X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

বৃহত্তর ঐক্যের গহিনে অনৈক্যের আলামত

মোস্তফা হোসেইন
২৭ আগস্ট ২০১৮, ১৪:৫২আপডেট : ২৭ আগস্ট ২০১৮, ২০:৪৫

মোস্তফা হোসেইন জামায়াতকে ছাড়তে পারছে না বিএনপি। আবার উদারপন্থী কিছু দলের সহযোগিতার আশাও পোষণ করছে। অথচ দুটো বিষয় পরস্পরবিরোধী, তেল ও জলের মতো। শনিবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে কারাগারে দেখা করে রাতেই ‘বৃহত্তর ঐক্য’ পরিচয়ে নতুন মোর্চার ঘোষণা দিলেন। এও স্পষ্ট করে দিলেন, জামায়াত-সঙ্গ তারা ত্যাগে রাজি নন। তার বক্তব্য শুনে মনে হতে পারে, অন্য পক্ষগুলোর ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত হয়েই এই কথা বলছেন।
যদি মনে করা হয়, তিনি নিশ্চিত হয়ে বলেছেন, তখন বেশ কিছু প্রশ্নের জন্ম দিতেই পারে। প্রথমত কথা হচ্ছে– বিএনপি আবারও একাত্তরের পরাজিত শক্তি জামায়াতকে প্রশ্রয় ও সহযোগিতা করছে। এবং নতুন উদ্যোগ সফল হলেও প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে বাকিদেরও।
প্রথমেই বলা যায়, বিকল্প ধারার কথা। দলটির প্রধান অধ্যাপক ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী একসময় বিএনপির নেতা ছিলেন। শুধু তাই নয়, প্রতিষ্ঠাকালে জেনারেল জিয়াউর রহমানের প্রধান সহযোগী এবং জিয়াউর রহমানের মৃত্যুকালেও তার সঙ্গী ছিলেন। দলের মহাসচিব হিসেবে চরম সাম্প্রদায়িক দল ও একাত্তরের পরাজিত শক্তি জামায়াতকে বাংলাদেশে পুনর্বাসিত করার ক্ষেত্রে তারও ভূমিকা ছিল। কিন্তু পর্যায়ক্রমে তিনি বুঝতে পারেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের জন্য এই দলটি হুমকিস্বরূপ। একই কারণে হয়তো তিনি স্পষ্ট করে বলে দিয়েছিলেন, জোটই শুধু নয়, বৃহত্তর ঐক্যের প্রয়োজনেও বিএনপিকে জামায়াত-সঙ্গ ত্যাগ করতে হবে। অর্থাৎ বিএনপি যদি জামায়াত-সঙ্গ ত্যাগ করে, তাহলে তিনি ভেবে দেখবেন বৃহত্তর ঐক্য হবে কিনা।

বিকল্প ধারার দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে খ্যাত মাহী বি চৌধুরীও বলেছেন, ‘জামায়াতকে বন্ধু হিসেবে রেখে বিকল্প ধারা বিএনপি’র সঙ্গে কোনও ঐক্য করবে না।’

কেউ যদি মনে করেন, বি চৌধুরীকে বিএনপি ন্যক্কারজনকভাবে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে বের করেছিলো বলে বিকল্প ধারা এমন বক্তব্য দিচ্ছে, তা তিনি ভাবতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে–এটাই বিকল্প ধারার পথ।

ঐক্য প্রশ্নে বিকল্প ধারার আরেকটি প্রস্তাব হচ্ছে, আসনভিত্তিক ভারসাম্য আনতে হবে। এই একটি বাক্য অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। বিএনপি কি এই প্রস্তাবে রাজি হবে? ২০ দলীয় জোটের অন্যতম দল জামায়াতে ইসলামী হলুদ কার্ড দেখিয়েছে গত তিন সিটি নির্বাচনকালে। সিলেটে তো তারা বিএনপির অনুরোধ উপেক্ষা করে মেয়র পদে প্রার্থী দিয়েছে। রাজশাহীতে তাদের ডজনের বেশি ওয়ার্ডে প্রার্থী ছিল কাউন্সিলর পদে। তাদের কাঙ্ক্ষিত ১০০ আসনে মনোনয়ন কমিয়ে আনতে আনতে যদি অর্ধেকেও আনা হয় তাও কি বিএনপি ছাড়তে পারবে?

