X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

ভারতের কৃষক আন্দোলনে ‘বিদেশি হস্তক্ষেপ’ এবং রিহানার টুইট

আনিস আলমগীর
০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৫:৪৮আপডেট : ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৬:৪৫

আনিস আলমগীর অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটছে ভারতে। দুনিয়ার সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের গণতন্ত্র নরেন্দ্র মোদির হিন্দু মৌলবাদী সরকারের দ্বিতীয় আমলে এসে প্রশ্নের পাশাপাশি হাস্যরসের জন্ম দিয়েছে। প্রায় তিন মাস ধরে সে দেশের কৃষকরা দেশের বৃহত্তর সেক্টর কৃষি নিয়ে সরকারের গৃহীত তিনটি আইনের বিরোধিতা করে রাস্তায় অবস্থান করছে। ঠান্ডা জনিত কারণে (হাইপোথার্মিয়া) ২০০ কৃষক রাস্তায় মারা গেছেন। এখনও তারা দাবি আদায়ে অনড় হয়ে রাস্তায় অবরুদ্ধ অবস্থান করছেন, কিন্তু সরকার কর্ণপাত করছে না, তারাও বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন না। মৃত্যুর এই সংখ্যা বিশ্বের যেকোনও দেশের জন্য লজ্জার, বর্বর এবং মানবাধিকার ও মর্যাদার ওপর বড় ধরনের হামলা হিসেবে বিবেচিত। অথচ ক’দিন আগে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট তাদের গণতন্ত্রের সূচকে সার্ক দেশের সবার আগে রেখেছে ভারতকে (৫৩)। বিশ্বের ১৬৫টি দেশের ওপর করা এই তালিকায় দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলংকা দ্বিতীয় (৬৮) আর বাংলাদেশ তৃতীয় (৭৬) অবস্থানে।

মোদি সরকারের কাশ্মির নীতি, মুসলিম নির্যাতন, কৃষক আইনসহ মানবাধিকার পরিপন্থী যেকোনও নীতির বিরোধিতা করলে জেল-জুলুম-হত্যাসহ সরকারের রোষানলে পড়তে হচ্ছে। নরেন্দ্র মোদি ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ সংসদে কৃষক আন্দোলনের সমর্থকদের তিরস্কার করে ‘আন্দোলনজীবী, পরজীবী’ আখ্যা দিয়েছেন। আর বিদেশে বসে যারা কৃষক আন্দোলন সমর্থন করছেন তাদের বলছেন সন্ত্রাসী, ষড়যন্ত্রকারী। প্রবাসী ভারতীয়দের পাশাপাশি বিশ্বের অনেক দেশের মানুষ, বিশেষ করে উন্নত বিশ্বের সমাজকর্মী, বিভিন্ন সেক্টরের তারকা থেকে শুরু করে এমপি-মন্ত্রীরাও কৃষকদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। বিশ্বায়নের এই যুগে হাস্যকরভাবে মোদি সরকার এটাকে বিদেশি হস্তক্ষেপ, ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানো মনে করছে। তবে দেশ-বিদেশের লোকজন স্মরণ করাতে ভুলছে না, যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী আমেরিকায় গিয়ে টেক্সাসের ‘হাউডি মোদি’ অনুষ্ঠানে ‘আব কি বার ট্রাম্প সরকার’ জয়ধ্বনি দিয়ে এসেছেন তখন সেটি তাদের অভ্যন্তরীণ ইস্যু ছিল না?

উল্লেখ্য, মোদি সরকার কৃষকদের জন্য যে তিনটি আইন করেছে তা নিয়ে কৃষকরা টানা আন্দোলনে আছে গত নভেম্বর থেকে। তারা বলছেন, এই আইনের মধ্য দিয়ে কৃষকের স্বার্থ দেখা হচ্ছে না। কৃষি ব্যবস্থাপনা আর রাজ্যের হাতে থাকবে না। নতুন আইন অনুযায়ী কৃষকের সঙ্গে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের যে চুক্তি হবে, তাতে ফসলের পরিমাণ, গুণগতমান দাম ইত্যাদি আগেই নির্ধারিত থাকবে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, নতুন আইনের সুযোগে করপোরেট প্রতিষ্ঠান ও ফড়িয়ারা নিজেদের ইচ্ছেমতো ফসলের দাম নির্ধারণ করতে ও ইচ্ছেমতো গুদামজাত করতে পারবে। পূর্বে প্রাকৃতিক দুর্যোগে কৃষিক্ষেত্রে কোনও বিপর্যয় নেমে এলে রাজ্য সরকার কৃষকের পাশে থাকতো। এখন তাতে রাজ্য সরকারের কোনও দায়-দায়িত্ব থাকছে না। বরং কেন্দ্রীয় সরকার বহুদূর থেকে সবকিছু তদারকি করবে।

