X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

‘চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনি’

প্রভাষ আমিন
০৯ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৬:৫৫আপডেট : ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৭:০৩

প্রভাষ আমিন একটি ‘অসহায় সেতু’র গল্প বলি আজ। ১৯৯৯ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার বনগজ ও কৃষ্ণনগর গ্রামের মধ্যবর্তী খালে ১২০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৮ ফুট প্রস্থের একটি সেতু নির্মাণ করা হয়েছিল। সেতু বানালেও কোনও সংযোগ সড়ক স্থাপন করা হয়নি। তাই লোকজন এটিকে ‘অসহায় সেতু’ বলে ডাকতো। তারপর গত ২২ বছর ধরে সেতুটি তার অসহায়ত্ব নিয়ে টিকে ছিল। এই সেতুটিতে কোনোদিন কোনও মানুষ পারাপার হয়নি। গত ৩ সেপ্টেম্বর একটি ইটবোঝাই ট্রলার সেতুটিকে মুক্তি দেয়। ট্রলারের ধাক্কায় সেতুটি ভেঙে পড়ে। ‘ভাঙিয়া পড়িয়া’ সেতুটি বুঝিয়ে গেলো এটি বানানো হয়েছিল। এলজিইডির অধীনে উপজেলা পরিষদের রাজস্ব তহবিলের অর্থে সেতুটি বানানো হয়েছিল। পুরো টাকাটাই এখন খালের জলে ভেসে গেলো। নিশ্চয়ই খালের দুই পাশের গ্রামের মানুষের উপকারের জন্যই সেতুটি বানানো হয়েছিল। কিন্তু সেতুটি কারও কোনও কাজে আসেনি। কারও কোনও কাজে আসেনি বলাটা বোধহয় ঠিক হবে না। নিশ্চয়ই সেতুর ঠিকাদার তার বিল পেয়েছেন সময় মতোই। সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীও নিশ্চয়ই ভাগের টাকা পেয়েছেন। তারাও জনগণেরই অংশ। তাই একদম কোনও কাজে লাগেনি, এটা বলা অন্যায় হবে। কিন্তু এই প্রশ্ন করাটা নিশ্চয়ই অন্যায় হবে না, কোন প্রকৌশলী এই সেতুর সম্ভাব্যতা যাচাই করলেন, সংযোগ সড়ক ছাড়া সেতুর ডিজাইন করলেন? জনগণের অর্থের এমন অসহায় অপচয়ের দায় তো কারও না কারও আছে। এমন অসহায় সেতু দেশে একটি নয়।

মাঝে মধ্যেই পত্রিকায় এমন অসহায় সেতুর ছবি দেখি। দুই পাশে মাঠ বা পানি, মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে সেতু, যাতে মানুষ ওঠার কোনও সুযোগ নেই। এই সেতুটি ভেঙে গিয়ে আমাদের চোখে ট্রলার ঢুকিয়ে দেখিয়ে দিলো বটে, কিন্তু ২২ বছর ধরে তো এটি সবার চোখের সামনেই ছিল। এই সেতুটি নির্মাণের দায় কার, ২২ বছর ধরে এটিকে অসহায়ভাবে ফেলে রাখার দায় কাদের, সেটা বের করাও কঠিন কোনও ব্যাপার হবে না।

১৯৯৯ সালে এবং তারপর থেকে কে এবং কারা এখানে দায়িত্বে ছিলেন, এটা বের করা তো কয়েক মিনিটের মামলা। সেই বিজ্ঞ প্রকৌশলীদের খুঁজে বের করে তার বিরুদ্ধে কি কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না? এই প্রশ্নটি আমি করলাম, মন্ত্রিপরিষদ সচিব আনোয়ারুল ইসলামের কাছে। সেতু ভাঙার প্রশ্ন কেন মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে, এই ব্যাখ্যায় পরে আসছি। তার আগে আরও কিছু প্রশ্ন আছে। উত্তর আসবে না জানি, তবু প্রশ্ন করতে তো বাধা নেই।

