X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

তারেক জিয়ার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ

আনিস আলমগীর
২৯ জুন ২০২১, ১৪:৩৪আপডেট : ২৯ জুন ২০২১, ১৪:৩৪

আনিস আলমগীর সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া প্রায় সাড়ে তিন বছর কারাবাস ও বন্দী জীবন-যাপন করছেন। খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে এই সময়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন বা দলের শীর্ষ পদে আসীন হয়েছেন তারই পুত্র তারেক রহমান। এর মধ্যদিয়ে বিএনপির রাজনীতি ও নেতৃত্ব দুটোই প্রহেলিকায় পরিণত হয়েছে। না আছে আন্দোলন, না আছে সংগঠন– বিএনপি এমন কঠিন সময় আগে কখনও দেখেনি। আবার এসব নিয়ে দলে যারা প্রশ্ন তুলছে– গণতান্ত্রিক, বহুমতের প্রতীক দাবিদার বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব তাদেরকে দলে নিস্ক্রিয় করে দিচ্ছে। আর দলের বাইরের কেউ হলে তারা হুমকি পাচ্ছেন।

সম্প্রতি তেমনি এক ঘটনা ঘটেছে বিএনপি বুদ্ধিজীবী খ্যাত গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গে। রেকর্ড রাখার স্বার্থে আমি পুরো ঘটনাটিই তুলে ধরতে চাই। গত ২৬ জুন ২০২১ শিক্ষা বাজেট নিয়ে বিএনপি ঘরানার লোকদের আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে জাফরুল্লাহ চৌধুরী লন্ডনে রাজনৈতিক আশ্রিত তারেক জিয়াকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘আজকে বিএনপি পরিচালিত হচ্ছে ওহি নিয়ে। আর সে ওহি লন্ডন থেকে আসে। আমরা লক্ষ করছি, সম্প্রতি নির্বাচনে দাঁড়ানোর লোক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই মনে করি, স্বৈরাচার সরকারের পতন ঘটাতে হলে সবাইকে একাত্ম হতে হবে। সে পরিবর্তন আনতে হবে বিএনপির নিজ ঘর থেকে।’

জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘আমি বারবার বলেছি, তারেক দুই বছর চুপচাপ বসে থাকো। পারো তো বিলেতে লেখাপড়ার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাও। সেখানে বহুভাবে লেখাপড়া করা যায়।’ বক্তব্যের এ পর্যায়ে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি ওমর ফারুক কাওছার উচ্চ স্বরে জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে সালাম দেন। তার সঙ্গে আরও চার-পাঁচজন আগে থেকে মিলনায়তনের একপাশে জটলা বেঁধে ছিল। ওমর ফারুক সালাম দিয়েই জাফরুল্লাহ চৌধুরীর উদ্দেশে বলেন, ‘আপনি বিএনপির কে? আপনি বিএনপি নিয়ে কেন উল্টোপাল্টা কথা বলেন?’ জবাবে জাফরুল্লাহ বলেন, ‘নাহ, কিছু নই। এটা তো গণতন্ত্রে আমার বলার অধিকার আছে।’ ওমর ফারুক বলেন, ‘আপনি বিএনপির কেউ নন। অথচ আমাদের নেতা নিয়ে কথা বলেন।’ এ পর্যায়ে জাফরুল্লাহ বলেন, ‘আমার কথা শেষ হোক, বোঝেন, এরপর কথা বলেন। আপনাদের ভালোর জন্যই বলছি। আপনাদের ভালোও বোঝেন না আপনারা।’

তখন ছাত্রদলের ওই নেতা বলেন, ‘না না, আমরা অবশ্যই বুঝি, আমরা আমাদেরটা বুঝি, আপনি আপনারটা বোঝেন। আপনি আমাদের নেতাকে নিয়ে কখনও কথা বলবেন না। কই আপনি তো জয়কে নিয়ে কিছু বলেন না। আর যদি বলেন পরবর্তী সময়ে কিছু হলে আমরা দায়ী নই।’ তখন জাফরুল্লাহ বলেন, ‘আপনারা কেন দায়ী হবেন।’ এরপর ছাত্রদলের ওই নেতাসহ চার-পাঁচজন দ্রুত মিলনায়তন ত্যাগ করেন।

