X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

ধর্ষণ, মাদক এবং তৃণমূলের রাজনীতি

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
০৮ অক্টোবর ২০২০, ১৫:৩১আপডেট : ০৮ অক্টোবর ২০২০, ১৫:৫৯

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থানার ৩৫ বছর বয়স্ক এক নারীকে যৌন হয়রানিসহ নির্মম নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে সারা দেশে এখন ধর্ষণ নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। মিডিয়ায় যা আসছে তাতে মনে হয় এদেশে ধর্ষণ যেন এখন নিত্য দিনের ঘটনা। এর আগেও নোয়াখালীর সুবর্ণচরে অনুরূপ ঘটনা ঘটেছে। ঘটনা ঘটার পর সপ্তাহখানেক উত্তেজনা থাকে, তারপর ধামাচাপা পড়ে যায়। কোনও তড়িৎ বিচার হয় না। অনুরূপ হতাশাজনক পরিস্থিতিতে ধর্ষকদের জোর বাড়ে, আর ক্রমে ক্রমে ধর্ষণ এখন সংস্কৃতিতে রূপান্তর হয়েছে।
এটি এমন বিকৃত রুচিতে রূপান্তর হয়েছে যে ৫/৬ বছরের শিশুকে যেমন ধর্ষণ করছে, ৭০ বছরের বৃদ্ধাও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। আইনের শাসনের শিথিলতাই এই ব্যাধি ছড়ানোর মূল কারণ। বেগমগঞ্জে যে ঘটনা ঘটলো তার ভিডিও দেখলে মনে হয় এ ঘটনা সব বর্বরতাকে হার মানিয়েছে। নোয়াখালী সদরের এমপি একরামুল হক চৌধুরী ঘটনার দৃশ্য দেখে এত মর্মাহত হয়েছেন যে তিনি বিচার-আচার স্থগিত রেখে দোষীদের ক্রসফায়ারের ব্যবস্থা করার আহ্বান জানিয়েছেন। ধর্মেও ধর্ষণের শাস্তি নির্মম ধরনের।


এবার নিশ্চয়ই তারা বেগমগঞ্জের ঘটনার ভিডিও দেখেছেন। এটাকে কোন যুগের বর্বরতা বলেন কি জানি! আসলে এই ঘটনাকে নেতারা সুন্দর সুন্দর বয়ান দিয়ে দূর করতে পারবেন না। বর্বরতাকে পাল্টা বর্বরতা দিয়ে প্রতিহত করতে হবে। অন্যথায় অচিরেই আইয়ামে জাহেলিয়াত যুগ শুরু হবে। বেগমগঞ্জের যুবকদের আচরণ পশুর আচরণের চেয়েও নিকৃষ্টতম। নোয়াখালীতে পিন্টু বাহিনী, মামা জাবেদ বাহিনীসহ বহু বাহিনী রয়েছে। বেগমগঞ্জের দেলোয়ার বাহিনী, পিন্টু বাহিনী, মামা জাবেদ বাহিনীর শাখা-প্রশাখা। এরা নাকি মূলত ইয়াবা কারবারি। মাদক এখন গ্রাম-গ্রামান্তে ঢুকে পড়ছে। শেষ পর্যন্ত মাদক সমাজেরই ভিন্ন রূপান্তর ঘটবে বলে মনে হয়। সরকার মাদক কারবারিদের নিয়ে একবার কঠোর হয়েছিল, কিন্তু কক্সবাজারে নিরপরাধ কাউন্সিলর একরামকে ক্রসফায়ারে দিয়ে কঠোর সমালোচনায় পড়ার পর মনে হচ্ছে তা গতিহারা হয়ে গেছে। অনেক জায়গায় পুলিশ নিজেও মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে বলে খবর প্রকাশিত হচ্ছে। মাদকের ব্যাপারে সরকার যদি কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন না করে তবে দেশকে ভয়ানক অরাজকতা থেকে বাঁচানো সম্ভব হবে না।


আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুসারে গত নয় মাসে দেশে ধর্ষণ হয়েছে ৯৭৫ জন। তার মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ২০৮ জন, ধর্ষণের পর খুন করেছে ৪৩ জন, শিশু ধর্ষিত হয়েছে ৬২৭ জন এবং ধর্ষিতা আত্মহত্যা করেছে ১২ জন। ঘরের ভেতরে ঢুকে বেগমগঞ্জে যেভাবে নারীটিকে নির্মম নির্যাতন করা হলো তা থেকে অনুমান করা গেছে যে নারীদের সম্মান, নিরাপত্তাও ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। প্রতিবন্ধী, বোবা কিছু বাদ যাচ্ছে না। নারী হলেই ধর্ষণ করেই ছাড়ছে। এর সঙ্গে অশ্লীলতা, নৈতিক মূল্যবোধের অভাব সবকিছুই আছে।