বাধা নেই বটে, তবু কয়েকটা প্রশ্ন অনেক দিন ধরেই আমার মাথায় ছিল। করলে মানুষ বোকা ভাবে কিনা, হাসাহাসি করে কিনা; এই ভয়ে কখনও প্রকাশ্যে করিনি। ভেবেছি এটাই বুঝি রীতি। গত সপ্তাহে মন্ত্রিপরিষদ সচিব আনোয়ারুল ইসলামের একটি বক্তৃতা শুনে বুঝলাম আমার মতো বোকা দেশে আরও আছে। শুধু মন্ত্রিপরিষদ সচিব নন, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রীও দেখি আমার মতোই বোকা।  

বাংলাদেশে এখন উন্নয়নের জোয়ার। রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্টে বদলে গেছে গ্রামীণ অবকাঠামো। পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রকল্প হোক আর সেই অসহায় সেতুর মতো অবহেলিত প্রকল্প হোক; প্রতিনিয়ত কাজ হচ্ছে। কিন্তু সমস্যাটা হলো, শুরুর সময় কোনও প্রকল্পের যে ব্যয় এবং সময় ধরা হয়, অধিকাংশ সময় তা ঠিক থাকে না। নির্মাণকাজ শুরুর পর আস্তে আস্তে সময় বাড়ে, ব্যয় বাড়ে। সময় বাড়লে ব্যয় বাড়বে এটা স্বাভাবিক। দুয়েকটা বিশেষ ক্ষেত্রে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ডিজাইন পরিবর্তনের কারণে কখনও কখনও সময় ও ব্যয় বাড়তে পারে। কিন্তু নিয়মিত অধিকাংশ প্রকল্পের ব্যয় কেন বাড়বে। যারা এই প্রকল্প নেন, ডিজাইন করেন তারা নিশ্চয়ই এই কাজে দক্ষ, তারা জানেন আসলে কয়দিন লাগবে, কত খরচ হবে, কী করলে খরচ কম হবে, কীভাবে দ্রুত কাজটি করা যাবে সবই তারা জানেন। কিন্তু বাস্তবে করেন উল্টোটা। তাদের দক্ষতা, যোগ্যতা নিয়ে আমার কোনও প্রশ্ন নেই। তবে তাদের দেশপ্রেম, সততা, নিষ্ঠা নিয়ে আমার মতো অনেকের সংশয় আছে। সময় বাড়ানো, ব্যয় বাড়ানোর পেছনের গল্পটা মন্ত্রিপরিষদ সচিব যেমন জানেন, প্রধানমন্ত্রী যেমন জানেন; সাধারণ মানুষও জানেন। সময় বাড়লে ব্যয় বাড়বেই, আর ব্যয় বাড়লে ঠিকাদারের লাভ, ইঞ্জিনিয়ারের লাভ, দেশের ক্ষতি, জনগণের ক্ষতি। এখন আপনিই বলুন, ইঞ্জিনিয়ার সাহেব নিজের লাভ দেখবেন না জনগণের লাভ দেখবেন? আপনি হলে কী করতেন?

ইঞ্জিনিয়ার-ঠিকাদার একটা দুষ্টচক্র। সময় ও ব্যয় তো বাড়েই, নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে কোনোরকমে কাজ গছিয়ে বিল তুলে নেওয়া চলছে হরদম। এ যেন চুরির মহোৎসব। অবশ্য মন্ত্রিপরিষদ সচিব আনোয়ারুল ইসলাম, একে চুরি নয়, ডাকাতি বলেছেন– না বলে কারও পকেট থেকে মানিব্যাগ নিলে সেটা চুরি। আর চোখের সামনে রেখে দিলে সেটা ডাকাতি। আনোয়ারুল ইসলামের যে বক্তব্যের কথা বারবার বলছিলাম, সে অনুষ্ঠানটি হয়েছিল ‘অসহায় সেতু’ ভেঙে যাওয়ার পরদিন, মানে ৪ সেপ্টেম্বর। আগারগাঁওয়ে এলজিইডি ভবনে স্থানীয় সরকার বিভাগের উদ্যোগে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পসমূহের প্রকল্প ব্যবস্থাপনা ও জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল বাস্তবায়ন বিষয়ক সেই সভার বিশেষ অতিথি মন্ত্রিপরিষদ সচিব ভয়ংকর ক্ষিপ্ত ছিলেন। রাগে বারবার তার কথা আটকে যাচ্ছিল। কণ্ঠে অবিশ্বাস নিয়ে তিনি বারবার বলছিলেন, ‘হাউ ক্যান ইট পসিবল!’

