‘বিপ্লবে বলীয়ান নির্ভীক জবিয়ান’ শ্লোগানে ২০ অক্টোবর ২০২৪ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উদযাপিত হচ্ছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমসাময়িক অনেক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এদেশে। তবে অন্য কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ই এত অল্প সময়ে দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় বিদ্যাপীঠ হিসেবে স্থান করে নিতে পারেনি। এক ঝাঁক তরুণ মেধাবী শিক্ষক; আর জীবনের নানা বাঁকে সঞ্চিত অভিজ্ঞতার ডালা সাজিয়ে বসা খ্যাতিমান অধ্যাপকের পদভারে মুখরিত এই বিদ্যাপীঠ অল্পসময়েই ভর্তিচ্ছুকদের প্রথমদিকের পছন্দের তালিকায় নাম লিখিয়েছে। তাই প্রতিবছরই এই বিদ্যাপীঠে মেধাবী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে।
গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষার ফাঁদে ভর্তি ইচ্ছুক শিক্ষার্থীরা নানা জটিলতায় পড়লেও এখনও ভর্তি ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের অন্যতম পছন্দ এই বিদ্যাপীঠ। জুলাই বিপ্লবের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজস্ব শিক্ষক থেকে উপাচার্য নিযুক্ত লাভ করায় আগামী বছর থেকে আবারও স্বতন্ত্র ভর্তি পরীক্ষায় ফিরবে বলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আশা করে। গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে এমসিকিউ পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তে লিখিত পরীক্ষা চালু ছিল। পুনরায় ওই পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষা হলে আবারও স্বমহিমায় ফিরবে এই বিদ্যাপীঠ। ভর্তিচ্ছুকদের কাছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আকর্ষণ আরও বাড়বে। এবারের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে দেশের নানা প্রান্ত থেকে আগত নতুন শিক্ষার্থীদের পদভারে এই বিদ্যাপীঠের ক্যাম্পাস মুখরিত হচ্ছে। কারণ এবারই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ক্লাস প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর দিন শুরু হচ্ছে। র্যাগিং রোধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কঠোর মনোভাবে ও বিপ্লব পরবর্তী শিক্ষার্থীদের সচেতনা বৃদ্ধি পাওয়ায় এবার বাংলাদেশের র্যাগিংমুক্ত প্রথম ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠার পথে এই বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে যাবে এমনটিই আমরা আশা করি।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এগিয়ে যাচ্ছে জ্যামিতিক হারে। এই বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীরা নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবিলা করেও স্নাতক সম্মান শেষেই চাকরির বাজারে অভাবনীয় সফলতা পেয়েছে। বিসিএস পরীক্ষায়ও তাদের সাফল্যের হার ঈর্ষনীয়। সাংস্কৃতিক কার্যক্রমেও পিছিয়ে নেই এই বিশ্ববিদ্যালয়। চারুকলার কার্যক্রম চালু, পহেলা বৈশাখ, বসন্ত উৎসব এবং ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রগতিশীল দিবসগুলো উদযাপনের মাধ্যমে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে পুরনো ঢাকায় একটি সাংস্কৃতিক বলয় গড়ে উঠেছে। যা এই বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রগতিশীলতা চর্চার অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত করেছে। বর্তমান উপাচার্যের সময়েও ওই ধারা অব্যাহত থাকবে বলে আমরা আশাবাদী হতে চাই।
দুই.
অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শূন্য থেকেই পথ চলা শুরু করেনি। এর রয়েছে এক গৌরবজ্জল ইতিহাস। পাঠশালা থেকেই যার যাত্রা শুরু হয়েছিল সেই ১৮৬৮ সালে। বর্তমান জগন্নাথ ক্যাম্পাস যেখানে অবস্থিত সেই জায়গায় এই পাঠশালা প্রতিষ্ঠা করেন বালিয়াটির জমিদার জগন্নাথ রায় চৌধুরী। জগবাবুর পাঠশালাকে ১৮৮৪ সালে কলেজে উন্নীত করেন জমিদার জগন্নাথ রায় চৌধুরীর সুযোগ্য পুত্র জমিদার কিশোরীলাল রায় চৌধুরী। এবার ব্রিটিশ সরকারের নেক নজর পড়লো এই বিদ্যাপীঠের ওপর। ওই বছরই ব্রিটিশ সরকার এই বিদ্যাপীঠকে ‘ঢাকা জগন্নাথ কলেজ’ হিসেবে স্বীকৃত দেয়। অচিরেই ভারতে খ্যাতিমান বিদ্যাপীঠগুলোর মধ্যে এই কলেজ নিজের অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়। ১৮৮৭ সালে স্কুল ও কলেজ শাখাকে পৃথক করা হয়। তখন স্কুলের নাম হয় ‘কিশোরী লাল জুবিলী স্কুল’। শিক্ষাক্ষেত্রে ধারাবাহিক সাফল্যের কারণে ১৯২০ সালে ইন্ডিয়ান লেজিসলেটিভ কাউন্সিল ‘জগন্নাথ কলেজ আইন’ পাস করে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘর পুড়েছিল ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে। ১৯২১ সালে জগন্নাথ কলেজকে অবনমন করা হয় ভারতীয় লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে ‘জগন্নাথ কলেজ অ্যাক্ট’ পাস করে। এই আইনের ফলে এই বিদ্যাপীঠকে ‘জগন্নাথ ইন্টারমিডিয়েট কলেজ’ নামকরণ করে এর স্নাতক পর্যায়ে পাঠদানের ক্ষমতা রহিত করা হয়। ওই ঘটনার ২৮ বছর পর এর বন্ধ দুয়ার খুলেছিল। ১৯৪৯ সালে এই বিদ্যাপীঠে পুনরায় স্নাতক পর্যায়ে পাঠদান শুরু হয়।
ভাষা আন্দোলনসহ স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি স্তরে এবং সদ্য সংঘটিত জুলাই বিপ্লবে এই বিদ্যাপীঠের অসামান্য অবদান রয়েছে। স্বাধীনতার পূর্বে জগন্নাথ কলেজের ছাত্র শিক্ষকদের আন্দোলনে, মিছিল-মিটিং-শ্লোগানে পাকিস্তানিদের দোসর মোনেম খানের গদি টলমল করছিল। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনেম খানও কম যান না। তিনিও সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। ফন্দি আঁট ছিলেন কিভাবে শায়েস্থা করা যায় এই বিদ্যাপীঠের ছাত্র-শিক্ষকদের। ১৯৬৮ সালে এক দুরভিসন্ধিমূলক চক্রান্তে আর তৎকালীন অধ্যক্ষ ইরশাদুল্লাহর বুদ্ধিহীনতায় জগন্নাথ কলেজকে নিয়ন্ত্রণ করার একটা জুতসই মওকা পেয়ে গেলো সরকার। সরকার সমর্থিত গুন্ডা ছাত্র সংগঠন এনএসএফ এর সাথে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়েনের সংঘাতে শেষ পর্যন্ত জগন্নাথ কলেজ বন্ধ হয়ে যায়। খুলল মাস ছয়েক পরে একেবারে সরকারি কলেজ হয়ে। সরকারি করণের মাধ্যমে স্বাধিকার আন্দোলনের অন্যতম এই বিদ্যাপীঠে সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। এর ডিগ্রি স্তরকে ছাঁটাই করে মহাখালিতে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই নবীন কলেজের নাম দেওয়া হয় ‘জিন্নাহ কলেজ’ (বর্তমান তিতুমীর কলেজ)।
স্বাধীন বাংলাদেশে এই বিদ্যাপীঠ আবার মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার সুযোগ পায়। সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হওয়া স্বত্ত্বেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এই বিদ্যাপীঠের ছাত্র-শিক্ষকরা অসামান্য অবদান রেখেছিল। ফলে ১৯৭২ সালে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক ইউসুফ আলীর আগ্রহে পুনরায় এই বিদ্যাপীঠে উচ্চস্তরের পড়ালেখা চালু হয়। ওই সময়ে এই বিদ্যাপীঠ অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স খোলার অনুমতি পায়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশের অন্য অনেক কলেজের মতো এই কলেজও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজ ছিল। ১৯৯১-৯২ শিক্ষাবর্ষ থেকে একে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ন্যাস্ত করা হয়।
