X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

করোনাকাল: নারীর ‘কৈ মাছের প্রাণ’

ফাতেমা শুভ্রা
০৫ মে ২০২০, ১৭:০১আপডেট : ০৫ মে ২০২০, ১৭:০২

ফাতেমা শুভ্রা ঢাকা শহরে মিরপুর একটি বড় জায়গা, আর সেটি করোনাভাইরাসের এই সময় সংক্রমণের অংশ হিসেবে বিশেষায়িত অঞ্চল বলে চিহ্নিত। আমি মিরপুরের যে এলাকায় থাকি, সেটি নিয়ে একসময় নাটক হয়েছে। দুর্দান্ত অভিনেতা খালেদ খান অভিনয় করেছেন—ওই যে রূপনগর এলাকা। এই এলাকার বড় বড় গার্মেন্টস স্থানান্তরিত হয়ে বিভিন্ন স্থানে চলে গিয়েছে। একটি বড় গার্মেন্টস রয়ে গেছে। বিজিএমইএ’র গার্মেন্টকর্মীদের কাজে যোগদানের আহ্বানে ঢাকায় আসা শ্রমিকদের এক অংশ আমাদের এলাকায় বাড়ির আশপাশের রাস্তাগুলোতে জড়ো হয়। শখে নয়, কষ্টে! সকালবেলা যখন কিনা মধ্যবিত্ত পরিবারের অধিকতর সুখী মানুষজন ঘুমিয়ে থাকেন, যেমন ধরেন ‘বেটা মানুষ যারা ঘরের কাজ তেমন করেন না কিংবা যাদের বাড়িতে কমবেশি বান্ধা বুয়া আছেন’ সেসময় থেকেই রাস্তায় ৩/৪ জন নারী সন্তান সমেত বসে থাকেন। আর ছোট ছোট শিশুরা কান্না করতে থাকে খাবারের জন্য। দুপুরের আগে আগে যখন আমি বারান্দায় কাপড় নেড়ে দিতে যাই তখন এই সকল বেতন ও সেই কারণে টিনশেডের ভাড়া দিতে না পারা মানুষের বাড়িওয়ালার কাছ থেকে পাওয়া গঞ্জনার মাত্রা বাড়তে থাকে, বাড়তে থাকে বাচ্চাদের কান্না, চাল না থাকার দীর্ঘশ্বাস এবং তারপর কোনও না কোনও মাত্রায় প্রহার। সড়কের পাশে কেউ হয়তো ছেঁড়া কাঁথা নিয়ে বসে গেছে সেলাই করতে, কেউ হয়তো শিশুকে মারছে, শোনা যায় উঁচু দালান থেকেই যে মোবাইলে কোনও একজন বারবার কাউকে জানাচ্ছে যে, কারখানা জানিয়েছে আরও ৭/১০ দিন সময় লাগবে বেতন দিতে।

জরুরি অর্থসংক্রান্ত কাজে সরকারি ব্যাংকে গিয়ে ভিড়ের কারণে ফেরত আসতে হলো। বাড়ির কাছের এক বেসরকারি ব্যাংকে কাজ সারবো। মোটমাট তিনজন ৪০ ছুঁইছুঁই নারী খুব ব্যতিব্যস্ত হয়ে এসেছেন। কোনোভাবেই সংসারের খরচের কুলকিনারা করতে পারছেন না। বহু বছরের পুরনো এফডিআর ভাঙতেই হবে। হাজার কিংবা পাঁচশ’ টাকার এফডিআর ম্যাচিউর হয়নি, কিন্তু ৪/৫ লাখ টাকা জমা হয়েছে। এই বিশাল টাকা কোথায় রাখবেন? কারণ নারীর ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট নেই, কিন্তু ঘরে চাল-ডাল নেই। ৩ জন নারীই দিশেহারা হয়ে কাস্টমার কেয়ারে বসে থাকা অপর এক নারীর সঙ্গে সমাধানের পথ বের করবার লক্ষ্যে কথা বলতে লাগলেন।

২.

করোনাভাইরাস আমার কাছে প্রকৃতপক্ষে একটি মানবসৃষ্ট বিপর্যয়। প্রতিবেশ পরিবেশের প্রতি অপরাপর সংস্কৃতি ও জীবের প্রতি সংবেদনশীল ও সভ্যতার জয়ের যে মশকারা, সেটাই আদতে করোনাভাইরাস। আমি মনে করি এই ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকা ছাড়া আদতেই সম্ভব না। তারবাদে অরণ্য জীব ও প্রাণী-উন্নয়ন ও মানুষ যাবতীয় ক্ষমতা সম্পর্ক শাসন ও শোষণের যতরকম বড় বড় বুলি ও কথাগুলো আমরা প্রতিদিন নিজেদের জীবনে-যাপন করি আউড়াই, এসব কিছুকেই বারবার ভাববার বিবেচনা করবার প্রয়োজন আছে।

