চাকরির পরীক্ষা জটিলতায় অনেকের বয়স বেশি হয়ে যায়। আবার কোনও চাকরিজীবী যদি সুস্থ থাকেন এবং বয়সের বাধ্যবাধকতার কারণে তিনি অবসরে চলে যান, তখন তার অভিজ্ঞতা থেকে প্রতিষ্ঠান বঞ্চিত হয়।

আবার চাকরির বয়স বাড়ালেই কোনও মানুষ চাকরি জোগাড় করে ফেলতে পারবেন, তেমনটা নয় বলে মন্তব্য করেছেন বেসরকারি সংগঠন ব্র্যাকের মাইগ্রেশন অ্যান্ড ইয়ুথ প্ল্যাটফর্মের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান। তিনি বলেন, কেউ ৩০ বছরের মধ্যে চাকরি পেলে তারুণ্যের সুবিধা পান। প্রশিক্ষণসহ সব কাজে একটা গতি পান। বয়স ৩৫ হলে তার কাজের আগ্রহ কমতে থাকে। যে কারণে তিনি তারুণ্যের শক্তির অপচয় না করার পরামর্শ দিয়েছেন।

আমাদের সামনে যে পর্যালোচনার সুযোগ এসেছে তাতে বলা যায়, আমাদের চাকরিতে প্রবেশ এবং অবসরের বয়স হওয়া উচিত কাজের ধরন অনুযায়ী। তারুণ্যের দুর্বার গতির প্রতি সব রকম আস্থা রেখেই বলছি, অভিজ্ঞতার মূল্যও কম নয়। কারণ বাস্তবতা আমাদের প্রতিমুহূর্তে শেখায়। যিনি একদিনের বড়, স্বাভাবিক নিয়মে তিনি একদিন বেশি শিখেছেন। যে শিখনের দাম বোঝা যায় প্রতি পদে পদে। তাই আমাদের এমন একটা পদ্ধতি দরকার, যেখানে তারুণ্য এবং অভিজ্ঞতার সম্মিলন ঘটানো যায়।

পাঠক চলেন আমরা দেখে নিই সাধারণ একজন সাধারণ মানুষের চাকরি জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। একজন শিক্ষার্থীর লেখাপড়া শেষ হয় ২৫ বছর বয়সে। তার সরকারি চাকরির বয়স থাকে ৩০ বছর পর্যন্ত। চাকরি শেষ করেন ৫৯ বছর বয়সে। আমরা বলতে পারি তার কর্মজীবনের মেয়াদ ২৫ থেকে ২৯ বছর। প্রায় একই সময়ে তাকে সংসার জীবনে ঢুকতে হয়। পরিবারের দায়িত্ব নিতে হয়। বাবা হতে হয়। সন্তানরা বড় হতে হতে চাকরি শেষ। সংসারের দায়িত্ব কিছুটা হালকা হওয়ায় স্বস্তি পান হয়তো, কিন্তু ভাবতে থাকেন তার প্রতিষ্ঠানকে আরও কিছু দেওয়ার ছিল হয়তো।

কিন্তু আমাদের বর্তমান যে পদ্ধতি আছে, সেখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির নামে কেউ অবসর নিলে ভাবা হয় যাক, আরেকজন কাজের সুযোগ পেলো। এজন্য একসময় গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের নামে স্বেচ্ছা অবসর পদ্ধতিও চালু করা হয়েছিল। তখন আমাদের গড় আয়ু ছিল ৫৭ বছর। এখন তো পরিস্থিতি বদলেছে। স্বাস্থ্য অবকাঠামোর উন্নয়নে আমাদের গড় আয়ু ৭৩। নতুন করে ভাববার সময় নিশ্চয়ই এসেছে। অর্থনীতির নানা বাঁক বদলে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরি হচ্ছে। সেসব প্রতিষ্ঠানে কাজের ক্ষেত্র বাড়ছে। নতুন একটা ছেলে বা মেয়ে যদি তার স্বাভাবিক গতিতে কাজ করতে পারে এবং সে যদি একজন প্রবীণের দিকনির্দেশনা পায়, তাহলে নিশ্চয়ই কাজটি একটি নতুন মাত্রা পায়।

