বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করা, নিচু করে দেখানোর নানারকম ষড়যন্ত্র লন্ডন থেকে হয়ে আসছে বহু বছর ধরে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী একটি মৌলবাদী চক্র সেখানে দীর্ঘদিন থেকে ঘাঁটি করে আছে। যখনই সুযোগ পায় এই চক্রটি তখনই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মুখ খোলে। সম্প্রতি তার আরেকটি নমুনা দেখা গেলো। এবার তাতে জড়িয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেবার দলীয় এমপি রুপা হক। বাংলাদেশ সম্পর্কে সমালোচনা করার অনেক কিছুই থাকতে পারে, কিন্তু রুপা হকের সমালোচনা কিছুটা উদ্ভট এবং তার রাজনৈতিক জ্ঞান-গরিমার সীমাবদ্ধতাকে প্রকাশ করে।
রুপা হকের বাবা পাবনা থেকে ব্রিটেনে গিয়েছেন ভাগ্যান্বেষণে। রুপার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা ব্রিটেনে বলেই হয়তো তিনি ‘সাহেব হয়ে’ ‘বাঙাল’ সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখেন না। বাংলাদেশ সম্পর্কে রুপা হকের জ্ঞানও সীমিত। বাংলাদেশের মানুষ রুপাসহ চার বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ এমপিকে নিয়ে গর্ব করে। কিন্তু রুপা আক্রমণ করেছেন শুধু বাংলাদেশের বর্তমান সরকারকে নয়, বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেও স্বীকার করতে তার আপত্তি।
পাঠকের সুবিধার্থে একটু ব্যাকগ্রাউন্ড ইনফরমেশন দেওয়া দরকার। ব্রিটেনের বিরোধী লেবার পার্টির ‘লেবার ক্যাম্পেইন ফর হিউম্যান রাইটস’-এলসিএইচআর নামে একটি সংগঠন রয়েছে। মানবাধিকার নিয়ে আগ্রহী লেবার দলীয় সদস্য এবং মানবাধিকারের প্রতি আগ্রহী অন্যদের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে এরা কাজ করে। মূলত আলোচনা, ইভেন্ট, ব্লগ, সোশ্যাল মিডিয়া এবং প্রচারের মাধ্যমে তারা কাজ করে থাকে। লেবার পার্টির নীতির কেন্দ্রবিন্দুতে মানবাধিকারকে নিশ্চিত করা এবং অব্যাহত রাখা এলসিএইচআর-এর প্রধান লক্ষ্য বলে দাবি করে তারা।
এবার আসল কথায় আসি। এলসিএইচআর গত ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ব্রিটিশ আইনসভা হাউজ অব কমন্সে ‘ব্রিটেন অ্যান্ড বাংলাদেশ’ শিরোনামের একটি প্রকাশনাকে কেন্দ্র করে এক আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সেই অনুষ্ঠানটি নিয়ে দুটো লেখা আমার চোখে পড়েছে। একটি রুপা হকের বক্তব্য নিয়ে ‘নেত্র’ নামের ওয়েব পোর্টালে প্রকাশিত সংবাদ। আরেকটি এলসিএইচআর সদস্য এবং লন্ডনভিত্তিক সাংবাদিক স্টিফেন দেলাহুন্টির কলাম। সেটিও প্রকাশিত হয়েছে ওই পোর্টালে, যার ইংরেজি বিভাগের সম্পাদক ডেভিড বার্গম্যান। ডেভিড বার্গম্যানকে বোধহয় নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার দরকার নেই। তিনি বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্কিত।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক ও চেয়ার ম্যাথিউ টার্নার। সেখানে আরও বক্তব্য রাখেন ব্র্যাক ইউকের বোর্ড সদস্য ও গ্রেটার লন্ডন অ্যাসেম্বলির সাবেক লেবার সদস্য মুরাদ কোরেশী, সামাজিক নীতিমালা ও ত্রাণ বিশেষজ্ঞ হালিমা বেগম, ফটোসাংবাদিক শহীদুল আলমের বোন কাজী নাজমা করিম, ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিভাগের শিক্ষক রুমানা হাশেম এবং ডেভিড বার্গম্যান।
স্টিফেন দেলাহুন্টি তার লেখায় ব্রিটেন বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি মিত্র, তৃতীয় বৃহত্তম রফতানিকারক, তৃতীয় বৃহত্তম বিদেশি বিনিয়োগকারী এবং অর্থ প্রেরণের চতুর্থ বৃহত্তম উৎস রাষ্ট্র বলে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন শেখ হাসিনার সরকারের ‘গণতন্ত্র হ্রাস করা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন করার’ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তিনি বলেন, গত ৪ ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে তথ্য উপস্থাপন করে তারা দেখিয়েছেন কীভাবে ব্রিটেনের বৃহত্তম খুচরা বিক্রেতারা বিশ্বব্যাপী সস্তা সেলাই খুঁজছে এবং বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশ থেকে স্বল্পমূল্যে বিপুল হাল ফ্যাশনের পোশাক আমদানি করছে। যারা এটা তৈরি করে তাদের অধিকার খর্ব করার বিনিময়ে দাম কমিয়ে (cut-price) পোশাক পণ্যগুলো সেখানে নেওয়া হয়।