ঘরে গৃহস্থালী কর্মী হিসেবে যে নারী কাজ করতেন তারা কেউ কেউ বাড়ি গিয়েছেন। একজন বলছিলেন, ‘আপা আমি তো ঢাকায় ফাইস্যা গেছি...করোনা কি খালি আমগোর হইবো? যে ঘরে ঢুকবার নিছে না? বড়লোকের এই রোগ হয় না নাকি ‍শুনছি?’ মধ্যবিত্তের মধ্যে যেসব পুরুষ, কোনও কোনও ক্ষেত্রে নারীর চাকরি করোনার সময়ে যায়নি কিন্তু বাসায় থেকে অফিস করতে হয়েছে/হচ্ছে। সেখানে আমরা বড় বড় স্লোগান দিচ্ছি—‘ঘরের কাজে সাহায্য করুন’/ ‘নারীর পক্ষে থাকুন’/‘পুরুষ তুমি মানবিক হও’।

বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা একাধিকবার রিপোর্টে বলছে যে করোনার এই গৃহবাস (যাদের ভাত খাবারের চিন্তা নাই আর কী) কিংবা গৃহবন্দি সময়ে (যারা অনন্যোপায়) নিবিড় সম্পর্কের নির্যাতন বহুগুণ বেড়ে গেছে (পরিসংখ্যানে এখনও স্পষ্ট না করা গেলেও নারী ও শিশু নির্যাতন করোনাকালে যে গৃহবন্দি ও গৃহবাসী নারীর ওপর বৃদ্ধি পেয়েছে, সেটি আন্তর্জাতিকভাবেই বারবার উচ্চারিত হচ্ছে)। ডমেস্টিক ভায়োল্যান্স বলতে মূলত আমরা বিবাহিত নারীর প্রতি তার বিবাহিত ‘স্বামীর’ ‘শারীরিক’ নির্যাতনকেই বুঝি। কিন্তু আরও আরও চেনা পরিসরে আরও আরও চেনা সম্পর্কে শারীরিক চড় থাপ্পড় এমনকি যৌন হয়রানির ভিকটিম যে নারী ও শিশু হচ্ছে, সেসব আবছা হয়ে যাচ্ছে। ‘অনুচ্চারিত’ এই সকল ক্ষতি বাদে মানসিক যে নিপীড়নগুলো হচ্ছে—সেসব এর কথা করোনাকাল বাদে অন্য ‘সাধারণ’ সময়েই বাংলাদেশে গৃহীত হয় না, আর এখন তো বিশেষ সময়!

৩.

বিশেষ সময়ে আমরা নারী ও শিশু কিংবা লিঙ্গীয় বিষয় নিয়ে কথা বলবার মতো একটি পরিসরই পাবো না। কারণ এখন তো গুরুতর একটি দুর্যোগ চলছে, আপনি বাংলাদেশে চৌকশ এমন অনেক বুদ্ধিজীবী কিংবা আকর্ষণীয় বক্তা পাবেন যারা ভাবেন সবকিছু নিয়ে ভাবলেও কেবল লিঙ্গীয় বিন্যাস নিয়ে এই মূহূর্তে ভাবাটাকে বাহুল্য হয়ে উঠতে পারে। কারণ যেখানে খাবার নাই সেখানে তো লিঙ্গীয় সমতা দূরের ভাবনার বিষয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো, মিডিয়ায় কিংবা লেখালেখিতে বুদ্ধিজীবী নারী এই করোনাকালে কি সরব হতে পেরেছে? মানে বলতে চাইছি কত শতাংশ হারে নারীর ওপর এতদিন ধরে যেসব কাজ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় অন্য কেউ করে দেবে বলে নারী পাবলিক ক্ষেত্রে কাজ করতে সক্ষম হচ্ছে, সেই বাচ্চা দেখা, রান্না করা, ঘর পরিষ্কার (বিশেষভাবে) সন্তানকে পড়াশোনা করা, বাজার রাখা ইত্যাদি ইত্যাদি কাজ সম লিঙ্গীয় শ্রম বিভাজনের মধ্যে পড়ছে?

যদি পড়তোই তবে সামাজিক দৃশ্যগত মাধ্যমগুলোতে ট্রল হতো না যে একটি পুরুষ ঘরে করোনাকালে বন্দি হয়ে কত কত ভাবে নারী স্ত্রী কর্তৃক নিপীড়িত। নিপীড়নের সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণযোগ্য ধরনগুলোও খুব মজার ও গুরুত্বপূর্ণ—বাসনকোসন মাজতে বলছে, রান্না করতে বলছে। যদি এই কাজগুলোই এতোই সমস্যাজনক ও চাপের হয়, নারী বিভিন্ন শ্রেণি ও বয়সে দিনের পর দিন কীভাবে এই কাজগুলো করছেন? সেসব প্রশ্ন আমরা কী করতে পারি?

৪.

