X
বুধবার, ১৯ মার্চ ২০২৫
৫ চৈত্র ১৪৩১

জিম্মিদশার দুর্বিষহ দিনগুলোর কথা জানালেন এমভি আবদুল্লাহর নাবিক

নাসির উদ্দিন রকি, চট্টগ্রাম
২২ এপ্রিল ২০২৪, ১২:১৩আপডেট : ২২ এপ্রিল ২০২৪, ১৮:৫৩

‘দস্যুদের কবল থেকে বেঁচে ফিরবো, কখনও চিন্তাও করিনি। মনে করেছি এ বুঝি আমি শেষ।’ দীর্ঘ ৩১ দিন সোমালিয়ান জলদস্যুদের কাছে জিম্মি থাকার পর মুক্তি পাওয়া এমভি আবদুল্লাহর নাবিক (সাধারণ স্টুয়ার্ড) মোহাম্মদ নুর উদ্দিন কথাগুলো বলেন।

এমভি আবদুল্লাহ রবিবার (২১ এপ্রিল) বাংলাদেশ সময় বিকাল সাড়ে ৪টা নাগাদ সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই আল হারমিয়া বন্দরে নোঙর করেছে। ওই জাহাজে আছেন দস্যুদের কবল থেকে মুক্তি পাওয়া ২৩ নাবিক।

দুর্বিষহ দিনগুলোর কথা স্মরণ করে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার বাসিন্দা মোহাম্মদ নুর উদ্দিন রবিবার (২১ এপ্রিল) রাতে হোয়াটসঅ্যাপে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘১২ মার্চ দুপুরে আমরা জলদস্যুদের কবলে পড়ি। তখন মোজাম্বিকের মাপুটো বন্দর থেকে ৫৫ হাজার মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে দুবাই যাচ্ছিলাম। দস্যুরা বড় একটি মাছ ধরার নৌযান থেকে একটি স্পিডবোট নামায়। পরে স্পিডবোটে করে চার জন-চার জন করে দস্যু আমাদের জাহাজে উঠতে থাকে। প্রথম দিকে মোট ১২ জন দস্যু ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নেয়। আমরা অনেক চেষ্টা করেছি দস্যুরা যাতে জাহাজে উঠতে না পারে। তখন সাগর একেবারেই শান্ত ছিল। বলা যায় পুকুরের মতো। বড় বড় ঢেউ থাকলেও তারা আমাদের জাহাজে উঠতে পারতো না। জাহাজে ৫৫ হাজার মেট্রিক টন কয়লা ছিল। এমনিতেই সাগরের পানি থেকে জাহাজের উচ্চতা কম। যে কারণে অতি সহজেই দস্যুরা জাহাজে উঠে যায়।’

তিনি বলেন, ‘দস্যুরা জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর আমাদের জিম্মি করে ফেলে। অত্যাধুনিক সব অস্ত্র আমাদের মাথায়-বুকে তাক করে রাখে। মনে হচ্ছিল এ বুঝি মেরে দিলো। তাদের (দস্যুদের) নির্দেশনা মেনে জাহাজ নিয়ে যাওয়া হয় সোমালিয়ান উপকূলে। সেখানে নোঙর করার আগে থেকে অপেক্ষমাণ ছিল আরও কিছু দস্যু। তাদের কাছে জাহাজে থাকা দস্যুদের থেকেও ভারী অস্ত্রশস্ত্র ছিল। তারাও জাহাজে ওঠে। তখন সব মিলিয়ে ৩৫ থেকে ৩৮ জন দস্যু ছিল। পর্যায়ক্রমে আরও কয়েকজন দস্যু জাহাজে যুক্ত হয়।’

নুর উদ্দিন বলেন, ‘দস্যুরা আমাদের সবসময় নজরদারিতে রাখতো। আমাদের বুকে কিংবা মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে ভয় আর আতঙ্কের মধ্যে রাখতো। মনে হতো এই বুঝি গুলি করে দিলো। এমনকি জাহাজের বাইরেও আমাদের তাকাতে দিতো না। আমাদের তারা একা চলতে দিতো না। তাদের (দস্যু) মধ্যেও এক ধরনের ভয় কাজ করতো; আমরা কোনও ফন্দি করছি কিনা।’

