X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

কারাগারে গেলে টাকায় সব মেলে

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
২৮ জানুয়ারি ২০২১, ১৫:৪৬আপডেট : ২৮ জানুয়ারি ২০২১, ১৫:৪৮

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম জেলে বসে সাহিত্য রচনা করেছিলেন, গান লিখেছিলেন। গান লেখা ও গজলের সুর দেওয়ার কাজও করেছেন জেলে বসে। নজরুলের মতো অনেক কবি-সাহিত্যিকই জেলে বসে সাহিত্য সাধনা করেছেন। অনেক বিপ্লবী ও রাজনৈতিক নেতা জেলে বসে পরীক্ষা দিয়ে অতি ভালো রেজাল্ট করে চমকে দিয়েছেন, এমন কথা অনেক পড়েছি, জেনেছি।

বাংলাদেশের মানুষের এবার সৌভাগ্য হয়েছে এক অন্য রকমের নাটক দেখার। কাশিমপুর কারাগারে বন্দি হলমার্কের জিএম তুষার আহমদ কারা কর্মকর্তাদের কক্ষে এক নারীর সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন। সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত ও প্রকাশিত সিসিটিভি ফুটেজে যে কার্যক্রম দেখা গেলো তাতে মনে হলো এটি কারাগার নয়, বরং তুষার আহমদের বাংলো বাড়ি। মনে হলো পাইক পেয়াদা পরিবেষ্টিত অবস্থায় বেশ ভালোই আছেন দুর্নীতির অভিযোগে আটক এই ব্যক্তি। মনে হতে পারে বাংলাদেশের কারাগারগুলো পশ্চিমা দেশের মতো হয়ে গেছে। কারাগারের বন্দিরা এখন বেশ সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন।

বাস্তবে এটি তুষারের আরেক দুর্নীতি। নারীসঙ্গ পাওয়ার বিনিময়ে কারাগার ১-এর জেলার এক লাখ, ডেপুটি জেলার ২৫ হাজার এবং সার্জেন্ট ইনস্ট্রাক্টর, গেট সহকারী, প্রধান কারারক্ষীকে পাঁচ হাজার টাকা করে ঘুষ দিয়েছেন তুষার। জেল সুপারের তদন্তেই সেটা উঠে এসেছে। অভিযুক্ত জেলারের ভাষ্য অনুযায়ী, জেল সুপার রত্না রায়ের অনুমোদন নিয়েই বন্দির সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তার মানে হলো, এই কারাগারে একটি বড় দুর্নীতিবাজ চক্র আছে, এমনকি কারা প্রশাসনের লোকজনও উৎকোচের সঙ্গে জড়িত।

বাংলাদেশের কারাগারগুলো বহুদিন ধরেই অপরাধীদের কাছে অনেক বিলাসবহুল হয়ে উঠছে। বলা হয়, টাকা দিলে কারাগারে সব মিলে। অভিযোগ আছে, মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে মদ, গাঁজা, চরস, হেরোইনসহ মাদকদ্রব্য সবই পাওয়া যায় কারাগারে। জেলে বসেই সন্ত্রাসীদের চাঁদা বাণিজ্যের কথা জানা যায়, সমাজবিরোধীদের সংগঠন চালানোর কথাও মানুষ জানে।

কারারক্ষীদের চোখে ধুলো দিয়ে (নাকি টাকা দিয়ে বলা মুশকিল) পালানোর ঘটনাও ঘটছে। এই তো গেলো বছর আগস্ট মাসে জানা গেলো, কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২ থেকে বন্দি পালিয়েছে মই বেয়ে। কারাগারের ভেতরে বসে মই তৈরি করে সেটি বেয়ে প্রধান ফটক পার হয়ে কারাগার থেকে পালিয়ে গেছেন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদি আবু বক্কর ছিদ্দিক। পালানোর সময় তার পরনে কয়েদির পোশাক ছিল না। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কারারক্ষীরা কেউ বাধাও দেননি। তারা মই বানাতে দেখলেও জানতে চাননি কেন তিনি এটা বানাচ্ছেন। কাশিমপুর কারাগার থেকেই আদালতে নেওয়ার পথে এক জঙ্গি পালিয়ে গিয়েছিলেন। কারাগারে থেকেও বছরের পর বছরে পিতা হয়েছেন, তার স্ত্রী কারাগারের বাইরে থেকেও স্বামীকে সন্তান উপহার দিয়েছেন এমন মুখরোচক গল্পও আছে।