এবার আসি চাকরিতে ঢোকার বয়স সীমার কাছে। এখন ঢোকার মেয়াদ আছে ৩০। দাবি করা হচ্ছে ৩৫। আমার ব্যক্তিগত মত চাকরিতে ঢোকার বয়সে কোনও মেয়াদ থাকা উচিত না। এক্ষেত্রে যোগ্যতা হওয়া উচিত তিনি কর্মক্ষম বা সুস্থ কিনা। ধরা যাক, একজন মানুষ কোনও একটি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। তিনি সেই বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। গবেষণা করেছেন, বই লিখেছেন, কিন্তু চাকরি করেননি। হঠাৎ তাঁর মনে হলো তিনি চাকরি করবেন কিংবা সরকারিভাবে তার নিবিড় সহায়তা দরকার হলো। কিন্তু চাকরির বয়স নেই। এরকম মানুষের সহায়তা নিতে হলে তাকে কাজ দিতে পারে প্রতিষ্ঠানগুলো। কিছু সম্মানি হয়তো দিতে পারে, কিন্তু নিয়মিত চাকরির সুবিধা দিতে পারে না। 

আমার লেখা পড়ে যে কারও মনে হতে পারে, আমি জানি না চাকরির সুযোগ যতই বাড়ুক, চাহিদার তুলনায় তা সবসময় সীমিত। পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর ৪-৫ লাখ শিক্ষার্থী পড়ালেখা শেষ করে চাকরির বাজারে আসে। যেখানে প্রতিবছর সরকারি চাকরিতে কর্মসংস্থান হয় ৪-৫ হাজার প্রার্থীর। এছাড়া সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে আরও ২-৩ হাজার কর্মসংস্থান হয়। এই বাস্তবতাও আমাদের অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তাই নিয়মিত বিরতিতে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে নতুন ছেলেমেয়েদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিরও দরকার রয়েছে। 

ভারতে সরকারি চাকরিতে আবেদনের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩৫ থেকে ৪৫ বছর। কাতার, তাইওয়ান, ইতালিতে ৩৫ বছর। ফ্রান্সে ৪০ বছর। শ্রীলঙ্কা ও ইন্দোনেশিয়ায় ৪৫ বছর। সুইডেন ও কানাডায় ৪৭ বছর। আর যুক্তরাষ্ট্রে ৫৯ বছর। এই উদাহরণ দেখে আমরা বলতে পারি, শুধু বয়স দিয়ে বিচার করে কর্মসংস্থান সমস্যার সমাধান করা যায় না। আসলে দরকার প্রতিটি কর্মীর কাজের আনন্দ নিশ্চিত করা। সেই আনন্দ কর্মজীবনের শুরুতে যেমন দরকার, শেষেও দরকার। সার্বিক বিবেচনায় একজন কর্মীর আসলেই যখন বিশ্রামের সময় হবে তখন তিনি যদি অবসরে যেতে পারেন, নিশ্চয়ই আনন্দ পাবেন। আর এই আনন্দ অনেকটাই নির্ভর করে তিনি কীভাবে কাজটি শুরু করেছিলেন তার ওপর। তাই আমার মনে হয় চাকরির বয়স নিয়ে কোন গড় সিদ্ধান্তে না গিয়ে যদি কাজ অনুযায়ী বিবেচনায় আনা হয়, তাহলেই পুরো বিষয়টি একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মধ্যে আসবে।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বিএসটিআই’কে আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠানে রূপ দিতে কাজ করছে সরকার: শিল্পমন্ত্রী
বিএসটিআই’কে আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠানে রূপ দিতে কাজ করছে সরকার: শিল্পমন্ত্রী
কুমিল্লায় ট্রাকচাপায় দুই মোটরসাইকেল আরোহী নিহত
কুমিল্লায় ট্রাকচাপায় দুই মোটরসাইকেল আরোহী নিহত
বাজেট অধিবেশন ৫ জুন থেকে
বাজেট অধিবেশন ৫ জুন থেকে
বিলুপ্তপ্রায় গন্ধগোকুল আহত অবস্থায় উদ্ধার
বিলুপ্তপ্রায় গন্ধগোকুল আহত অবস্থায় উদ্ধার
সর্বশেষসর্বাধিক