X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থান ও গণতন্ত্রের জন্য ‘বেহুদা’ বিলাপ!

রাহমান নাসির উদ্দিন
০২ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৪:২৯আপডেট : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৮:৪১

রাহমান নাসির উদ্দিন
গতকাল (০১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১) মিয়ানমারের সেনাবাহিনী একটি শান্তিপূর্ণ সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশটির রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছে। ২০২০ সালের নভেম্বরের ৮ তারিখে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত পার্লামেন্টের প্রতিনিধিদের প্রথম সভা বসার আগেই নির্বাচনে ভোট কারচুপির অভিযোগে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে। ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি)-এর প্রধান অং সান সু চি এবং দেশের রাষ্ট্রপতি উইন মিন্টকে গ্রেফতার করে মিয়ানমারে এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। এবং সু চি সরকারের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেনারেল মিন্ট সুয়েকে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করে রাষ্ট্রের সমস্ত ক্ষমতা মিয়ানমারের কমান্ডার ইন চিফ এবং সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইংয়ের হাতে অর্পণ করা হয়। এসব আনুষ্ঠানিকতায় প্রকৃতপক্ষে একটি রক্তপাতহীন সেনা অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে মিয়ানমারের সেনা শাসন জারি করা হলো। অর্থাৎ ১৯৬২ সাল থেকে ৪৯ বছরের একটানা সেনা শাসনের পিঞ্জিরায় বন্দি গণতন্ত্র ২০১১ সালে সাময়িক মুক্তি পেলেও ঠিক দশ বছর পর আবারও সেই সেনা শাসনের পিঞ্জিরায় বন্দি হলো। মাঝখান দিয়ে দশ বছর গণতন্ত্রায়নের নামে সু চি’র হাতে গণতন্ত্রের ঘুড়ি হাতে দিয়ে নাটাইটা সেনাবাহিনীর হাতে রেখে বিশ্ববাসীকে ‘গণতন্ত্র গণতন্ত্র হা ডু ডু খেলা’ দেখানো হয়েছে। কিন্তু সময় মতো এসব দেখানোপনা ভেঙে সেনাবাহিনী তার নিজের চেহারায় হাজির হয়েছে এবং কোনও ধরনের রাখঢাক না রেখে সরাসরি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নিজেদের কর্তৃত্বপনা জানান দিয়েছে। দশ বছরের গণতন্ত্র দশ মিনিটের মধ্যে হাওয়া! নির্বাচনে ৮৩ শতাংশ ভোট পাওয়া নেত্রী ৮৩ সেকেন্ডও প্রতিরোধ গড়ে তুলে দাঁড়াতে পারেনি। এত ভঙ্গুর মিয়ানমারের গণতন্ত্র!

প্রশ্ন হচ্ছে, এটা কী আদৌ গণতন্ত্র? আসলে মিয়ানমারে গণতন্ত্র কখনও ছিলই না। কারণ, গণতন্ত্রের ঘোমটায় মিয়ানমারে সর্বত্র সামরিক শাসন চলেছে। পার্থক্য হচ্ছে গত দশ বছর ঘোমটা ছিল, এখন ঘোমটাটা নাই! মিয়ানমারে পর্দার অন্তরালে সামরিক শাসনই ছিল, এখন কেবল পর্দাটা উঠে গেছে। সুতরাং মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থানের কারণে চতুর্দিকে যে ‘গণতন্ত্র গেলো, গণতন্ত্র গেলো’ বলে মাতম উঠেছে, এটা স্রেফ বিলাপ ছাড়া কিছুই নয়। কেননা, যেখানে গণতন্ত্র প্রকৃতপক্ষে ছিলই না, সেখানে গণতন্ত্রের জন্য আহাজারি করা ‘বেহুদা’ বিলাপ ছাড়া কিছুই নয়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে হঠাৎ করে সামরিক বাহিনী মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান কেন করলো? আরও অনেক প্রশ্ন এ সামরিক অভ্যুত্থানের সাথে সম্পৃক্ত। তথাপি আমি আমার দীর্ঘ বছরের পর্যবেক্ষণ থেকে এ প্রশ্নের নিজস্ব একটা বিশ্লেষণ দাঁড় করানোর চেষ্টা করি।

আমার বিশ্লেষণে মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের পেছনে প্রধান কারণ হচ্ছে চারটি।

