X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৭ বৈশাখ ১৪৩১

ইসি নিয়ে ‘ছি ছি’

বিভুরঞ্জন সরকার
১১ জুন ২০১৮, ১৬:৫০আপডেট : ১১ জুন ২০১৮, ১৬:৫২

বিভুরঞ্জন সরকার নির্বাচন কমিশন বিতর্কমুক্ত হতে পারছে না। কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বে গঠিত বর্তমান নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। বিশেষ করে বিএনপি এই কমিশনের ওপর আস্থা রাখতে পারেনি, পারছে না। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থার প্রশ্নে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। গত ২৯ মে সিইসি ও অন্য কমিশনারদের সঙ্গে এক বৈঠক শেষে বিএনপি নেতারা তাদের এই মনোভাবের কথা জানিয়েছেন।
গত ১৫ মে খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচন হয়েছে। ওই নির্বাচনে জয় পেয়েছে আওয়ামী লীগ। হেরেছে বিএনপি। বিএনপির অভিযোগ, খুলনায় তাদের হারিয়ে দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। নির্বাচন কমিশন খুলনায় পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করেছে। আওয়ামী লীগকে জয়ী করার জন্য সরকার যে ছক বা পরিকল্পনা করে এগিয়েছে, নির্বাচন কমিশন তা সুচারুভাবে বাস্তবায়ন করেছে। বিএনপির কোনও অভিযোগ আমলে নেওয়া হয়নি, কিন্তু আওয়ামী লীগের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কমিশন দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে। সরকারের ইচ্ছাপূরণ করাই যেন নির্বাচন কমিশনের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিএনপির এসব অভিযোগের সঙ্গে আরও কিছু সংগঠন ও ব্যক্তিকেও সুর মিলাতে দেখা যাচ্ছে। স্বাধীন নির্বাচন কমিশন তাদের দায়িত্ব পালনে স্বাধীন নয় বলে প্রচার করা হচ্ছে এবং সেটা ধীরে ধীরে অনেকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে। নির্বাচন কমিশনকে সরকারের আজ্ঞাবহ বলা হচ্ছে। নির্বাচন কমিশন নিজেদের কাজ দিয়ে শক্ত অবস্থান তুলে ধরতে পারছে না। অথচ নির্বাচন কমিশনের ওপর মানুষের অনাস্থা বাড়লে সেটা নির্বাচন ব্যবস্থাকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করবে। নিজেদের শক্তি-সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়ে নির্বাচন কমিশনকে মানুষের মধ্যে, বিশেষ করে নির্বাচনসংশ্লিষ্ট অংশীজনের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। কিন্তু সেদিকে নির্বাচন কমিশনের কোনও আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন গত বছর ৩১ জুলাই থেকে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ, নির্বাচন বিশেষজ্ঞ, নারী নেত্রী ও পর্যবেক্ষক সংস্থার সঙ্গে মতবিনিময়ের আয়োজন করা হয়েছিল। এসব সংলাপে পাওয়া গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন সামনে অগ্রসর হবে বলে আশা করা হয়েছিল। সবচেয়ে বড় বিষয় ছিল নির্বাচন কমিশনের আস্থা অর্জন। প্রায় সবসময় সব নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে যে অভিযোগটি বেশি উচ্চারিত হয়, সেটা হলো সরকারের প্রতি তাদের অতিনির্ভরতা। দুই-একটি বিরল ব্যতিক্রম বাদে এযাবৎকালের বেশিরভাগ নির্বাচন কমিশনই সরকারের প্রভাবমুক্ত থেকে কাজ করে প্রশংসিত হতে পেরেছে। আজ্ঞাবহ বা নতজানু নির্বাচন কমিশন নিয়ে সমালোচনা তাই ধারাবাহিকভাবেই চলছে।

আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক বৈরিতাপূর্ণ। বিশেষ করে প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দল সবসময় বিপরীত অবস্থানে থাকতে পছন্দ করে। এই বিভাজনের রাজনীতির মধ্যে মেরুদণ্ড শক্ত একটি নির্বাচন কমিশন ছাড়া দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান কঠিন। অথচ আমরা প্রায়ই দুর্বল নির্বাচন কমিশন পেয়ে আসছি। আর সে জন্য নির্বাচন কমিশন নিয়ে ছি ছিও দূর হচ্ছে না।

