‘এতদিন অপেক্ষায় ছিলাম কবে দিনটি আসবে। অবশেষে ঘনিয়ে এসেছে। সোমবার (১৩ মে) সকালেও তার সঙ্গে কথা হয়েছে। বলেছে, আগামীকাল মঙ্গলবার বিকালের দিকে বাড়ি ফিরবে। আমার কী যে আনন্দ লাগছে তা বলে বোঝাতে পারবো না।’ এমন অনুভূতির কথা জানিয়েছেন এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের প্রধান কর্মকর্তা মো. আতিক উল্লাহ খানের স্ত্রী ফিরোজা আজমিন মিনা।
তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যখন তারা দস্যুদের কবলে পড়েছিল, তখন ভাবতাম কখন এই দিন আসবে। কখন মুক্তি পাবে ও বাড়ি ফিরবে। গত দুই মাস ধরে তার বাড়ি ফেরার দিনটি অপেক্ষায় ছিলাম। আমাদের তিন মেয়ে ফাতিমা, উনাইজা ও খাদিজাও অনেক খুশি। আতিক আগেও জাহাজে গিয়েছিল। বেশ কমাস পর পর বাড়ি ফেরে। তখন এমন মনে হয়নি, স্বাভাবিক ছিল। তার এবারের ফেরাটা আমাদের মাঝে অন্যরকম এক আনন্দ নিয়ে আসছে।’
দীর্ঘ অপেক্ষার পর মঙ্গলবার বাড়ি ফিরবেন এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের ২৩ নাবিক। এ জন্য ২৩ নাবিকের পরিবারে চলছে নানা আয়োজন। নিজ নিজ পরিবারে নাবিকদের জন্য চলছে পছন্দের রান্নাও।
এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের সেকেন্ড অফিসার মোজাহেরুল ইসলাম চৌধুরীর মা ফেরদৌস আকতার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার ছেলে এত বড় বিপদ পেরিয়ে কাল বাড়ি ফিরছে, আমার খুব খুশি লাগছে। আল্লাহর কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা আমার ছেলেকে সুস্থ রেখেছেন। ছেলে বাড়ি ফিরছে এ জন্য আমরা খুব ব্যস্ত। ছেলের পছন্দের সব খাবার রান্না করছি। ছেলে আবার মাংস কম পছন্দ করে এ জন্য বাজার থেকে বড় থেকে একটি কাতল মাছ কিনেছি। এটি রান্না করা হবে। সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের ভর্তা এবং মাছ ও মাংস রান্না করা হচ্ছে। ছেলেকে দেখতে আত্মীয়-স্বজনরাও আসবে।’
জাহাজের থার্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. রোকন উদ্দিনের বড় ভাই সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘২০১৮ সাল থেকে রোকন জাহাজে কর্মরত। এত বড় বিপদে কখনও পড়েনি। আমাদের বাড়ি নেত্রকোনা জেলায়। তিন ভাইয়ের মধ্যে সে সবার ছোট। অফিস থেকে বলেছে, আজ দেশে ফিরবে। এরপর বাড়িতে আসবে। আমার ছোট ভাই এত বড় বিপদ থেকে রক্ষা পেয়ে দেশে ফিরছে এটা আমাদের জন্য সত্যি আনন্দের।’
জাহাজটিতে থাকা নাবিক নুর উদ্দিনের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, ‘এত বড় বিপদ থেকে রক্ষা পেয়ে দেশে ফিরছে- কেমন লাগছে তা বলে প্রকাশ করতে পারবো না। কাল আমিও সদরঘাটে যাবো তাকে রিসিভ করতে। এরপর তাকে সঙ্গে করে বাড়ি নিয়ে আসবো।’