(১) বর্তমান সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইংয়ের চাকরির মেয়াদ আগামী জুনে শেষ হয়ে যাবে। তার পরিকল্পনা ছিল, সেনাবাহিনী থেকে অবসরে গিয়ে সে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী সমর্থিত রাজনৈতিক দল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টিতে (ইউএসডিপি) যোগ দেবে এবং নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় কোনও একসময় ক্ষমতায় আসীন হবে। কিন্তু ২০২০ সালের নভেম্বরের নির্বাচনে ইউএসডিপি’র চরম ভরাডুবি হয়। মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক পরিষদগুলোর আসন সংখ্যা ১১৭১টি। এরমধ্যে ভোট হয় ১১১৭টিতে। এরমধ্যে সু চি’র নেতৃত্বাধীন এনএলডি পায় ৯২০টি আসন (২০১৫ সালের চেয়ে ৬৬ আসন বেশি) এবং সামরিক বাহিনী সমর্থিত ইউএসডিপি পায় মাত্র ৭১টি আসন (যা ২০১৫ সালের চেয়ে ৪৪টি কম)। এমতাবস্থায় সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং নিজের কোনও রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ না দেখে তাকে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট করার জন্য সু চি’কে একটি প্রস্তাব দেয়। কিন্তু সু চি এ প্রস্তাবে রাজি হয়নি। ফলে, নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার নিশ্চিত করার জন্য তার পক্ষে সামরিক অভ্যুত্থান ছাড়া আর কোনও বিকল্প ছিল না। কারণ, ২০২১ সালের জুনের পরে মিন অং হ্লাইং একজন সাধারণ নাগরিকে পরিণত হবেন।

(২) আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে রোহিঙ্গাদের ওপর জেনোসাইড সংঘটনের যে বিচার হচ্ছে, সেখানে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জেনোসাইডের যে অভিযোগ আনা হয়েছে সেটা যদি প্রমাণিত হয় তাহলে এই জেনোসাইডের মূল কমান্ডিং রেসপন্সিবিলিটি নিতে হবে বর্তমান জেনারেল মিন অং হ্লাইংকে। এছাড়াও বাইডেন প্রশাসনও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যে জেনোসাইডের অভিযোগ আনা হয়েছে সেটা যাচাই-বাছাই করার জন্য একটি রিভিউ কমিশন করেছে, সেখানেও যদি কোনও ধরনের জেনোসাইডের প্রমাণ পাওয়া যায় (সেটা যে পাবে তা মোটামুটি নিশ্চিত!), তার জন্যও প্রধানত দায়ী হবে জেনারেল মিন অং হ্লাইং।

এছাড়া আর্জেন্টিনার আদালতে এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতেও জেনোসাইডের অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। সুতরাং ২০১৭ সালে রাখাইনে যে জেনোসাইড হয়েছে তার সব দায়দায়িত্ব সু চি’র সরকারের ঘাড়ে না গিয়ে সেনাবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ হিসাবে মিন অং হ্লাইং-এর ঘাড়ে গিয়ে পড়বে। কিন্তু জুনে অবসর গ্রহণ করার পর তাকে ডিফেন্ড করার মতো কাউকে আর পাওয়া যাবে না। বাকি জীবন তাকে একটা জেনোসাইড সংঘটনকারী জেনারেলের কলঙ্ক নিয়ে কাটাতে হবে। তাই, সামরিক অভ্যুত্থান করে নিজেকে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করে এসবের মোকাবিলা করা ছাড়া তার অন্য কোনও উপায় ছিল না।

(৩) ২০০৮ সালে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে মিয়ানমারের ক্ষমতা কাঠামো এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় সেনাবাহিনীর অবস্থানকে একটা শক্ত ভিত্তি দেওয়া হয়। যেমন: সংসদের ২৫ শতাংশ আসন সেনাবাহিনীর জন্য বরাদ্দ থাকবে; স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা এবং সীমান্ত মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ তিনটি মন্ত্রণালয় সেনাবাহিনীর জন্য বরাদ্দ থাকবে; রাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট হবে সেনাবাহিনী থেকে এবং দেশের কামান্ডার-ইন-চিফ থাকবে পদাধিকার বলে মিয়ানমারের সেনাপ্রধান প্রভৃতি। এরকম একটি শক্ত ভিত্তির ওপর সেনাবাহিনীকে দাঁড় করানোর পরও ক্রমান্বয়ে দেশের কাছে, দেশের মানুষের কাছে এবং বিদেশের কাছে সেনাবাহিনীর জনপ্রিয়তা, প্রভাব বলয় এবং ক্ষমতা ক্রমান্বয়ে খর্ব হতে শুরু করে। প্রকারান্তরের সু চি’র জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সাথে সাথে তার ক্ষমতা, প্রতিপত্তি এবং আধিপত্যও ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। ২০২০ সালের নির্বাচনের ফলাফলও সেনাবাহিনীকে মিয়ানমারের জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যানের এক ধরনের ইঙ্গিত বহন করে। সুতরাং সেনাবাহিনীর ক্ষমতা, প্রতিপত্তি, গৌরব এবং  আধিপত্য পুনরুদ্ধারের জন্য সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ করা ছাড়া সেনাবাহিনীর অন্য কোনও উপায় ছিল না।