ধরা যাক, ক্ষমতার পরিবর্তনের জন্য তারা জামায়াতকে ৫০ আসন ছাড় দিলো। তাহলে থাকে ২৫০ আসন। এই আসন থেকে বি চৌধুরী সাহেবের ফর্মুলার আসনভিত্তিক সমঝোতায় যেতে হলে একপর্যায়ে যে মনোনয়নেই বিএনপি সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে। সেটা কি দল হিসেবে বিএনপি’র পক্ষে সম্ভব হবে?

ধরা যাক, ২০১৪ সালে বৃহত্তর ঐক্য গড়তে না পারার দুর্নাম কাটাতে তারা বৃহত্তর ঐক্যের জন্য বৃহত্তর ত্যাগে রাজি হলো। অর্থাৎ জামায়াত ও যুক্তফ্রন্টকে অধিকাংশ আসন ছেড়ে দিলো। কেউ হয়তো এর পক্ষে যুক্তি হিসেবে মনে করতে পারেন, বিএনপির সামনে এখন আর কোনও পথ নেই, তাই এটা করাও অস্বাভাবিক নয়। এমন হলে, বিএনপির সাংগঠনিক ধস নিশ্চিত হবে নাকি?

অন্তত শতাধিক নিশ্চিত প্রার্থী আগেই জানতে পারবেন তারা নির্বাচনে মনোনয়ন পাচ্ছেন না। এবং তারা নির্বাচনে বিজয়ী হলেও ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে না। তাদের আদর্শিক বৈপরীত্য তো থেকেই যাবে। বি চৌধুরী সাহেব যাকে স্বেচ্ছাচারী হওয়া থেকে রক্ষার প্রেসক্রিপসন দেন, সেই প্রেসক্রিপসন যে কোন্দল রোগে আক্রান্ত হবে তাও তারা দেখবেন। সুতরাং এই মনোনয়ন বঞ্চিত বিএনপি নেতারা কি এবাউট টার্ন করবে না? সেক্ষেত্রে বৃহত্তর ঐক্য কি তরী হিসেবে কাজ করবে?

বৃহত্তর ঐক্য প্রতিষ্ঠার পর বদরুদ্দোজা চৌধুরীর মতো প্রশ্নের মুখে পড়বেন ড. কামাল হোসেনও। ড. কামাল হোসেন, যিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সহচর। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব। স্পষ্টভাবেই বলেছেন ঐক্য হতে হলে, বাহাত্তরের সংবিধানকে সামনে রেখে হতে হবে। যার মানে হচ্ছে– ঐক্যে কোনোভাবেই জামায়াতের মতো স্বাধীনতাবিরোধী দল থাকতে পারবে না। জামায়াত-সঙ্গ ত্যাগ না করলে বাহাত্তরের সংবিধানের পরিপন্থী পথেই হাঁটতে হবে। ওই সংবিধানই বলে দিয়েছে, জামায়াতের মতো স্বাধীনতাবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক শক্তির রাজনৈতিক অধিকার থাকতে পারে না। এক্ষেত্রে ড. কামালকে বলতে হবে– তিনি তাঁর বক্তব্য প্রত্যাহার করছেন। নতুবা বলতে হবে, স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তার যে কমিটমেন্ট আছে সেটাও তিনি পাশ কাটিয়ে যাচ্ছেন।

বৃহত্তর ঐক্যের প্রশ্নে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে দেনদরবার করছেন মির্জা ফখরুল সাহেব ও তার দল। সেই বঙ্গবীর মির্জা সাহেবের নেত্রীর সঙ্গে দেখা করার পর বহু আগেই বলে দিয়েছেন, জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে তিনি জান্নাতেও যেতে রাজি নন। এই বক্তব্যের মধ্যেই বলা যায়, তিনি কি ক্ষমতার মতো ক্ষণস্থায়ী প্রাপ্তির জন্য জামায়াতকে বৃহত্তর ঐক্য প্রক্রিয়ায় রেখে বিএনপির সঙ্গে যেতে পারেন?