তিনি বলেন, ‘এর আগেও সে জাহাজে কাজ শেষে দেশে ফিরেছে। আমরা কখনও বিমানবন্দর আবার কখনও চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন জেটি থেকে তাকে রিসিভ করেছি। এবারের বিষয়টি সম্পূর্ণ আলাদা। তারা এক মাস দস্যুদের কবলে জিম্মি ছিল। এরপর মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরছে। নুর উদ্দিন দেশে আসছে এ জন্য তার পছন্দের সব খাবার রান্না করা হচ্ছে। সে মিষ্টি, কেক এবং পায়েস জাতীয় খাবার খেতে বেশি পছন্দ করে। আমি তার জন্য কেক, মিষ্টি, পায়েস তৈরি করছি। সে গরুর মাংস খেতে পছন্দ করে। বলা যায় তার পছন্দের সব খাবার আমি একে একে রান্না করছি।’
সোমবার বিকাল ৫টায় কুতুবদিয়ার পৌঁছে এমভি আবদুল্লাহ জাহাজ। এরপর জাহাজটি নোঙর করা হয়। কেএসআরএম থেকে নতুন ২৩ নাবিকের একটি টিম এমভি আবদুল্লাহ জাহাজে যাবে। দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার পর আগের ২৩ জনের টিম আগামীকাল বিকালে আসবে।
কেএসআরএমের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম বলেন, ‘এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের ২৩ নাবিক তীরে উঠবে মঙ্গলবার বিকাল ৪টায়। তাদেরকে লাইটার জাহাজে করে সরাসরি আবদুল্লাহ জাহাজ থেকে সদরঘাট কেএসআরএম জেটিতে নিয়ে আসা হবে।’
তিনি বলেন, ‘এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের ২৩ নাবিক সুস্থ আছেন। গত ৩০ এপ্রিল ভোর ৪টার দিকে জাহাজটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের মিনা সাকার বন্দর থেকে ৫৬ হাজার মেট্রিক টন চুনা পাথর নিয়ে দেশের পথে রওনা দেয়।’
সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবল থেকে দীর্ঘ এক মাস পর গত ১৩ এপ্রিল সোমালিয়ার সময় রাত ১২টা এবং বাংলাদেশ সময় রাত ৩টায় মুক্তি পায় এমভি আবদুল্লাহ জাহাজসহ ২৩ নাবিক।
এর আগে জলদস্যুদের চাহিদার মুক্তিপণের টাকা পৌঁছানো হয় একটি বিশেষ এয়ারক্রাফটের মাধ্যমে। এই এয়ারক্রাফট থেকে দস্যুদের নির্ধারিত স্থানে তিনটি ব্যাগভর্তি ডলার পৌঁছানো হয়। প্রায় পাঁচ মিলিয়ন ডলার মুক্তিপণ দেওয়া হয় বলে জানা গেছে। যদিও মুক্তিপণ দেওয়ার বিষয়টি কেএসআরএম কর্তৃপক্ষ স্বীকার করলেও কত টাকা দিয়েছে তা নিশ্চিত করেননি।
দস্যুদের কবল থেকে ছাড়া পেয়ে জাহাজটি দুবাইয়ের উদ্দেশে রওনা দেয়। ২১ এপ্রিল বিকাল সাড়ে ৪টা নাগাদ সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই আল হারমিয়া বন্দরের বহির্নোঙরে পৌঁছে জাহাজটি। জাহাজটিতে থাকা ৫৫ হাজার মেট্রিক টন কয়লা সেখানে খালাস করা হয়। পরে আমিরাতের মিনা সাকার বন্দর থেকে ৫৬ হাজার মেট্রিক টন চুনা পাথর লোড করা হয়। এসব পণ্য নিয়ে দেশের পথে রওনা দেয় এমভি আবদুল্লাহ।
জাহাজটি কেএসআরএম গ্রুপের এসআর শিপিংয়ের মালিকানাধীন। এসআর শিপিং সূত্র জানিয়েছে, এমভি আবদুল্লাহ জাহাজ গত ৪ মার্চ আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিকের মাপুটো বন্দর থেকে কয়লা নিয়ে যাত্রা শুরু করে। ১৯ মার্চ সেটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের হামরিয়াহ বন্দরে পৌঁছানোর কথা ছিল। এর মধ্যে ১২ মার্চ দুপুর দেড়টার দিকে ভারত মহাসাগরের সোমালিয়ান জলদস্যুর কবলে পড়ে জাহাজটি। প্রায় এক মাস পর মুক্তিপণের বিনিময়ে জাহাজসহ ২৩ নাবিক মুক্তি পায়।