গত ২৬ জানুয়ারি ২০২১ আন্দোলনরত কৃষকদের একাংশ রাজধানী নতুন দিল্লির রাস্তায় চলে এলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়, সেটি বড় করে প্রচার করা হয় কিন্তু কৃষকদের ওপর পুলিশের নির্যাতন বেশিরভাগ মিডিয়া আড়াল করে রাখে। কৃষক আন্দোলন ওইদিনই শেষ বলে প্রচার চালায় সরকার সমর্থক মিডিয়াগুলো। কৃষকরা আবারও দিল্লির সীমান্তে চলে যায়, যেখানে তারা শিবির করে অবস্থান করছিল। কেউ কেউ কাঁদতে কাঁদতে বাড়িতে চলে যায় কিন্তু ভাঙা হাট আবার জমে ওঠে এবং অনেক রাজ্যে আরও বেশি সংখ্যক কৃষক একই কায়দার রাস্তায় আন্দোলনে নামে। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে পুলিশ তাদের অবরুদ্ধ করে রাখে।

সবচেয়ে ন্যক্কারজনক অবরোধ নেমে এসেছে দিল্লির কয়েকটি সীমান্ত পয়েন্টে স্থাপিত শিবিরে। এসব এলাকায় সরকার মোবাইল ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দিয়েছিল। এই আন্দোলনকে হতাশ করতে হরিয়ানা সরকার রাজ্যের ১৭টি জেলায় ইন্টারনেট পরিষেবাও বন্ধ করে দিয়েছে। পুলিশ নিরাপত্তা বর্ধিত এবং ব্যারিকেড জোরদার করায়, ইতোমধ্যে, দিল্লির সীমান্তে কৃষকদের বিক্ষোভের স্থানগুলো দুর্গে পরিণত হয়েছে। কৃষকরা সেখান থেকে বেরুতে পারছে না আবার তাদের কাছে সাংবাদিক যাওয়ার রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

সিংহু সীমান্তের মূল মহাসড়কের এক প্রান্তে দুটি সারি সিমেন্টের দেওয়াল দিয়ে লোহার রড আটকানো হয়েছে, যেটা কোনও যানবাহন এবং মানবের পক্ষে অতিক্রম করা সম্ভব না। দিল্লি-উত্তর প্রদেশ সীমান্তের গাজীপুরে যানবাহন চলাচল বন্ধ করতে ১১ ধাপের মাল্টিলেয়ার ব্যারিকেড রয়েছে। লোকজনকে হাঁটতে বাধা দিতে কাঁটাতার লাগানো হয়েছে। দুনিয়ার কোথাও পুলিশ এমন ব্যারিকেড দিয়েছে জানা নেই। ছবি না দেখলে কেউ বিশ্বাসও করবে না- কী রকম কঠোর নিরাপত্তা বলয় বানিয়ে কৃষকদের অবরুদ্ধ করা হয়েছে।

মজার বিষয় হচ্ছে, এই নিয়ে বিদেশি তারকারা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রশ্ন তোলায় মহাক্ষেপেছে দিল্লির সরকার। এত হাস্যকর যে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এর বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছে, যা ছিল নজিরবিহীন ঘটনা। মার্কিন পপ তারকা রিহানাকে দিয়ে শুরু। ২ ফেব্রুয়ারি ২০২১ আন্তর্জাতিক পপ তারকা রিহানা তিনটি বিতর্কিত কৃষি আইনের বিরুদ্ধে কৃষকদের চলমান প্রতিবাদে তার সমর্থন ব্যক্ত করেন। তাও সরাসরি কোনও কথা নেই কৃষকের আন্দোলন নিয়ে। টুইটারে গিয়ে রিহানা শুধু কৃষক আন্দোলন নিয়ে সিএনএন-এর একটি রিপোর্ট শেয়ার করেন আর লিখেন ‘আমরা কেন এ বিষয়ে কথা বলছি না (why aren’t we talking about this?)? হ্যাসট্যাগ ফার্মার্সপ্রটেস্ট (#FarmersProtest) ।

টুইটারে রিহানার ১০১ মিলিয়ন ফলোয়ার আছে, যা তাকে করেছে টুইটারে চতুর্থ সর্বোচ্চ অনুসরণকারী ব্যক্তিতে। ৩২ বছর বয়সী এই গায়িকা প্রথম আন্তর্জাতিক তারকা, যিনি ভারতের কৃষকদের আন্দোলনে প্রথম সমর্থন জানান। সঙ্গে সঙ্গে রিহানার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বলিউডের বিজেপি সরকার সমর্থক তারকা কঙ্গনা রানাওয়াত, অক্ষয় কুমার, অজয় দেবগন, করণ জোহরসহ অনেক তারকা। তাদের দেখাদেখি বিরাট কোহলি, শচীন টেন্ডুলকার, লতা মঙ্গেশকরসহ অনেকে রিহানার বিরুদ্ধে এবং আন্দোলনের বিপক্ষে টুইট করেন।