স্টিফেন ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের কোনও প্রশংসা তো করেননি, বরং রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশকে ব্রিটেন ২০১৭ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত মোট ২২৬ মিলিয়ন ডলার সাহায্য করার কথা উল্লেখ করে সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক ব্যর্থতার দিকে ইঙ্গিত করেন। মিয়ানমারের পাশাপাশি বাংলাদেশের ক্যাম্পেও রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে মত দেন তিনি।
তিনি মনে করেন, ব্রিটিশ রক্ষণশীল ও লেবার—দুই পার্টির সরকারই ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক উন্নয়নের দিকে খুব কম মনোযোগ দিয়েছে। ফলে, বর্তমান বরিস জনসনের নতুন সরকারের পক্ষে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি নিয়ে কোনও রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়া অত্যন্ত অসম্ভব। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশে মানবাধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ব্রিটিশ সরকারের কাছে কয়েকটি উপায় আছে, যেমন বাণিজ্য চুক্তিতে শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষিত হয়েছে নিশ্চিত করা; অস্ত্র রফতানি লাইসেন্সিংয়ে আরও কঠোর হওয়া এবং স্বচ্ছ ব্যবস্থা গ্রহণ; এবং মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতার অভিযোগের বিষয়ে তদন্তের জোর চাপ দেওয়া।
অনুষ্ঠানের সূচনা বক্তব্য ছিল নাকি রুপা হকের। তিনি আওয়ামী লীগের শাসনাধীন বাংলাদেশকে ‘দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র’ (rogue state) বা কাছাকাছি [কিছুতে পরিণত হয়েছে] বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, মানবাধিকারের ক্ষেত্রে কাশ্মির ও ফিলিস্তিন সংকটের কথা হয়তো বেশি আলোচিত হয়। কিন্তু [বাংলাদেশের] মানবাধিকারের এই ট্র্যাজেডিকে আমরা অগ্রাহ্য করলে আমাদেরই বিপদ হবে।’ রুপা হক ২০১৭ সালে ব্রিটিশ এমপি হিসেবে ঢাকা সফরকালে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। জাতির পিতার প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শনের সাজা দেওয়ার সমালোচনা করেছেন।
২০২০ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনে বছরব্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন নিয়ে রুপা হক বলেন, “আমি এই মার্চে এখানে হাউজ অব কমন্সের একটি ডাইনিং হলে জাতির পিতার জন্মদিন উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ পেয়েছি। আমি শুধু এটুকুই বলবো, আমি সভার উদ্যোক্তাদের এই বর্ণনা (ন্যারেটিভ) মানি না যে, এই লোকটি জাতির পিতা।”
সভায় রুপা আরও বলেন, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে একসময় ক্ষমতার পালাবদল ঘটতো। ‘কিন্তু এখন একদিকেই দেশটি আটকে আছে, কেননা অপর পক্ষের সবাইকে জেলে ঢুকানো হয়েছে।’ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুর্নীতির অভিযোগে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে জেলে আছেন সত্য, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দণ্ডিত পলাতক আসামি হিসেবে রুপার দেশে অবস্থান করছে। রুপা আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বীদের জেলে থাকা নিয়ে ঢালাও মিথ্যাচার করেছেন।