অবশ্য জাফরুল্লাহ চৌধুরী এ ধরনের হুমকির বিষয়ে রাগ করেছেন মনে হচ্ছে না। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘মনে হয় না, তারেক এটা করতে বলেছে। ওরাই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে করেছে, কারণ তোষামোদের অভাব নেই। যে যা-ই বলুক, আমি যেটা ভালো মনে করি, সেটাই বলি, সেটাই বলবো।’

জাফরুল্লাহ রাগ না করলেও বিএনপি নেতাদের মধ্যে জাফরুল্লাহকে অপমান করা নিয়ে ভিন্ন মত আছে। তারা বলছেন, পাবলিক ফোরামে কথা বলার সময় খুব বুঝে শুনে কথা বলা উচিত। যে কথা ঘরোয়া পরিমণ্ডলে বলতে হয়, সেটা প্রকাশ্য সভায় বলা চলে না। আবার কোনও ব্যাপারে প্রতিবাদ যদি মাত্রা ছাড়া হয় লোকসান হয় নিজেদের, লাভবান হয় প্রতিপক্ষ। বিএনপির নেতা ব্যারিস্টার সারোয়ার হোসের এ প্রসঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছেন, ‘রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম পাবলিক ফাংশন। শুধু বিএনপি কেন, যে কোনও নাগরিক যে কোনও দলের কার্যক্রম নিয়ে মন্তব্য, আলোচনা, সমালোচনা, পর্যালোচনা ও বিতর্ক করতে পারে। সেগুলোর জবাব আলোচনার মাধ্যমে দিতে হবে। অসভ্যতার মাধ্যমে নয়। ছাত্রদলের ওই সদস্যের এটা জানার কথা। জিয়াউর রহমান তার সমালোচকদের সবচেয়ে বেশি পছন্দ করতেন। নেতৃত্বের নামে যারা ভগবানতন্ত্রে বিশ্বাস করে, তাদের সঙ্গে একমত নই। ভগবানতন্ত্রে বিশ্বাসকারীরা মূলত ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারে পদলেহনকারীতাকে বাহন হিসেবে বেছে নেয়।’

শুরুতেই যা বলছিলাম- খালেদা জিয়া মঞ্চের পেছনে চলে যাওয়ায় এবং তারেক জিয়ার সামনে আসায় দলটি আরও পিছিয়ে গেছে। সব কিছুতে তারেকের চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্তের কারণে ঐক্য বিনষ্ট হয়েছে। তারেক জিয়ার দুর্নীতিগ্রস্থ এবং সন্ত্রাসী হিসেবে দেশে-বিদেশে যে ইমেজ দাঁড়িয়েছে তাতে তিনি নেতৃত্বে থাকলে দলটি আগামীতে আদৌ ক্ষমতায় আসতে পারবে কিনা সেই হতাশাও দেখা দিয়েছে দলীয় নেতা কর্মীদের মধ্যে। সমালোচকরা বলছেন, বিএনপিতে রাজনীতি কোথায়! তীব্র প্রতিবাদ, নিন্দা জ্ঞাপন ও কঠোর আন্দোলনের হুমকি প্রদানের মধ্যে আজ তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি আটকে আছে।

নতুন করে কমিটির করার নামে সেই কমিটি বাণিজ্য অব্যাহত রয়েছে কিন্তু নির্বাচনি বাণিজ্য এখন জমছে না। জিতে আসার ক্ষেত্রে সরকারি বাধা আর এক মুরগী বারবার জবাই করার সংকটে কারণে হয়তো বিএনপি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। এমনিতেই দীর্ঘ দিন দল ক্ষমতার বাইরে থাকায় চান্দা ও ধান্ধা মাঠে মারা গেছে তাদের, আবার হামলা মামলায় রাজনৈতিক হয়রানির শিকার হয়েও অনেক আজ সর্বশান্ত।

তবে এটাও বলার অপেক্ষা রাখে না তৃণমূল পর্যায়ে দলের মধ্যে তারেক জিয়া একটি নিজস্ব সমর্থকগোষ্ঠী তৈরি করতে সমর্থ হয়েছেন। তারপরও বিএনপি নেতা নেত্রীরা তারেক জিয়াকে নেতৃত্বে রেখে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন যতই দেখুক রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন তার রাজনৈতিক মৃত্যু ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তিনি গ্রেনেড হামলার যে পাপাচারে লিপ্ত হয়েছিলেন তার মধ্যে নির্ধারিত হয়ে গেছে। সে ঘটনায় মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন হলেও দেশের সিংহভাগ মানুষ মনে করেন ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা তারেকের একক প্রচেষ্টার ফল। অন্যরা সহযোগী মাত্র।