সবারই উচিত অতীত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়া। এই উচিত কাজটির প্রতি আমাদের প্রবল অনীহা। সেজন্যই অতীত ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেখা যায়। দায়িত্ববোধ ও দেশপ্রেমের অভাবের জন্য সমস্যা তৈরি হয়। একটি নির্বাচন কমিশন যখন গঠন করা হয়, তখন শুরুই হয় তাদের প্রতি অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতা দিয়ে। তারাও কাজ শুরু করেন একটা ভয়ের অবস্থান থেকে। সাহসী মনোভাব না দেখিয়ে তারা সরকারের দিকে ঝুঁকে থাকেন। তারা হয়তো মনে করেন, সবাইকে, সব পক্ষকে খুশি করা যেহেতু তাদের পক্ষে সম্ভব নয়, সেহেতু তারা সরকারকেই খুশি রাখবেন। কারণ এতে তারা ঝুঁকিমুক্ত ও নিরাপদ থাকবেন। কোনও সাংবিধানিক পদে নিয়োগপ্রাপ্তদের কাছে যে উচ্চ-নৈতিকতা প্রত্যাশিত সেটা বাস্তবে পাওয়া যায় না।

বর্তমান নির্বাচন কমিশন, যার নেতৃত্বে আছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ( সিইসি) কে এম নুরুল হুদা, মানুষের সামনে ব্যতিক্রমী ইমেজ নিয়ে না দাঁড়িয়ে পূর্বসূরিদের জুতোই পায়ে পরেছেন। বিতর্ক তাদের ছাড়ছে না, তারাও বিতর্ক ছাড়ানোর মতো কোনও কাজ করছেন না।

সর্বশেষ, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সংসদ সদস্যদের প্রচারণার সুযোগ দিয়ে বিধি সংশোধনের প্রস্তাব করে নির্বাচন কমিশন নতুন বিতর্কের সৃষ্টিতে সহায়তা করেছে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সংসদ সদস্যদের সিটি নির্বাচনে প্রচারণার সুযোগ দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছিল। বিএনপি সরকারে নেই, সংসদে নেই। তাই তাদের বড় বড় নেতারা সিটি নির্বাচনে প্রচারণায় অংশ নিতে পারছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতারা সেটা পারেন না। কারণ আওয়ামী লীগের বড়ো নেতারা হয় মন্ত্রী অথবা এমপি। নির্বাচনি আচরণবিধি অনুযায়ী মন্ত্রী-এমপিরা প্রচারণায় অংশ নিতে পারেন না। মন্ত্রীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা মেনে নিলেও সংসদ সদস্যদের ব্যাপারটিকে আওয়ামী লীগ অন্যায্য মনে করে এই বিধি সংশোধনের আহ্বান জানায়। আওয়ামী লীগের দাবি পূরণে নির্বাচন কমিশন দ্রুত এগিয়ে আসে এবং তা বাস্তবায়নে তৎপর হয়। কমিশনের এই অতিউৎসাহ যেমন সরকারের উপকারে আসছে না, তেমনি নির্বাচন কমিশনও সমালোচিত হচ্ছে। এমন কাজ নির্বাচন কমিশন কেন করবে, যেটা কারও কাছ থেকেই প্রশংসা পাবে না?

সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সংসদ সদস্যদের প্রচার-প্রচারণায় অংশ নিতে বিএনপি এখন আপত্তি করছে, তার বড় কারণ তাদের কোনও সংসদ সদস্য নেই। এই বিধান যদি চালু হয়, তাহলে বিএনপি ক্ষমতায় এলেও তা বজায় থাকবে। কারণ ক্ষমতার বাইরে গিয়ে যে নীতির বিরোধিতা বা সমালোচনা করা হয়, ক্ষমতায় গিয়ে সেটার পক্ষে থাকার বহু নজির আমাদের সামনে আছে।

বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে প্রথম বড় নির্বাচন হয় কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে। তখনও বিএনপি বলেছিল, এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। নির্বাচন কমিশন নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ তো নয়ই, বরং সরকারের হয়ে কাজ করে। কুমিল্লা নির্বাচনের দিনও বিএনপি নানা ধরনের অনিয়মের অভিযোগ তুলেছে। অবশ্য নির্বাচন শেষে ফল ঘোষণা হলে বিএনপি আর কোনও অভিযোগ করেনি। কারণ কুমিল্লায় মেয়র পদে জয় পেয়েছেন বিএনপি প্রার্থী। তখন অনেকেই মনে করেছিলেন, নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে বিএনপির অভিযোগ অমূলক। নির্বাচন কমিশন পক্ষপাত দেখালে আওয়ামী লীগ প্রার্থী হারলেন কেন?

