করোনাভাইরাস উহানের ল্যাবে তৈরি- আমেরিকার এই বয়ান চীন মেনে নেয়নি। এই নিয়ে অন্যরা আমেরিকাকে সমর্থন করছে তাও নয়। কিন্তু এরপরও চীনের প্রতি বিশ্বের বহু দেশের একটু বিরক্তির ভাব এসেছে এখন। নেদারল্যান্ডস, তুরস্কসহ অনেকে চীনের দেওয়া মাস্ক, পিপিইর মতো সুরক্ষা সামগ্রী গ্রহণ না করে ফেরত পাঠিয়েছে। আর পশ্চিমা বিশ্বের বহু দেশ চীন থেকে তাদের পুঁজি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে চীন থেকে জাপানের পুঁজি প্রত্যাহারের জন্য, মানে জাপানি উৎপাদন কেন্দ্রগুলো বন্ধ করতে তাদের কোম্পানিগুলোর জন্য দুই দশমিক দুই বিলিয়ন ডলারের প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন।
জাপান তার বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে তা জাপানে নিয়ে যাবে না। সস্তা শ্রমিকের কথা বিবেচনা করে জাপানসহ পশ্চিমা বিশ্ব একসময় চীনে পুঁজি বিনিয়োগ করেছিল। এখন বিকল্প দেশে, যেখানে এখনও শ্রমিক সস্তা, সেই সব দেশেই তারা তাদের পুঁজি পুনঃবিনিয়োগ করবে। এরমধ্যে ভিয়েতনাম, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশের কথাই সাধারণত সবার আগে বিবেচনায় আসবে। কারণ, এসব দেশ চীনের কাছাকাছি এবং এখনও এসব দেশে পর্যাপ্ত ও সস্তা শ্রমিক আছে। আবার চীন থেকে এসব দেশে কারখানা স্থানান্তরে বিরাট কোনও ঝামেলা পোহাতে হবে না।
করোনা-উত্তর পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জন্য এটি এক অপূর্ব সুযোগ, যার মাধ্যমে সরকার শুধু জাপানি বিনিয়োগ পাবে না, তৈরি হবে চাকরির সুযোগ, প্রযুক্তি লাভের সুযোগ। বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের সম্পর্ক বরাবরই খুবই ভালো। বাংলাদেশের উন্নয়নে জাপানের জাইকার একটা বিশিষ্ট ভূমিকা রয়েছে। এখন প্রশ্ন আসছে বাংলাদেশ কি জাপানি কোম্পানিগুলোকে বাংলাদেশে আনতে দক্ষতা দেখাতে পারবে? কারণ, এটি শুধু জাপানকে আমন্ত্রণ জানাতে বাংলাদেশ কতটা আন্তরিক তার ওপরই নির্ভর করে না, বরং গ্লোবাল কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগকে আমরা কতটা সুরক্ষা দিতে পারবো, সেগুলো ধরে রাখতে আমরা কতটা বুদ্ধিমান- তার ওপর নির্ভর করছে।
তাছাড়া ইতোমধ্যে ভারত চেষ্টা তদবির শুরু করেছে জাপানি বিনিয়োগ যাতে তাদের দেশে যায়। সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিষবাষ্প, বিনষ্ট জাতীয় ঐক্য, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক গোলযোগ ভারতের আকাশকে আসছে দিনে আচ্ছন্ন করবে সন্দেহ নেই। কিন্তু বাংলাদেশ জাপানি বিনিয়োগ ধরার দৌড়ে কোথায় অবস্থান করছে সেটাও দেখার বিষয়।
জাপান বাংলাদেশে নিজেদের একটি ইপিজেড স্থাপনের কথা বলেছিল। দক্ষিণ কোরিয়াকে চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ে দেয়াং পাহাড় সংলগ্ন এলাকায় ইপিজেড করার জায়গা দেওয়া হয়েছে। শুনেছি তার পাশে জাপানকেও ইপিজেড স্থাপনের জমি দেওয়া হবে। বিষয়টা কতটুকু কার্যকর করার উদ্যোগ নিয়েছিল সে সম্পর্কে আমার স্পষ্ট ধারণা নেই। তবে হালের খবর হচ্ছে, এক হাজার কোটি টাকারও বেশি ব্যয়ে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে জাপানি ইকোনমিক জোনের ভূমি উন্নয়নের কাজ শুরু করতে যাচ্ছে সরকার। এক হাজার ৮১ কোটি ৪৫ লাখ টাকার এই প্রকল্পটিতে জমির পরিমাণ প্রায় এক হাজার ১০ একর।
সেখানে জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার সমঝোতা চুক্তিটি সই হয় ২০১৬ সালের ২ মে এবং ২০১৯ সালের ৫ মার্চ একনেকে তা অনুমোদিত হয়। জি-টু-জি-ভিত্তিক এই অর্থনৈতিক অঞ্চলে জাপানি বিনিয়োগকারীদের বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ অন্য সব ইউটিলিটি সুবিধা নিশ্চিত করা হবে। জাপানিজ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের জন্য ইতোমধ্যে ৫০০ একর ভূমি অধিগ্রহণের কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং ভূমির দখল বেজার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