বঙ্গবন্ধু এভিনিউ’র সেদিনের গ্রেনেড হামলায় শেখ হাসিনার মৃত্যু হলে, আওয়ামী লীগের অধিকাংশ বড় বড় নেতারা প্রাণত্যাগ করলে পরবর্তী সময়ে দেশে ‘একক’ হতেন তারেক জিয়া, ‘একক’ হতেন খালেদা জিয়া এবং ‘একক’ হতো বিএনপি। এতসব ‘একক’ হওয়ার সৌভাগ্য যিনি ভোগ করতেন তিনিই তো হবেন গ্রেনেড হামলার উদ্যোক্তা। বাবর, পিন্টু, হারিছরা তো ছিল বাজনাদার মাত্র।

তারেক জিয়ার কারণে বিএনপি এখন আন্তর্জাতিক মিত্রহীন একটি দলে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষমতার রাজনীতিতে যারা কলকাঠি নাড়ায় তারা তারেকের নেতৃত্বে বিএনপিকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না। বহির্বিশ্বের আদালতও এখন (কানাডা) বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলে অবহিত করেছে। তারেককে সন্ত্রাসী আখ্যায়িত করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তো বহু আগেই প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে। পাকিস্তান ও কাশ্মিরের কিছু আন্তর্জাতিক দুনিয়া কর্তৃক স্বীকৃত সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে বিএনপির তখনকার জ্যেষ্ঠ যুগ্ম-মহাসচিব তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বিদ্যমান ছিল। তারাই ২১ আগস্টের জন্য পাকিস্তানে তৈরি আর্জেস গ্রেনেড সরবরাহ করেছিল বলে প্রমাণিত হয়েছে।

দেশের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসী সংগঠন হরকাতুল জেহাদ (হুজি), জেএমবি, জামায়াতে ইসলামিসহ বহু ক্ষুদ্র বৃহৎ সংগঠনের সঙ্গেও তারেক জিয়া এবং বিএনপির যোগাযোগ ছিল। তারেক জিয়া ছাত্রশিবির এবং ছাত্রদলকে এক মায়ের সন্তান বলে অবহিত করেছিলেন।

সুতরাং বিএনপির প্রয়োজনে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে তারেক জিয়ার পরিবর্তন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। আবার রাজনীতিতে খালেদা জিয়ার কামব্যাকের যেমন কোনও সুযোগ নেই তেমনি তারেক জিয়া যদি বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বে না থাকেন তার পরিবর্তে নেতা কে– এই প্রশ্নেরও সমাধান নেই পরিবার কেন্দ্রীক রাজনৈতিক দলটিতে। প্রশ্নগুলোর উত্তর যতদিন মিলছে না আওয়ামী লীগকে সরকার থেকে সরানোও অসম্ভব। কারণ আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনাকে সরালে জনগণের কাছে এর বিকল্প কী- সেই প্রশ্নের উত্তর জনগণের সামনে বিরোধী দলগুলোর হাজির করতে পারিনি।

 

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
[email protected]

 

 

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রাফায় আবারও ব্যাপক হামলা ইসরায়েলের
রাফায় আবারও ব্যাপক হামলা ইসরায়েলের
স্ত্রীকে নিয়ে ঘুমিয়ে ছেলে, রান্নাঘরে পুড়ে মারা গেলেন মা
স্ত্রীকে নিয়ে ঘুমিয়ে ছেলে, রান্নাঘরে পুড়ে মারা গেলেন মা
২৫ দিনেও গ্রেফতার হয়নি কেউ, পুলিশ বলছে সিসিটিভির ফুটেজ পায়নি
কুমিল্লা শিক্ষা প্রকৌশল কার্যালয়ে ঠিকাদারকে মারধর২৫ দিনেও গ্রেফতার হয়নি কেউ, পুলিশ বলছে সিসিটিভির ফুটেজ পায়নি
উপজেলা নির্বাচন: অংশ নিতে পারবেন না পৌর এলাকার ভোটার এবং প্রার্থীরা
উপজেলা নির্বাচন: অংশ নিতে পারবেন না পৌর এলাকার ভোটার এবং প্রার্থীরা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