কুমিল্লার নির্বাচনের পর বিএনপি নির্বাচন কমিশনের ব্যাপারে কিছুটা নমনীয় হয়েছিল। এরপর রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়। জয় পায় জাতীয় পার্টি। রংপুরে বিএনপি তৃতীয় স্থানে। ধারণা করা হয়েছিল, কুমিল্লায় যেহেতু আওয়ামী লীগ হেরেছে,সেহেতু রংপুরে জয় পাওয়ার জন্য তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করবে। জোর করেই আওয়ামী লীগ ভোটের ফল নিজেদের অনুকূলে নেবে বলে মনে করা হচ্ছিল। নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগকে সহায়তা করবে। কিন্তু বাস্তবে তেমনটা হয়নি। রংপুরের সিটি নির্বাচনও প্রভাবমুক্ত হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের ব্যাপারে সাধারণ মানুষের মধ্যে তেমন বিরূপ মনোভাব দেখা যায়নি।

খুলনা সিটি নির্বাচনের পর এখন বিএনপি আবার নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে শক্ত মনোভাব গ্রহণ করছে বলে মনে করছে। খুলনায় আওয়ামী লীগের বিজয় বিএনপিকে স্বাভাবিকভাবেই হতাশ করেছে। বিএনপির ধারণা ছিল খালেদা জিয়াকে কারাগারে রাখায় এবং তার অসুস্থতার খবর বেশি করে প্রচার করায় ভোটারদের মনে বিএনপির প্রতি যে সহানুভূতি তৈরি হবে, সেটাই তাদের প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত করবে। এছাড়া মানুষের মধ্যে সরকারবিরোধী যে মনোভাব আছে, সেটি বিএনপির পক্ষে যাবে। কিন্তু বাস্তবে খুলনায় ‘সহানুভূতিতত্ত্ব’ কাজে দেয়নি। বিএনপি খুলনায় মেয়র পদ পেলেও যে খালেদা জিয়ার মুক্তিলাভ সহজ হবে না সেটা মানুষ বুঝেছে।

নির্বাচনে হারলে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি বলে অভিযোগ করা আমাদের দেশে একটি রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অপসংস্কৃতি থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে যেমন বেরিয়ে আসতে হবে, তেমনি নির্বাচন কমিশনকেও তার অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে হবে। সংবিধান নির্বাচনের সময় কমিশনকে যে ক্ষমতা দিয়েছে সে ক্ষমতা প্রয়োগে তাদের যত্নবান হতে হবে। ক্ষমতার অপপ্রয়োগ ভালো নয়। প্রয়োগ না করাটাও গ্রহণযোগ্য নয়। মানুষ তো নাকি স্বভাবতই প্রশংসা শুনতে পছন্দ করে। তাহলে যারা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন তারা কেন ‘ছি ছি’ শুনতে ভালোবাসেন?

বিএনপি ইসি প্রশ্নে গাজীপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চেয়েছে। এটা রাজনৈতিক হুমকি। গাজীপুরে ‘ফেয়ার’ নির্বাচনে যদি বিএনপি হারে ও বলতে থাকে যে তাদের হারিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাহলে মানুষ বিএনপিকেই দুষবে। তবে মানুষের কাছে এটা বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে যে, নির্বাচনটি ‘ফেয়ার’ হয়েছে। একটা মোটামুটি ‘ফ্রি-ফেয়ার’ নির্বাচন করে নির্বাচন কমিশন বিএনপির চ্যালেঞ্জের জবাব দিতে প্রস্তুত আছে কি?

লেখক: কলামিস্ট

 

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রাজশাহীতে গরমে নাকাল প্রাণিকুল, মারা যাচ্ছে পাখি
রাজশাহীতে গরমে নাকাল প্রাণিকুল, মারা যাচ্ছে পাখি
দুর্নীতির অভিযোগে ইসলামপুর পৌর মেয়র বরখাস্ত
দুর্নীতির অভিযোগে ইসলামপুর পৌর মেয়র বরখাস্ত
মাটি কাটার সময় ‘গরমে অসুস্থ হয়ে’ নারী শ্রমিকের মৃত্যু
মাটি কাটার সময় ‘গরমে অসুস্থ হয়ে’ নারী শ্রমিকের মৃত্যু
সাকিবের সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সাক্ষাৎ
সাকিবের সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সাক্ষাৎ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