২০০৫ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার উদ্যোগে মহান জাতীয় সংসদে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন (২৭ সেপ্টেম্বর ২০০৫) পাস হয়। জগবাবুর পাঠশালা থেকে এই বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হয়। পূর্বের নামের ধারাবাহিকতায় নামকরণ করা হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
এই বছর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে ভেঙ্গে ফেলা নামফলক পুনরায় স্থাপন করে ন্যায্যতার যে পরিচয় দিচ্ছে তা সাধুবাদ পাবে। ইতিহাসে যার যা অবদান তা স্বীকার করার শিক্ষাই শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া উচিত। এবারের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ভবনের সামনে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা বেগম খালেদা জিয়ার নামাঙ্কিত ওই নাম ফলক স্থাপনের মাধ্যমে ঐতিহাসিক সত্য উদ্ভাসিত হবে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে ডিসেম্বরের বিজয় দিবসের আগেই জুলাই বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে পুড়িয়ে বিকৃত করে ফেলা বঙ্গবন্ধুর মূর্যাল সংস্কার করে তা যেন স্বমহিমায় ফেরানো হয় সেই অনুরোধও রইলো। জুলাই বিপ্লবের অন্যতম শ্লোগান ছিল দল নিরপেক্ষ প্রশাসন। বঙ্গবন্ধুর মূর্যাল সংস্কারের মাধ্যমে প্রশাসনের সেই দল নিরপেক্ষতা উদ্ভাসিত হবে।
তবে প্রতিষ্ঠার পর থেকে হল না থাকায় এই বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীদের ব্যয় বহুল ঢাকা শহরের নানা মেছ-বাসা-বাড়িতে কষ্টে দিনাতিপাত করতে হয়। প্রিয় মেধাবী শিক্ষার্থীদের দিকে তাকালে বড্ড কষ্ট হয়। কাক ডাকা ভোরে উঠে যাদেরকে ক্যাম্পাসের বাস ধরতে হয়। আর ক্লাস থাক আর না থাক কাঠফাটা রোদে এখানে সেখানে ঘুরে-ফিরে ফিরতে হয় পড়ন্ত বিকেলে। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ক্লান্ত দেহ-মন পড়তে বসতে সায় দেয় না। হল না থাকায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হওয়া স্বত্ত্বেও তাদের বাড়তি খরচ করতে হয়। তাই সেই টাকা জোগাড় থেকে গরিব পিতাকে নিস্কৃতি দিতে ক্লাস শেষে ছুটতে হয় টিউশনি পানে। এভাবে রচিত হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষার্থীর দিনলিপি। একটি মাত্র ছাত্রী হল থাকলেও তা চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট নয়। তাই বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন হল উদ্ধারের পাশাপাশি সদ্য ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে একনেকের ১৪৬ তম সভায় ১ হাজার ৯২০ কোটি ৯৪ লাখ ৩৯ হাজার টাকা ব্যয়ে ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস স্থাপন: ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়ন’ প্রকল্প অনুমোদিত হয় তার দ্রুত বাস্তবায়ন করবেন এমনটিই আমাদের দাবি। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হলে থাকার স্বপ্নও পূরণ হবে। দীর্ঘদিনের বঞ্চনা-বৈষ্যম্যের ইতিহাসের অবসান হবে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান সমস্যা দুর্নীতি এবং আইনের শাসনের অভাব। বিগত উপাচার্যরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে দুর্নীতিমুক্ত করতে পারেননি। তাদের অনেকে নিজেও দুর্নীতিতে-অনিয়মে জড়িয়েছেন। বিগত সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের শাসন ছিল না বললেই চলে। জোর যার মুল্লুক তার নীতিতে বিশ্ববিদ্যালয় চলেছে। বহিরাগত উপাচার্যরা ক্ষমতার চেয়ার টিকিয়ে রাখার জন্য এই বিষয়ে ছিলেন চরম উদাসীন। কিন্তু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এখন নিজেদের উপাচার্য পেয়েছে। তাই জুলাই বিপ্লবের নবযাত্রায় নবকল্লোলে দুর্নীতি মুক্ত ক্যাম্পাস ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মন্ত্রে উজ্জীবিত হোক আগামীর পথচলা প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে আমাদের এমনই প্রত্যাশা।
শুভ জন্মদিন, ভালোবাসার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়!
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।