(৪) ২০১৫ সালে গণতন্ত্রের পথে প্রথম বহুদলীয় নির্বাচন হলে মিয়ানমার গণতন্ত্রায়নের দিকে যাত্রা শুরু করে মর্মে এক ধরনের উপস্থাপনা বিশ্বমিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার পায়। ২০২০ সালের নির্বাচনের সু চি’র দল ভূমিধস মেজরিটি পেলে মিয়ানমার সত্যিকার গণতন্ত্রের দিকে ধাবিত হতে পারে, এরকম একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়। আর মিয়ানমারে যদি সত্যিকার গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি হয়, তাহলে বৈদেশিক বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে, বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়বে, এবং আন্তর্জাতিক সাহায্য-সহযোগিতার পরিবৃদ্ধি ঘটবে। পাশাপাশি লিবারেল ডেমোক্র্যাসির সুযোগ নিয়ে ইউরোপ আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলো মিয়ানমারের বিভিন্ন ধরনের ডেমোক্র্যাটিক ইনস্টিটিউশনকে প্রমোট করবে, যা সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব, ক্ষমতা এবং আধিপত্যকে ক্রমান্বয়ে খাটো করে দেবে।

তাছাড়া, ডেমোক্র্যাটিক ইনস্টিটিউশনগুলো যদি যথাযথভাবে কাজ করতে শুরু করে তাহলে  সেনাবাহিনীর যে বহুবিধ বাণিজ্যিক কার্যক্রম এবং লাভজনক প্রকল্প রয়েছে, সেসব ক্রমান্বয়ে বন্ধ হয়ে যাবে। সুতরাং দশ বছর গণতন্ত্র গণতন্ত্র অনেক তামাশা হয়েছে, এবার আর পর্দার অন্তরালে থেকে ঘুঁটি চালানোর দরকার নাই। ঘুঁটি যদি চালাতে হয়, পর্দার সামনে এসে চালাবো। এরকম একটা দর্শন সেনাবাহিনীর মধ্যে কাজ করতে শুরু করে নভেম্বরের নির্বাচনের ফলাফল থেকে। ফলে, সামরিক অভ্যুত্থান অপরিহার্য হয়ে ওঠে।

পরিশেষে বলবো, ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার পর দীর্ঘ ৭২ বছরের জীবনে মিয়ানমারকে বেসামরিক লোকজন শাসন করছে মাত্র ১৫ বছর। তন্মধ্যে বিগত ১০ বছর শাসন করেছে বেসামরিক শাসনের ছায়াতলে সামরিক শাসক। সুতরাং মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থান একেবারেই মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় চরিত্রের খোলনলচে পাল্টে দেবে সেটা মনে করার কোনও কারণ নাই। আবার সু চি’ও ২০১৭ সালের পরে রোহিঙ্গাদের ওপর যে জেনোসাইড হয়েছিল সেটাকে সমর্থন করতে গিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে তাঁর যে ‘ডেমোক্র্যাটিক আইকনিক ইমেজ’ ছিল সেটাকে নষ্ট করেছে। ফলে, বিশ্বব্যাপী যে প্রতিক্রিয়া আমরা দেখতে পাচ্ছি তা যতটা না সু চি’র জন্য, তার চেয়ে অধিক হচ্ছে মিয়ানমারের গণতন্ত্রের জন্য। তবে গণতন্ত্রের জন্য এ বিলাপ খানিকটা অর্থহীন বলে আমার মনে হয়। কেননা, ‘চোর না শুনে ধর্মের বাণী’। তাছাড়া, মিয়ানমারের প্রাকৃতিক-খনিজ সম্পদকে ব্যবহার করে যারা ব্যবসা-বাণিজ্য করে সেসব আন্তর্জাতিক বেনিয়া চক্র সামরিক শাসনেই ‘টেকসই’ ও ‘মজবুত’ ব্যবসা করতে পারে। গণতন্ত্রের ঘোমটায় সামরিকতন্ত্র চললে ভালো, আবার সামরিকতন্ত্র ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন’-এ এলেও খারাপ না। কেননা, মিয়ানমারের ‘গণতন্ত্র’ আর ‘সামরিকতন্ত্র’র মধ্যে দূরত্ব খুব বেশি নয়।

লেখক: নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এনভয় টেক্সটাইলসের ২৮তম বার্ষিক সাধারণ সভা
এনভয় টেক্সটাইলসের ২৮তম বার্ষিক সাধারণ সভা
প্রসঙ্গ ‘অলক্তক’
প্রসঙ্গ ‘অলক্তক’
শাকিব খান: নির্মাতা-প্রযোজকদের ফাঁকা বুলি, ভক্তরাই রাখলো মান!
শাকিব খান: নির্মাতা-প্রযোজকদের ফাঁকা বুলি, ভক্তরাই রাখলো মান!
অসাধু ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করতে বাজার কমিটির সহযোগিতা চায় এফবিসিসিআই
অসাধু ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করতে বাজার কমিটির সহযোগিতা চায় এফবিসিসিআই
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