বর্তমানে সরকার ১০০টি ইপিজেড স্থাপনের জন্য নতুন নতুন জায়গা অধিগ্রহণ করছে। দরকার হলে সেখান থেকেও বাংলাদেশ একটা ইপিজেড জাপানকে দিতে পারে। শুধু জাপান নয়, পশ্চিমা বিশ্বও চীন থেকে তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নেবে। এরমধ্যে অ্যাপেলের মতো আমেরিকান কোম্পানির কথাও বলা হচ্ছে। পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গেও আমাদের সরকারের আলোচনা হওয়া দরকার।
গার্মেন্ট বায়াররা ভারতের দিকে ঝুঁকছে। নিশ্চয়ই বাংলাদেশের দিকেও ঝুঁকবে। বেশ কিছু গার্মেন্ট কারখানা এরমধ্যে করোনায় ব্যবহৃত হয় এমন সুরক্ষা সামগ্রী তৈরি করছে এবং রফতানিও করছে। বাংলাদেশ চীনের পরেই পোশাক রফতানিতে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। আমাদের গার্মেন্ট কারখানা মালিকদের সঙ্গে পোশাক আমদানিকারক ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বিদ্যমান। যেসব আদেশ এর মধ্যেই স্থগিত করেছিল বা বাতিল করেছিল তা পুনরায় জীবিত করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে জার্মানির ক্রেতারা বাংলাদেশে কোনও ক্রয়াদেশ স্থগিত বা বাতিল না করার আশ্বাস দিয়েছে।
সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন লোফভেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে টেলিফোন করে আশ্বস্ত করেছেন সুইডেনের কোনও ব্র্যান্ড বাংলাদেশকে প্রদত্ত কোনও ক্রয়াদেশ স্থগিত বা বাতিল করবে না। ইউরোপীয় ইউনিয়নের আরও কয়েকটি দেশ অনুরূপ আশ্বাস দিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৮টি সদস্য রাষ্ট্র বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের প্রায় ৮০% তৈরি পোশাক ক্রয় করে। দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্রেতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে করোনা ক্রমবর্ধমান। আমরা মনে করেছিলাম সরকার বাজার রক্ষার জন্য গার্মেন্ট কারখানার ওপর থেকে লকডাউন শিথিল করবে এবং পরীক্ষামূলকভাবে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে কিছু গার্মেন্ট কারখানা চালু করবে। সেখানেও যে ঝুঁকি থাকবে না তাও নয়। কিন্তু ঈদ উপলক্ষে সরকার বড় মার্কেট খোলার সিদ্ধান্ত দিয়ে বড় রকমের একটা ঝুঁকি গ্রহণের দিকে পা বাড়িয়েছে মনে হচ্ছে।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্যেই ১০ মে থেকে সারা দেশের বিপণি বিতানগুলো খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তকে ভাইরোলজিস্টরাও ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছেন। যেদিন থেকে খোলা হলো সেদিনই দেখা গেল পেছনের ২৪ ঘণ্টার রিপোর্টে দেশে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা একদিনে হাজারের ঘর ছাড়িয়ে গেছে। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে দেশের অর্থনীতি স্থবির হয়ে গেছে এটাও সত্য। সেই প্রেক্ষাপটে বহু মানুষের জীবনধারণের জন্য দোকানপাট খুলে দেওয়াও একটা বাস্তবতা। অবশ্য অনেক মার্কেট ঈদের আগে খুলবে না এমন ঘোষণাও দিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল ব্যবসায়ীরা চাইলে মার্কেট খোলা রাখতে পারবে, তবে তাদের যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। কিন্তু যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি বলতে কী বোঝানো হয়েছে তা স্পষ্ট নয় অনেকের কাছে। যারা এমনিতে নিয়ম-কানুন মানে না তারা ঈদের কেনাকাটায় সেটা মানবে যেমন কেউ বিশ্বাস করে না, তেমনি এই ঘনবসতিপূর্ণ শহরে মানাও কঠিনতর।
বেশিরভাগ দেশবাসীর ধারণা ছিল ঈদের পরেই দোকানপাট খোলার সিদ্ধান্ত হতে পারে। এখন মার্কেট খুলে কোলাহল বেড়ে ঢাকার অবস্থা নিউ ইয়র্কের মতো হলে স্বাস্থ্যসেবার যতটুকু প্রস্তুতি ঢাকায় রয়েছে তা দিয়ে বিপর্যয় সামাল দেওয়া হয়তো অসম্ভব হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
[email protected]