X
বুধবার, ২৫ জুন ২০২৫
১১ আষাঢ় ১৪৩২

ধর্ষকরা কি মানুষ?

জেসমিন চৌধুরী
০৮ আগস্ট ২০১৭, ১৯:৩৩আপডেট : ০৮ আগস্ট ২০১৭, ১৯:৩৯

জেসমিন চৌধুরী ধর্ষণের বিরুদ্ধে অনেক প্রতিবাদ হচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে অপরাধীরা ধরা পড়ছে, কিছু ক্ষেত্রে শাস্তিও হচ্ছে। কিন্তু প্রতিদিনই পত্রিকায় আরও বেশি ধর্ষণের খবর দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে মহামারি আকার ধারণ করছে ধর্ষণ। 'ফেসবুক সেলিব্রেটি'রা লিখে যাচ্ছেন। নারীবাদীরা পুরুষতন্ত্রকে দোষারোপ করছেন। নারীবাদ-বিরোধীরা নারীবাদীদের পাল্টা আক্রমণ করছেন। পোস্টে হিট বাড়ছে, কিন্তু ইতিমধ্যে যারা ধর্ষিত হয়েছে তাদের কিংবা সম্ভাব্য ধর্ষিতাদের এতে কোনও উপকার হচ্ছে কি? 
অনেক বলছেন আমাদের নৈতিক অবক্ষয়ই এর জন্য দায়ী। আসলে কি তাই?
উন্নয়ন/শিক্ষা/নারী-স্বাধীনতা অথবা ধর্মচর্চার মাত্রা যাই হোক না কেন, পৃথিবীতে এমন কোনও দেশ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে ধর্ষণ ঘটে না। প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, শাস্তি কিছু দিয়েও ধর্ষণ ঠেকানো যাচ্ছে না। কারণটা কী? ধর্ষণ সংক্রান্ত বিভিন্ন বই এবং রচনায় একটা কথা উদ্ধৃত হয়েছে বারবার- ‘বেশিরভাগ মানুষই জানে না বা বোঝে না ধর্ষণ কী এবং কেন। যতদিন মানুষ এই বিষয়টা উপলব্ধি করতে সক্ষম না হবে ততদিন ধর্ষণ বন্ধ করা যাবে না’। 
মানুষের বিভিন্ন আবেগ, অনুভূতি বা মূল্যবোধের বিবর্তনমূলক কারণগুলো সম্পর্কে জ্ঞানের অভাবকে এর জন্য দায়ী করেছেন অনেক গবেষক। তাদের মতে এই জ্ঞানের অভাবেই ধর্ষণের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা নিজের আচরণ পরিবর্তনে সচেষ্ট বা সক্ষম হতে পারছে না। দীর্ঘদিন ধরে ধর্ষণ বন্ধ করার নানান রকম প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে কারণ এই প্রসঙ্গে বিবর্তনমূলক বিষয়গুলোকে আলোচনায় না এনে শুধুমাত্র আদর্শিক বা ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিষয়টিকে দেখা হচ্ছে।  
‘আ ন্যাচারাল হিস্ট্রি অব রেপ’ নামক বইটির ওপর নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত একটি ফিচারে কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছিল যার উত্তর শুধুমাত্র বিবর্তনমূলক আলোচনা থেকেই পাওয়া সম্ভব বলে মনে করেন লেখক। কেন সাধারণত অল্পবয়সী পুরুষরাই ধর্ষক এবং অল্পবয়েসী নারীরা ধর্ষিত হয়ে থাকে? ধর্ষণের মানসিক যন্ত্রণার মাত্রা কেন ধর্ষিতার বয়স, বৈবাহিক পরিস্থিতি এবং শারীরিক ক্ষতের মাত্রার ওপর নির্ভর করে? কেন সব সমাজেই ধর্ষণ ঘটে থাকলেও যুদ্ধের মতো বিশেষ পরিস্থিতিতে ধর্ষণ বেশি ঘটে থাকে? কেন ধর্ষিতাকে প্রায়ই সন্দেহের চোখে দেখা হয়? কেন ধর্ষিতার চেয়ে তার স্বামীর প্রতি বেশি সহানুভূতি প্রদর্শিত হয়? কেন বুদ্ধিমান প্রাণী হয়েও মানুষ ধর্ষণ থেকে মুক্ত হতে পারছে না?   