প্রায় একই সময়ে একই রকম টুইট সবার। টুইটের ভাষা, কয়েকটি শব্দও আবার হুবহু এক। ফলে শচীন টেন্ডুলকার, লতা মঙ্গেশকরসহ এসব তারকা এ ধরনের টুইট করার পর থেকেই চাঞ্চল্য শুরু হয়ে যায়। কৃষি আইনের সমর্থনে এবং আন্দোলনের বিপক্ষে তারকাদের এসব টুইটের পেছনে সরকারের কোনও চাপ আছে কিনা খতিয়ে দেখছে মহারাষ্ট্র সরকার।

বলিউড সেলিব্রিটিরা রিহানার টুইটকে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ মনে করে প্রশ্ন তুলেছে- রিহানা কৃষকদের সম্পর্কে কী জানেন! রিহানা অবশ্য প্রশ্ন তোলেননি ‘ব্ল্যাক লাইফ মেটার’-এর পক্ষে সারা বিশ্বের মানুষের সঙ্গে এই বলিউডের তারকারা যখন টুইট করেছিল সেটা যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয় ছিল কিনা। মোদি সরকার এবং এই তারকারা ভুলে গেছেন, এখন গ্লোবাল দুনিয়া চলছে, পরবর্তী মানবরা দেখবে গ্যালাক্সি দুনিয়া। লোকজন তখন তাদের নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করবে না! অবশ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় এসব তারকাকে নিয়ে হাস্যরস এখনও চলছে।

সরকার এবং ক্ষমতাসীন অভিজাতরা কীভাবে সমস্যার সমাধান হবে তা না করে কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে বিদেশি শক্তির হাত এবং ষড়যন্ত্র খুঁজে পেয়েছে। রিহানাকে পাকিস্তানের সমর্থক বানিয়ে ‘গদি মিডিয়া’ টকশো করছে। কেউ কেউ নামের কারণে রিহানাকে মুসলমান বানাচ্ছে। রিহানার পর এই নিয়ে টুইট করে ভারতীয় মিডিয়ায় আক্রমণের শিকার হন গ্রেটা থুনবার্গ, ১৮ বছর বয়সী এই স্কুলছাত্রী জলবায়ু নিয়ে কাজ করে এখন নোবেল পুরস্কার অর্জনের পথে। তাকে বানানো হয় কাশ্মিরি মুসলমান বাবার বিদেশি মেয়ে। আন্তর্জাতিক পপ সেনসেশন রিহানা এবং গ্রেটা থুনবার্গের প্রতিবাদী কৃষকদের প্রতি উদ্বেগ প্রকাশ করা পোস্টের পরেই লেবানিজ-আমেরিকান সাবেক পর্নো তারকা মিয়া খলিফা কৃষকদের পক্ষে টুইট করেন। ফলে, সবকিছু মিলে পুরো ভারতের সোশ্যাল মিডিয়া এবং টিভি টকশোগুলো এর পেছনে বিদেশি শক্তির হাত খুঁজেছে গত সপ্তাহজুড়ে। বিদেশি তারকারা টাকার বিনিময়ে এসব করছে- এমন হাস্যকর প্রচারও চলছে।

এমনকি রবিবার আসামের চা শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতাকালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও এতে বিদেশের হাত খুঁজে পেয়েছেন। তিনি আরও এক ধাপ এগিয়ে চা শ্রমিকদের সহানুভূতি পাওয়ার জন্য প্রচার করেন যে ভারতের চায়ের বিরুদ্ধেও বিদেশে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। ভারতীয় চা বর্জনের প্রচার হচ্ছে। সব মুখের কথা। কোনও প্রমাণ নেই।

ভারতীয় মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়ার এসব ‘বেকুবি’ কবে থামবে কে জানে!


লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
বাংলাদেশে আইসিটির ভবিষ্যৎ কেন হুমকির মুখে?  
বাংলাদেশে আইসিটির ভবিষ্যৎ কেন হুমকির মুখে?  
মস্কোতে কনসার্টে হামলা: ৯ সন্দেহভাজনকে আটক করলো তাজিকিস্তান
মস্কোতে কনসার্টে হামলা: ৯ সন্দেহভাজনকে আটক করলো তাজিকিস্তান
চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন
চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