যে বৈঠকে কাদের সিদ্দিকী জান্নাতেও যেতে না চাওয়ার কথা বলেছিলেন, সেই বৈঠকের পরই আরেকটি কথা বলেছিলেন–যে বা যারা শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করবে তিনি তাদের প্রতিরোধ করবেন। কথা হচ্ছে, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার কুশীলব হিসেবে বিএনপির সংশ্লিষ্টতা ব্যাপক আলোচিত। বিএনপি সরকারে থাকাকালে এই ঘটনা ঘটা, আলামত বিনষ্ট করা, জজ মিয়া নাটক, অন্যতম অভিযুক্ত মাওলানা তাজুল ইসলামকে বিদেশ যেতে সাহায্য করার পর কি বিএনপি হাসিনা হত্যা প্রচেষ্টার অভিযোগ থেকে মুক্ত হতে পারছে? কাদের সিদ্দিকীর বক্তব্য অনুযায়ী, শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করা হলে তিনি জীবন দিয়ে হলেও তা রোধ করবেন বলে যে ঘোষণা দিয়েছিলেন সেই বিএনপির সঙ্গে তিনি কি করে ঐক্য করবেন?

আদালতে রায় কী হবে তা ভবিষ্যতের বিষয়। কিন্তু আমজনতা হিসেবে নিশ্চয়ই আমরা শুধু এটুকু বলতে পারি, বিএনপি সরকারে থাকায় ২৪ খুন আর শেখ হাসিনাকে হত্যা প্রচেষ্টার দায় তাদের নিতে হবে। তার রাজনৈতিক বোন শেখ হাসিনাকে হত্যা প্রচেষ্টাকারীদের জীবন দিয়ে রোধ করতে গেলে কি ঐক্য সম্ভব হবে? আর সেই ঐক্য নিয়ে কি বিএনপিও স্বস্তিবোধ করবে?

এবার আসা যাক বাম দলগুলোর প্রসঙ্গে। বাম রাজনীতির বড় দল কমিউনিস্ট পার্টি। তার সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেছেন, ‘বিএনপি আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করে। আমরাও বিরোধিতা করি। কিন্তু বিএনপি প্রতিক্রিয়াশীল ডানপন্থী অবস্থানে থেকে করছে। আর আমরা প্রগতিশীল বামপন্থী অবস্থানে। সুতরাং অবস্থানগত নীতি-আদর্শের দিক থেকে বিপরীত।.. জাতীয় ঐক্য সমমনা দলের মধ্যে হয়। বিএনপি-আওয়ামী লীগ সমমনা দল। তাদের কোনও দলের সঙ্গেই আমাদের ঐক্য হতে পারে না। ঐক্যের একটি নীতিগত ভিত্তি থাকতে হয়। এই নীতিগত ভিত্তি যাদের সঙ্গে মিলবে তাদের সঙ্গেই ঐক্য হবে।’

তার মানে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, বাম দলগুলোর যে জোট হয়েছে, তারাও জামায়াত বিএনপির সঙ্গে জোট কিংবা ঐক্য প্রক্রিয়ায় অংশ নিচ্ছে না।

হয়তো মাহমুদুর রহমান মান্না শেষ পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে যাবেন বিএনপির সঙ্গে ঐক্য করে নিজের একটা অবস্থান তৈরি করার। সেক্ষেত্রে যুক্তফ্রন্ট নামের কয়েক ব্যক্তিকেন্দ্রিক জোটও কি টিকে থাকবে?

সুতরাং মির্জা ফখরুল ইসলামের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী, যদি বৃহত্তর ঐক্য হয়ও সেটা নির্বাচনপূর্ব পর্যন্ত কি ভূমিকা রাখবে তা ভেবে দেখার বিষয়। সন্দেহ আর সংকটের এই ঐক্য নির্বাচনেও কোনও প্রভাব ফেলবে কিনা তাও প্রশ্নাতীত নয়।

লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ের গবেষক।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বিএনপি নেতারা ‘সিম্প্যাথি কার্ড’ খেলার অপচেষ্টা করছে: কাদের
বিএনপি নেতারা ‘সিম্প্যাথি কার্ড’ খেলার অপচেষ্টা করছে: কাদের
গ্রন্থাগার অধিদফতরের কাজে গতি আনতে কামাল চৌধুরীর আহ্বান
গ্রন্থাগার অধিদফতরের কাজে গতি আনতে কামাল চৌধুরীর আহ্বান
মীরসরাই প্রেসক্লাবের নতুন কমিটি ঘোষণা
মীরসরাই প্রেসক্লাবের নতুন কমিটি ঘোষণা
এআইইউবিতে সিএস ফেস্ট
এআইইউবিতে সিএস ফেস্ট
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