তার সামনে নতমুখে বসেছিলেন এলজিইডির ৭৬ জন প্রকল্প পরিচালক। কারও মুখে কোনও কথা ছিল না। দু’দক খোঁজ নিলে দেখতে পাবে অধিকাংশ প্রকৌশলীর ব্যয়ের সঙ্গে আয় মেলে না। কামরুল ইসলাম সিদ্দিকীর হাতে গড়া স্বপ্নের এলজিইডি আজ ডাকাতদের অভয়াশ্রম। তবে শুধু এলজিইডি নয়, বাংলাদেশের প্রতিটি খাতেই একই চিত্র। মন্ত্রিপরিষদ সচিব সেটা বলেছেনও।

ক্ষুব্ধ মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলছিলেন, ‘কী ক্যালকুলেশন করেন? কোনও কিছুই চেঞ্জ হইলো না, কেন ছোট ছোট প্রজেক্ট রিভিশন হবে? হোয়াই?’ মন্ত্রিপরিষদ সচিব অবশ্য তাদের শুধরানোর চেষ্টা করেছেন, ‘আমাদের ধর্মে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, হারাম খেলে নামাজ হবে না। শুধু তা-ই নয়, হারাম টাকায় কেনা কোনও পোশাক যদি অন্য পোশাক স্পর্শ করে তবে নাপাক হয়ে যাবে। প্রতিদিন আয়নার সামনে দাঁড়ান, সারাদিন কী কাজ করলেন। নিজেকে প্রশ্ন করুন।’ পরহেজগার মন্ত্রিপরিষদ সচিবের বক্তব্য শুনে আমার অট্টহাসি পেয়েছে, তার সামনে ৭৬ প্রকল্প পরিচালকও নিশ্চয়ই মুচকি হেসেছেন। যারা দুর্নীতি করে, ঘুষ খায়, ডাকাতি করেন, তাদের এসব হারাম-হালাল, পাক-নাপাক, নামাজ হওয়া না হওয়া নিয়ে কোনও ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। দুর্নীতিবাজদের হিসাবটা অন্যরকম। দুর্নীতির টাকায় তারা গ্রামে বড় মসজিদ বানান, মাদ্রাসায় দান করেন, ধর্ম-কর্ম করেন। হিসাবটা হলো, দুর্নীতিতে পাপ হয়, ধর্মে-কর্মে পুণ্য হয়। পাপ-পুণ্যে কাটাকাটি, মাঝখান থেকে অর্থটা লাভ।

স্কুলে থাকতে একবার এক স্যার একটা গল্প বলেছিলেন, ধর তুই একটা গরু চুরি করলি, গুনাহ হলো? আমরা মাথা নেড়ে সায় দেই। এখন সেই গরুটা কোরবানি দিলি। আর কোরবানি দিলে তো সওয়াব হয়। আমরা বিভ্রান্ত হয়ে যাই। তবু সায় দেই। কোরবানি দিলে সওয়াব হয়, এর সঙ্গে দ্বিমত করার সাহস ছিল না। এবার স্যার ফাইনাল ডেলিভারিতে আমাদের বিভ্রান্তির শেষ সীমায় নিয়ে গেলেন, গুনাহ আর সওয়াবে কাটাকাটি, মাঝখানে মাংসটা লাভ। আমরা একে অপরের পাজলড চেহারা দেখি, খুশি হবো না বেজার হবো বুঝতে পারি না। স্যার কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমাদের অসহায়ত্ব উপভোগ করলেন, তারপর হাসতে হাসতে বললেন, আরে গাধার পাল, চুরির টাকায় কোরবানি হয় না।