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে গিয়ে বইটিতে ধর্ষণের অবব্যহিত কারণগুলোর পাশাপাশি মৌলিক কারণগুলোর কথাও আলোচনা করা হয়েছে যা পরস্পরের বিকল্প নয়, বরং পরিপূরক। সাধারণত ধর্ষণের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে বলা হয়-- হয়তো লোকটা নিজে শৈশবে নির্যাতিত হয়েছিল, হয়তো অতিমাত্রায় পর্ন দেখার ফলে তার যৌন সুড়সুড়ি বেড়ে গিয়েছিল, হয়তো সে মাতাল ছিল, হয়তো সে তার মাকে ঘৃণা করে, হয়তো সে নিয়ন্ত্রণকামী, হয়তো তার জিনেই হিংস্রতা রয়েছে। কিন্তু যেসব মৌলিক কারণের অস্তিত্বের ফলে এসব কারণের উপস্থিতি ঘটে থাকে, সেসব সম্পর্কে মানুষের তেমন একটা ধারণাই নেই বলে দাবি করেন বিবর্তনবাদী বৈজ্ঞানিকরা।  

ধর্ষকদের প্রায়ই ‘কুকুর’ বা ‘শুকর’ বলে গালি দেওয়া হয়। সুযোগ থাকলে এই পশুরা মানুষদের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করত নিশ্চয়ই। কারণ বিভিন্ন পশুর মধ্যে ধর্ষণ-প্রবণতা থাকলেও কুকুর বা শুকরকে এই অপবাদ দেওয়া যাবে না। কুকুরের মধ্যে একটা বিশেষ মৌসুমে যৌনতাড়নার আধিক্য দেখা গেলেও মানুষের মতো তা বছরব্যাপী নয়। কিছু কীট-পতঙ্গ, পাখি এবং পশুর মধ্যে বলপূর্বক যৌনতা দেখা যায়। যখন স্বাভাবিক যৌন আমন্ত্রণ বা প্রলোভন কাজ করে না তখন তারা বংশানু ছড়িয়ে দেওয়ার তাড়নায় বলপূর্বক যৌন সঙ্গমে লিপ্ত হয় যা অনেক সময় বেশ হিংস্রও হয়ে থাকে কিন্তু পশুর ক্ষেত্রে ‘সম্মতি’র বিষয়টা স্পষ্ট নয় বলে একে ধর্ষণ বলা যাবে কিনা এ নিয়েও যথেষ্ট বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। সবকিছুর পর, মানুষের মতো সব পশুরা ভেবে চিন্তে পরিকল্পনা করে নয়, বরং তাৎক্ষণিক প্রবণতার বশেই ধর্ষণ করে থাকে।  

ধর্ষকদেরকে নিম্নবুদ্ধির পশুর সাথে তুলনা করা মোটেই যুক্তিযুক্ত নয় কারণ যেসব পশুকে বুদ্ধিমত্তা এবং সামাজিক আচরণের দিক দিয়ে অপেক্ষাকৃতভাবে মানুষের কাছাকাছি ধরা হয়ে থাকে তাদের মধ্যেই মানুষের মতো ধর্ষণ প্রবণতা দেখা গেছে। যেমন ডলফিন এবং বানরের মধ্যে মানুষের মতই বলপূর্বক যৌন মিলনের মাধ্যমে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার বা অধীনতা আদায়ের সুব্যক্ত অভিপ্রায় প্রকাশ পায়।   

একটা দিক দিয়ে বিচার করলে মানুষের মধ্যকার ধর্ষণ প্রবণতা একটু বেশিই দুর্বোধ্য এবং অনাকাঙ্ক্ষিত। মানুষই একমাত্র প্রাণী যার মধ্যে স্বার্থহীনতা, দেশপ্রেম, ধর্মবিশ্বাস, সংস্কৃতি চর্চার মতো বিষয়গুলো রয়েছে যেগুলোর মাধ্যমে সে একটা সুন্দর জীবন সৃষ্টির চেষ্টায় তৎপর। তারপরও কেন মানুষ এরকম হিংস্র কাজে লিপ্ত হয় যা পশু জগতেও বিরল?