কারা কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অনিয়ম ও কর্তব্যে অবহেলার গুরুতর সব অভিযোগ আছে। কারাগারে সংঘটিত অনেক অনিয়ম-অপরাধের বিচার হয় না বলেই দিন দিন তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। যে কয়টি ঘটনা উপরে উল্লেখ করলাম, এগুলো সহস্র অভিযোগের কয়েকটি মাত্র। আসলে পুরো কারাগার ব্যবস্থাই দুর্নীতির কারণে অরক্ষিত হয়ে আছে। কারাগারগুলোকে অনিয়মের আখড়া বানিয়ে কারা কর্মকর্তারা গড়ছেন অবৈধ সম্পদের পাহাড়। বস্তাভরা টাকা নিয়ে ধরাও পড়েছেন ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কারা কর্মকর্তা। গত তিন বছরে শতাধিক কারা কর্মকর্তা ও রক্ষীকে অপরাধের জন্য শাস্তি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু থেমে নেই কোনও কিছু।
কারাগার বা জেলখানায় অপরাধীকে আনা সংশোধনের জন্য। কিন্তু সেটাই যদি অপরাধের স্বর্গরাজ্য হয়ে যায়, তাহলে উপায় নেই বলতে হবে। বাংলাদেশের কারাগারে ধারণ ক্ষমতার কয়েকগুণ বেশি বন্দি আছেন। বিচারিক প্রক্রিয়ায় ধীরগতি কারণে বিচারের অপেক্ষায় মানুষকে জেলে থাকতে হচ্ছে বছরের পর বছর। অবস্থা অনেকটা এমন যে, বিচার নেই, কিন্তু কারাগার আছে। কারাগারে প্রয়োজনের তুলনায় লোকবলও কম। নানা সময়, বিভিন্ন সরকারের আমলে কারা সংস্কার নিয়ে অনেক কথা আর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

মোট বন্দির বিশাল অংশ বিনা বিচারে আটক। এই বন্দিদশার নির্দিষ্ট কোনও সময়সীমা নেই। মামলাগুলোর ফাইলে ধুলোর মোটা পরত। এই মানুষগুলোর প্রতি রাষ্ট্রের কি কোনও দায়িত্ব নেই? একটা কারণ হয়তো এই যে, বিনা বিচারে আটক বেশিরভাগ মানুষই সমাজের দরিদ্র অংশ থেকে আসা। অপরাধ বা দোষ করেছেন কিনা তা প্রমাণ হওয়ার আগেই অনেক মানুষই বেশ কয়েক বছর জেল খেটেছেন। তারপর যত দিনে বেকসুর খালাস হচ্ছেন, ততদিনে তাদের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়টা লুট হয়ে যাচ্ছে। অপরাধ দমনের নামে হাজারে হাজারে লোককে জেলে ভরে রাখা কোনও ন্যায়বিচার হতে পারে না। তাই এর একটা সমাধানের অবশ্যই প্রয়োজন। বন্দি কমাতে পারলে কারাগারের ভেতর দুর্নীতি ও অপরাধও কমবে নিশ্চয়ই। বন্দিদের সুযোগ সুবিধাও বাড়বে। আমরা চাই বিচার থাকুক, প্রকৃত অপরাধীর জন্য কারাগারও থাকুক।

লেখক: সাংবাদিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা বেড়ে ১৩৭
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা বেড়ে ১৩৭
কানে ডিভাইস নিয়োগ পরীক্ষার কেন্দ্রে বোন, বাইরে থেকে উত্তর বলার অপেক্ষায় ভাই
কানে ডিভাইস নিয়োগ পরীক্ষার কেন্দ্রে বোন, বাইরে থেকে উত্তর বলার অপেক্ষায় ভাই
কাভার্ডভ্যান-লরির মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই গাড়িতেই আগুন, প্রাণ গেলো একজনের
কাভার্ডভ্যান-লরির মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই গাড়িতেই আগুন, প্রাণ গেলো একজনের
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