চুরির টাকায় কোরবানি হয় না– এটা সেই গ্রামের স্কুলশিক্ষক জানেন, মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানেন; কিন্তু দুর্নীতিবাজ ইঞ্জিনিয়াররা জানেন না। কারণ, 'চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনি'। বাংলাদেশে অবশ্য সারা জীবন দুর্নীতি করেও বেহেশতে যাওয়ার একটা শর্টকাট রাস্তা আছে। সারা জীবন দুর্নীতি করে অবসর গ্রহণের পর শেষ জীবনে হজ করতে চলে যাবেন। পবিত্র কাবা শরিফে হজরে আসওয়াদে চুমু খাবেন। ব্যস সেই পবিত্র পাথর আপনার সারা জীবনের সব পাপ শুষে নেবে। আপনি হয়ে যাবেন নিষ্পাপ। হজ থেকে ফিরে এসে তওবা করলেন, আর খারাপ কিছু করবেন না, করলেনও না। আর দুর্নীতির অর্জিত অর্থে বাকি জীবন আয়েশ করে কাটিয়ে দিলেন। হজরে আসওয়াদে চুমু দিলে পাপ ধুয়ে যায়, তওবা করলে আল্লাহ মাফ করে দেন; এটা সত্যি। কিন্তু নিয়ত বলে একটা কথা। ৩০ বছর বয়সে পরিকল্পনা করলেন, ৭০ বছর বয়স পর্যন্ত দুর্নীতি করবেন; তারপর হজে যাবেন, তওবা করবেন; তাহলে কোনও লাভ নেই। চুরি করা গরুতে যেমন কোরবানি হয় না, হারাম খেলে যেমন নামাজ হয় না, দুর্নীতির টাকায়ও তেমনি হজ হয় না।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব ‘ধর্মকথা শুনিয়ে ডাকাত’দের শোধরানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু চোরদের ধর্মের কথা শুনিয়ে লাভ নেই। তারা তাদের হিসাব মতো বেহেশতে যাওয়ার ‘মেড ইজি পথ’ বানিয়ে রেখেছে। এই ডাকাতদের জাগতিক শাস্তি দিতে হবে। পাপের শাস্তি আল্লাহ দেবেন, অপরাধের শাস্তি এখনই দিতে হবে। তিনি বলেছেনও সে কথা, ‘সরকার আমাদের বেতন অনেক বাড়িয়েছে। তারপরও যদি কেউ চুরি করে ধরা পড়লে সরাসরি অ্যাকশন নেওয়া হবে।’ তবে নেওয়া হবে বলে থেমে থাকলে চলবে না, সরাসরি অ্যাকশন নিতে হবে।

আখাউড়ার অসহায় সেতুটি দিয়েই শুরু করুন। দায়ীদের খুঁজে বের করুন। দু’দককে বলুন, দুর্নীতিবাজদের আয়-ব্যয়ের হিসাব বের করতে। ধর্ম কথা, মিষ্টি কথা, মুখের ধমকে কাজ হবে না। সরাসরি অ্যাকশন শুরু করুন।

মাননীয় মন্ত্রিপরিষদ সচিব, নইলে মানুষ কিন্তু আপনার কথাই আপনাকে ফিরিয়ে দেবে। আপনার ভাষায় যারা ডাকাতি করছে, তাদের সর্দার কিন্তু আপনিই।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এবার ‘হুব্বা’ নামে হলো গানচিত্র
এবার ‘হুব্বা’ নামে হলো গানচিত্র
আঙুরের গোড়া কালো হয়ে যাচ্ছে? জেনে নিন টিপস
আঙুরের গোড়া কালো হয়ে যাচ্ছে? জেনে নিন টিপস
টেকনাফে ১০ জন কৃষক অপহরণের ঘটনায় ২ জন আটক
টেকনাফে ১০ জন কৃষক অপহরণের ঘটনায় ২ জন আটক
এরদোয়ানের যুক্তরাষ্ট্র সফর, যা জানা গেলো
এরদোয়ানের যুক্তরাষ্ট্র সফর, যা জানা গেলো
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