নাবিকদের পুরো রমজান কেটেছে জিম্মিদশায়

তিনি বলেন, ‘দস্যুদের কবলে পড়ার পর ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি যুদ্ধজাহাজ অনেকটাই আমাদের জাহাজের কাছে চলে আসে। তাদের একটি হেলিকপ্টারও আমাদের জাহাজের ওপর চক্কর দিতে থাকে। তবে দস্যুরা এসবে ভয় পায়নি। যুদ্ধজাহাজ কাছে এলে দস্যুরা আমাদের ওপর বন্দুক তাক করে রাখে। আমাদের জাহাজ থেকে দস্যুদের নেমে যেতে বলেছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌবাহিনী। এমনকি এক থেকে দশ পর্যন্ত কাউন্ট করেছিল। এরপর নৌবাহিনী ফাঁকা গুলিও ছুড়েছে। দস্যুরা আমাদের ওপর বন্দুক তাক করে জাহাজের ক্যাপ্টেন স্যারকে বলতে বলে যাতে যুদ্ধজাহাজ চলে যায়। ক্যাপ্টেন স্যার ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌবাহিনীকে বুঝিয়ে দূরে যেতে বলেন। পরবর্তীতে ভারতীয় নৌবাহিনীর একটি যুদ্ধজাহাজ আমাদের জাহাজটিকে ফলো করে। জাহাজটি কাছে আসতে চাইলে দস্যুরা বলতে থাকে, হামলা করার চেষ্টা করলে এমভি আবদুল্লাহকে উপকূলে তুলে দেবে। আমাদেরও উপকূলে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দিতে থাকে।’

নুর উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের জিম্মি করার পর সবার মোবাইল ফোন নিয়ে নেয় তারা। দস্যুরা আমাদের সবার তালিকা করে মোবাইল ফোন নিয়েছে। আমাদের প্রত্যেককে একটি হলেও মোবাইল ফোন জমা দিতে হয়েছে। যাদের দুটো মোবাইল ফোন ছিল তারা একটা লুকিয়ে রাখে। দস্যুদের চোখ ফাঁকি দিয়ে পরিবার পরিজনসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছি।’

তিনি বলেন, ‘দস্যুরা এক ধরনের কাঠজাতীয় মাদক নিতো। তারা বলেছে, এই মাদক নিলে নাকি তিন দিন পর্যন্ত না ঘুমিয়ে থাকা যায়। আমাদের পুরো রমজান কেটেছে জিম্মিদশায়। আমরা জাহাজে সেহরি-ইফতার করেছি। নিয়মিত নামাজ আদায় করেছি। দস্যুরা মুসলিম হলেও তাদের কেউ রোজা রাখেনি, নামাজ পড়তেও দেখিনি। দস্যুরা অত্যন্ত হিংস্র প্রকৃতির ছিল।’

এই নাবিক বলেন, ‘প্রথম দিকে দস্যুরা আমাদের সঙ্গে অত্যন্ত খারাপ আচরণ করতো। পরে কিছুটা নমনীয় হয়। প্রথম দিকে তারা পেট দেখিয়ে বলতো, মানি মানি। অর্থাৎ তারা টাকার জন্য আমাদের জিম্মি করেছে বলে বোঝাতো। আমরা যখন মুক্তি পাই, সেদিন প্রায় ৬৫ জন দস্যু জাহাজ থেকে নেমে যায়। তারা স্পিডবোট নিয়ে উপকূলে চলে যায়।’

শেষ দিন জাহাজ থেকে নেমে যায় ৬৫ জন দস্যু

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার বাসিন্দা নুর উদ্দিনের পরিবারে রয়েছেন তার মা, স্ত্রী এবং তাদের আড়াই বছরের সন্তান। ২০১৫ সাল থেকে জাহাজে কর্মরত। তিনি বলেন, ‘এত বড় বিপদে কখনও পড়িনি। মনে করেছিলাম বেঁচে ফিরবো না। তবে আল্লাহর রহমতে বেঁচে আছি এটাই শুকরিয়া। আমি দুবাই বন্দর থেকে বাড়ি ফেরার আবেদন করেছি। আমি মানসিকভাবে অনেক দুর্বল। ভিসা জটিলতার কারণে তা হয়ে ওঠে কিনা বুঝতে পারছি না।’

এর আগে, গত শনিবার (১৩ এপ্রিল) সোমালিয়ার সময় রাত ১২টায় (বাংলাদেশ সময় রাত ৩টা) এমভি আবদুল্লাহ জাহাজসহ ২৩ নাবিক জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্তি পায়। এরপরই জাহাজটি দুবাইয়ের উদ্দেশে রওনা দেয়। দীর্ঘ এক মাস নাবিকরা দস্যুদের কাছে জিম্মি ছিলেন।