২০১০ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ঢাকার জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তন করে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর রাখার সমালোচনা করে রুপা বলেছেন, মনে হয় তারা যেন আগের ইতিহাস মুছে ফেলার কাজে নেমে পড়েছে। অথচ রুপা খবরই রাখেন না, নাম পরিবর্তনের এই নোংরা রাজনীতি বিএনপি ক্ষমতায় এসে আগেই শুরু করেছে। প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠকারী এমএ হান্নানের নামে করা চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের নাম শাহ আমানত, বঙ্গবন্ধু নভো থিয়েটারকে ভাসানী নভো থিয়েটার এবং বঙ্গবন্ধু কনভেনশন হলকে চীন মৈত্রী সম্মেলন নামকরণ বিএনপিই করেছিল।
বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কেন সোচ্চার হতে চান, তার একটি হাস্যকর ব্যাখ্যা প্রদানের মাধ্যমে নাকি রুপা হক ওই অনুষ্ঠানে নিজের বক্তব্য শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘আমি ইলিং সেন্ট্রাল অ্যান্ড অ্যাক্টন থেকে নির্বাচিত লেবার এমপি। কিন্তু আপনি যদি আমার মতো বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত হয়ে থাকেন, তাহলে আপনি যেই নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সংসদীয় আসনের প্রতিনিধিত্ব করেন, তার চেয়েও বৃহত্তর [জনগোষ্ঠীর] এমপি। আপনি আসলে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাংলাদেশি ডায়াসপোরার [প্রবাসী জনগোষ্ঠী] একজন এমপি।’
রুপার মনে রাখা দরকার, তার সংসদীয় এলাকার ভোটার সংখ্যা বাংলাদেশের তিন চারটি ইউনিয়নের ভোটারের চেয়ে বেশি না। এই ক্ষুদ্র নির্বাচনি কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হয়ে আসা এমপির মুখে বাংলাদেশের জাতির পিতাকে নিয়ে অশোভন কথা বলা স্পর্ধার অতিক্রম মনে করি। তার স্মরণে রাখা উচিত, এই বাঙালির জাতির পিতাকে তার প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তির পর লন্ডন গেলে বিদেশ সফর সংক্ষিপ্ত করে দেশে এসে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান। তার ব্যক্তিগত বিমানে বাংলাদেশে পাঠান। শুধু তা-ই নয়, এডওয়ার্ড হিথ বাংলাদেশ সফরে এসে বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, আপনি নেপোলিয়নের চেয়েও বড়। কারণ, আপনার জাতি একটি ভাষণের ওপর ভিত্তি করে আপনাকে এবং জাতিকে মুক্ত করেছে। অবশ্য, বঙ্গবন্ধু তখন বিনয়ের সঙ্গে বলেছিলেন, নেপোলিয়নের সঙ্গে কারও তুলনা হয় না।
দাদাভাই নওরোজি প্রথম ভারতীয় যিনি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। তখন ভারত ব্রিটিশের উপনিবেশ ছিল। নওরোজি বোম্বের লোক। ধর্মে অগ্নি উপাসক। ছিলেন খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী। তিনি ব্রিটেন থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি তখন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতিও ছিলেন, মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ তখন কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক। নওরোজি জিতেছিলেন জ্ঞান গরিমা এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞার জন্য। ব্রিটিশরা তখন খ্যাতির পূজারি ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য, অবক্ষয় আজ এমন হয়েছে যে, সেই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে রুপা হকের মতো রাজনৈতিক জ্ঞানশূন্য মহিলারাও এমপি নির্বাচিত হন।
আমাদের সন্দেহ হয়, লন্ডনভিত্তিক বাংলাদেশবিরোধী চক্রের সঙ্গে রুপা হকের সখ্য গড়ে উঠেছে। বাঙালি জাতি স্বাধীনতার ঊষালগ্ন থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাদের জাতির পিতা হিসেবে মান্য করে আসছে। ১৯৭৫ সালের পর পাকিস্তানপন্থীরা ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল। তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শাহ আজিজুর রহমান। তিনি জাতিসংঘে পাকিস্তানের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিলেন। তাদের কথার সঙ্গে সুর মিলিয়ে কথা বলে রুপা সব বাংলাদেশিকে আঘাত করেছেন।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।