নারী পুরুষের তুলনায় কম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে। এরকম বার্তাও সংবাদমাধ্যমে চৌকশ পাঠক আকর্ষণ করায়। কারণ এই বড় বড় শিরোনামই আদতে শ্রমিকের মতো করে ফ্রন্ট লাইনে সকল ক্ষেত্রে নারীর ব্যবহারকে খুব স্বাভাবিক ও গ্রহণযোগ্য করে। নারীর কাজ সাধারণ ও প্রদত্ত মনে হয়। নারী সহজে বীর হয় না—যেমন মুক্তিযুদ্ধের সময় বীরাঙ্গনা মর্যাদার হয় না বরং মুক্তিযোদ্ধা হয়। কারণ বীরাঙ্গনা কিংবা মুক্তিযোদ্ধার সংসারের দায় নেওয়া স্ত্রী কেবল তো শরীরে খেটেছে। ফলে চিকিৎসা মাধ্যমে প্রথম করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন পুশও হয় একজন নারীর দেহে, ওনাকে বীর বলে অনেক চিৎকার করছে সবাই কিন্তু ওষুধ কার্যকর হলে অর্জন ঘটবে যে গবেষণা করছেন ওনার। নারী কেবলমাত্র ভ্যাকসিনে ব্যবহৃত উপকরণের মধ্যকার একটি।

করোনাভাইরাসের পরবর্তী ঢেউ হিসেবে যে আর্থ-রাজনৈতিক-সামাজিক এমনকি খাদ্য ও বেঁচে থাকার স্থানীয় ও বৈশ্বিক অবস্থার কথা, এমনকি মহামারির কথা পূর্বাভাস হিসেবে বোদ্ধা ব্যক্তিবর্গ বলছেন, তার ভাগও কমবেশি নারী ও শিশুর ঘাড়ে পড়বে। একক পরিবারগুলো এখন সিদ্ধান্ত নেবে কিংবা ঠিকঠাক করতে বাধ্য হবে কে পাবলিক পরিসরে কাজ করবে। সেটি গার্মেন্টস সেক্টরের নারীই বলেন (যে নারী বস্তিতে তার সন্তানকে কোনও এক খালার কাছে রাখেন কিংবা গ্রামে আত্মীয়ের কাছে) কিংবা মধ্যবিত্ত কোনও কোনও অংশে উচ্চবিত্ত যারা শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র, পরিবারের মানুষজন এরকম নানান জায়গায় বাচ্চাকে রেখে, অফিসে নিয়ে গিয়ে, স্কুল পাঠিয়ে ক্যারিয়ার গড়েছেন। আদতে নারী পুরুষের অসমতা সমেত যাবতীয় সকল অসমতা এই করোনাকাল কিংবা যেকোনও মহামারিতে পুনর্বার ধারালো হয়।

পথ দুটো খোলা আছে—এক চোখ বন্ধ করে রেখে যাবতীয় বিষয় নিয়ে কথা না বলে অসমতাগুলোকে বাড়তে দিয়ে একজনের ঘাড়ে মাথা দিয়ে আরেক প্রজাতি টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করা। সে প্রজাতি শ্রেণিতে, বর্ণে, লিঙ্গীয় বিন্যাসে অধিকতর ক্ষমতার কাছাকাছি রয়েছেন এমন। অন্য পথ যাবতীয় অসমতাকে নিয়ে চিন্তা করা। কথা বলা-ক্ষমতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের রাস্তা প্রশস্ত করা।

ব্যাংকে দিশেহারা নারী শেষ পর্যন্ত সংসারের সে বেসামাল দশায় এজেন্ট অ্যাকাউন্টে টাকাগুলো তুলে রাখতে পেরেছিলেন। উনি বলছিলেন, ‘মাইয়াদের প্রাণ কৈ মাছের…সবাই কইতেছে না মাইয়ারা মরে না। আসলে আল্লাহই আমগোরে মারে না...আল্লাহর পাঠানো আমানত আমরা দেইখা রাখি। আল্লাহই আমাদের মজুরি দিবো, খাওয়া দিবো...বেটাদের হাত থেকে আমগোরে বাঁচায়ে রাখবো।’

লেখক: শিক্ষক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

 

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পাঁচ মাস পর অবশেষে মুক্তির বার্তা
পাঁচ মাস পর অবশেষে মুক্তির বার্তা
এমপিপুত্র প্রার্থী হওয়ায় ‘আগুন জ্বলছে’ সেলিম প্রধানের গায়ে
এমপিপুত্র প্রার্থী হওয়ায় ‘আগুন জ্বলছে’ সেলিম প্রধানের গায়ে
ব্রাজিলিয়ানের গোলে আবাহনীতে স্বস্তি
ব্রাজিলিয়ানের গোলে আবাহনীতে স্বস্তি
স্নাতক অনুষ্ঠান বাতিল করল ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়
যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভস্নাতক অনুষ্ঠান বাতিল করল ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