আমরা একটা বিষয় লক্ষ করেছি যে ধর্ষণের পরে যাদের নাম আসছে তারা সিংহভাগ সরকারি দল বা তাদের অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মী। আওয়ামী লীগ একটা প্রাচীন সংগঠন। তাদের এ অবস্থা হলো কেন! দু’মাস আগে আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতা বলেছেন যে আওয়ামী লীগের ওপর আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে নেই। যে কারণে সম্ভবত সংগঠনের ওপর আধিপত্য বিস্তার করেছে বখাটেরা, সুবিধাভোগীরা। সুতরাং আওয়ামী লীগ তার প্রকৃত ভূমিকা হারিয়ে ফেলেছে। অথচ গত ১২/১৩ বছর দেশ খারাপ চালায়নি। অভাব অনটন কিছুই তো ছিল না। প্রচুর উন্নতিও হচ্ছে। আমরা ইতিহাসে পড়েছি রোমে বিশৃঙ্খলাও ছিল আবার সম্প্রসারও হতো। এ যেন ঠিক তদ্রূপ। কিন্তু একটা জাতি তার চারিত্রিক সৌন্দর্য হারিয়ে ফেললে তার গৌরব করার তো আর কিছু থাকে না।
আমরা আরেকটি বিষয় গভীরভাবে লক্ষ করেছি, পূর্বে সমাজে মাতব্বর শ্রেণির লোক ছিল। সাধারণত তারাই সমাজে শৃঙ্খলা রক্ষা করতো। তাদের ভয়ে বখাটে শ্রেণির প্রাদুর্ভাব হতে পারতো না। কিন্তু স্বাধীনতার পর নানা কারণে এই শ্রেণিটি ধীরে ধীরে নির্মূল হতে থাকে। সমাজ কাঠামো পরিবর্তনের পর ধীরে ধীরে অরাজকতা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। সর্বশেষ এখন দলীয় প্রতীক নিয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করায়, বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচন দেওয়ায় সমাজে প্রভাবশালী মাতব্বর শ্রেণির ভদ্রলোকেরা নির্বাচন থেকে দূরে সরে গেছে।

প্রতীক পেয়ে নির্বাচিত হয়ে যাওয়ার পর নির্বাচিত চেয়ারম্যানকে আশ্রয় করে দলীয় মাস্তানেরা গ্রুপে গ্রুপে আত্মপ্রকাশ করছে। এদের সঙ্গে আছে ইউনিয়নে, ওয়ার্ডে সরকারি দলের নামে নানা সংগঠনের কমিটির আড়ালে গ্রুপ-শক্তি প্রদর্শনের রাজনীতি। বিএনপিরও এমন সংগঠনের অভাব নেই, কিন্তু ক্ষমতার অভাবে তারা এখন চাঁদাবাজি, মাস্তানির সুযোগ পাচ্ছে না বললে চলে। ক্ষমতা পেলে তারাও জেগে উঠবে। সব মিলিয়ে তৃণমূলের রাজনীতির নামে সামাজিক অবস্থা এখন ভয়াবহ।
ইউনিয়ন নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বরাদ্দ সঠিক সিদ্ধান্ত হয়নি। পূর্বের সে নিয়ম শৃঙ্খলায় সমাজ আবদ্ধ ছিল দীর্ঘদিন প্রয়োগের মাধ্যমে তার ত্রুটিগুলো বাদ পড়ে সুন্দর নিয়ম শৃঙ্খলার মাঝে তার প্রয়োগ হচ্ছিল। এখন আবার দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ব্যবস্থা করে সমাজে শৃঙ্খলার ব্যবস্থা করা ঠিক হয়নি। দলীয়ভাবে করার ফলে রাজনৈতিক বিভক্তিটি ইউনিয়ন পর্যায়ে পৌঁছছে এবং বিশৃঙ্খলা ইউনিয়ন পর্যায়ে বিস্তৃতি লাভ করেছে। তাতে আগামীতে আরও অশান্তির সৃষ্টি হবে।

আমরা সরকারকে অনুরোধ করবো ইউনিয়ন পর্যায়ে দলীয় মার্কা ভিত্তিক নির্বাচন স্থগিত রাখা হোক। কেউ কেউ হয়তো পশ্চিম বাংলার দৃষ্টান্ত দিতে পারেন এ বিষয়ে। পশ্চিম বাংলায় গিয়ে দেখে আসুন সমাজ ব্যবস্থা পশ্চিম বাংলায় ভেঙে পড়ে পচন ধরেছে। হ্যাঁ একটা দলীয় সুবিধা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে-যারা ক্ষমতাসীন তারা পেশিশক্তির জোরে নির্বাচনে জিতে আসে।


লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
বাংলাদেশে আইসিটির ভবিষ্যৎ কেন হুমকির মুখে?  
বাংলাদেশে আইসিটির ভবিষ্যৎ কেন হুমকির মুখে?  
মস্কোতে কনসার্টে হামলা: ৯ সন্দেহভাজনকে আটক করলো তাজিকিস্তান
মস্কোতে কনসার্টে হামলা: ৯ সন্দেহভাজনকে আটক করলো তাজিকিস্তান
চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন
চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