এমভি আবদুল্লাহ জাহাজটি কবির গ্রুপের এস আর শিপিংয়ের মালিকানাধীন। এস আর শিপিং সূত্র জানিয়েছে, এমভি আবদুল্লাহ জাহাজে প্রায় ৫৫ হাজার মেট্রিক টন কয়লা আছে। গত ৪ মার্চ আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিকের মাপুটো বন্দর থেকে এসব কয়লা নিয়ে যাত্রা শুরু করে জাহাজটি। ১৯ মার্চ সেটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের হারমিয়া বন্দরে পৌঁছানোর কথা ছিল। এর মধ্যে ১২ মার্চ দুপুর দেড়টার দিকে ভারত মহাসাগরে জলদস্যুদের কবলে পড়ে জাহাজটি।

এস আর শিপিংয়ের অধীনে মোট ২৪টি জাহাজের মধ্যে সর্বশেষ যুক্ত হয় এমভি আবদুল্লাহ। ২০১৬ সালে তৈরি এই বাল্ক ক্যারিয়ারটির দৈর্ঘ্য ১৮৯ দশমিক ৯৩ মিটার এবং প্রস্থ ৩২ দশমিক ২৬ মিটার। ড্রাফট ১১ মিটারের কিছু বেশি। গত বছর জাহাজটি এস আর শিপিং কিনে নেওয়ার আগে এটির নাম ছিল গোল্ডেন হক। মালিকানা পরিবর্তনের পর জাহাজের নামও পরিবর্তন করা হয়। নতুন নাম রাখা হয় এমভি আবদুল্লাহ।

/কেএইচটি/এমওএফ/
টাইমলাইন: সোমালিয়ার দস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ
২২ এপ্রিল ২০২৪, ১২:১৩
জিম্মিদশার দুর্বিষহ দিনগুলোর কথা জানালেন এমভি আবদুল্লাহর নাবিক
২১ এপ্রিল ২০২৪, ১৭:৫৪
সম্পর্কিত
জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য পরিচয়ে চাঁদাবাজির সময় দুজনকে পিটিয়ে পুলিশে সোপর্দ
নারায়ণগঞ্জে মাদকবিরোধী অভিযানে হামলা চালিয়ে ৪ মাদক ব্যবসায়ী ছিনতাই, আহত ৩
গাইবান্ধায় শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে বৃদ্ধ আটক
সর্বশেষ খবর
অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনকেই সর্বাধিক অগ্রাধিকার দেবে, আশা তারেক রহমানের
অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনকেই সর্বাধিক অগ্রাধিকার দেবে, আশা তারেক রহমানের
কুড়িগ্রাম জেলা ছাত্রলীগের সম্পাদক সাদ্দাম গ্রেফতার
কুড়িগ্রাম জেলা ছাত্রলীগের সম্পাদক সাদ্দাম গ্রেফতার
জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য পরিচয়ে চাঁদাবাজির সময় দুজনকে পিটিয়ে পুলিশে সোপর্দ
জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য পরিচয়ে চাঁদাবাজির সময় দুজনকে পিটিয়ে পুলিশে সোপর্দ
জামায়াতের আমিরের সঙ্গে ইইউ রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎ
জামায়াতের আমিরের সঙ্গে ইইউ রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎ
সর্বাধিক পঠিত
প্রশাসনে চলছে চাপা ক্ষোভ ও উত্তেজনা
প্রশাসনে চলছে চাপা ক্ষোভ ও উত্তেজনা
সরকারের হস্তক্ষেপে ৭৫% কমলো এয়ার টিকিটের মূল্য
সরকারের হস্তক্ষেপে ৭৫% কমলো এয়ার টিকিটের মূল্য
নাজমুল হাসান পাপনের দেখা মিললো লন্ডনে
নাজমুল হাসান পাপনের দেখা মিললো লন্ডনে
রাজধানীতে ধর্ষণের অভিযোগে যুবককে গণপিটুনি, আহত ১২ পুলিশ
রাজধানীতে ধর্ষণের অভিযোগে যুবককে গণপিটুনি, আহত ১২ পুলিশ
রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় প্রাথমিকের শিক্ষক গ্রেফতার
রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় প্রাথমিকের শিক্ষক গ্রেফতার