যদিও এসব মতবাদ নিয়ে যথেষ্ট দ্বিমত রয়েছে, বিবর্তনবাদী বৈজ্ঞানিকরা বিষয়টাকে এভাবে উপস্থাপন করেন- আদিম মানুষের জীবনে প্রজননের পথের নানান বাধার সাথে ধর্ষণের ঘনিষ্ঠ যোগসূত্রতা রয়েছে। যেহেতু যৌন সঙ্গমের অবধারিত ফসল শিশু পালনের ক্ষেত্রে নারীকে অনেক বেশি সময় ও শক্তি দিতে হতো কাজেই তার জন্য একজন এবং শুধুমাত্র একজন উচ্চমানের পুরুষের সাথে সঙ্গম করাটাই ছিল সুবিধাজনক। অন্যদিকে সন্তানপালনের ক্ষেত্রে পুরুষের ভূমিকা অত্যন্ত ক্ষুদ্র হওয়াতে যত বেশি নারীর সাথে সম্ভব সঙ্গম করাই ছিল লাভজনক। টিকে থাকার চেষ্টায় নারী একদিকে নিজেকে দুর্লভ করার চেষ্টা করেছে আবার অন্যদিকে পুরুষ নিজের বীর্য ছড়িয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টায় শারীরিক শক্তির সুবিধা নিয়ে নারীর ওপর জোর খাটিয়েছে। নারী এবং পুরুষের ভিন্ন মাত্রার যৌন চাহিদার এই আদিম সমস্যা থেকেই আজকের ধর্ষণের কালচার অভিযোজিত হয়েছে বলে মনে করেন বিবর্তনবাদীরা। অন্যভাষায় বলতে গেলে পুরুষতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে নারীর ওপর পুরুষের জোর খাটানোর বিষয়টা জড়িত।

কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে বর্তমানে আকস্মিকভাবে ধর্ষণের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ কী? আজকের পুরুষ কি আরো বেশি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে? টিকে থাকার যুদ্ধে হেরে যাওয়ার ভয়ে বেশি বেশি যৌন সঙ্গমের দিকে তাড়িত করছে তাকে তার স্বার্থপর জিন? আর তাই সে যখন তখন ঝাঁপিয়ে পড়ছে শারীরিকভাবে দুর্বলতর অথচ অনিচ্ছুক নারীর ওপর? কারণ যাই হোক না কেন, বিশেষজ্ঞরা মনে করেন ধর্ষণ ঠেকাতে হলে নারী পুরুষ সবাইকে ধর্ষণের মূল এবং কারণগুলো সম্পর্কে সচেতন হতে হবে, নারীদেরকে আরও অনেক বেশি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এলোমেলো আলোচনায় না গিয়ে এই বিষয়ে প্রতিটি সমাজে সচেতনতামূলক কোর্সের ব্যবস্থা করতে পারলে হয়তো কিছুটা উপকার হতো।  

লেখক: অভিবাসী শিক্ষক ও অনুবাদক

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিতের দাবি আসকের
গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিতের দাবি আসকের
১৯ জুলাই সমাবেশ করবে জামায়াত
১৯ জুলাই সমাবেশ করবে জামায়াত
স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির এইচওডি-পিআরডি হলেন প্রদীপ্ত মোবারক
স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির এইচওডি-পিআরডি হলেন প্রদীপ্ত মোবারক
তিন অধ্যাদেশে অর্থনৈতিক সংস্কারের রূপরেখা: অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রগতি প্রতিবেদন প্রকাশ
তিন অধ্যাদেশে অর্থনৈতিক সংস্কারের রূপরেখা: অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রগতি প্রতিবেদন প্রকাশ
সর্বশেষসর্বাধিক