X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

জাতীয় লজ্জার সেই কালো স্মৃতিবহ দিন

নাসির আহমেদ
০৯ জুলাই ২০২১, ১৬:৫৫আপডেট : ০৯ জুলাই ২০২১, ১৬:৫৫
নাসির আহমেদ জাতি হিসেবে আমাদের গৌরবের শেষ নেই। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন নিয়ে কত বীরত্বগাথা। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকারের সংগ্রাম থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং পরবর্তীকালে সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে বাঙালির যে আত্মত্যাগ, তার তুলনা এই উপমহাদেশে বিরল। উপমহাদেশই বা বলি কেন, সারা পৃথিবীতেই মাতৃভাষা, মাতৃভূমি আর আত্মমর্যাদার প্রশ্নে এমন বিশাল ত্যাগী সংগ্রামের গৌরব কম জাতিরই আছে। যে দেশের তরুণ- তরুণী ঔপনিবেশিক শাসনের শৃঙ্খল ছিঁড়তে হাসিমুখে ফাঁসির দড়ি কিংবা সায়ানাইড হাতে তুলে নিতে পারে, সেই সাহসী জাতির স্বপ্ন রুখে দেয় সাধ্য কার?

ভাষা আন্দোলনে তার স্বাক্ষর রেখেছে বাঙালি। গোটা ষাটের দশকজুড়ে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আইয়ুবী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে বাংলার মানুষ। রক্ত দিয়ে প্রমাণ করেছে জননী-জন্মভূমির মুক্তির জন্য হাসিমুখে প্রাণ দিতে জানে বাঙালি। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে তো লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করেছে দেশ আর দেশের স্বাধীনতা প্রাণের চেয়েও প্রিয়। সেই অতুলনীয় দেশপ্রেম আর স্বাধীনতার পিপাসাও এই জাতির প্রাণে জাগিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পরবর্তীকালে যিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি, আমাদের জাতির পিতা।

১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান থেকে ৯০-এর সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনে বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণ যে গৌরবগাথা রচনা করেছে, তার বিপরীতে অমোচনীয় ক্ষতের মতো কলঙ্কের একটি দিন ১৫ আগস্ট। সপরিবারে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নৃশংসভাবে হত্যার কালো দিন। আরও আছে ৩ নভেম্বর, ৯ জুলাই, ২১ আগস্টসহ কয়েকটি ভয়ংকর দিন।

দেশি-বিদেশি চক্রান্তে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল যে খুনিরা, তাদের যাতে কোনও দিন বিচারের মুখোমুখি হতে না হয়, সেই অশুভ উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনযন্ত্র যখন ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে, তখন তা কেবল কোনও ব্যক্তি বা প্রশাসনযন্ত্রের জন্যেই নিন্দনীয় কাজ নয়, গোটা জাতির জন্যই কলঙ্ক আর চরম নিন্দনীয় ঘটনা। সেই চরম কলঙ্কিত দিন ৯ জুলাই (১৯৭৯)।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে ঘাতকচক্রের গড়া পুতুল সরকারের রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ পঁচাত্তরের ২৬ সেপ্টেম্বর জারি করেছিল সেই ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ, শিরোনাম ছিল রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ নম্বর ৫০। খন্দকার মোশতাকের পাশাপাশি তাতে স্বাক্ষর করেন সে সময়ের আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবও।

সেই অধ্যাদেশ এর আইনগত বৈধতা দেয় বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রধান বেনিফিশিয়ারি জেনারেল জিয়াউর রহমান। ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই জাতীয় সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বিএনপি এই কলঙ্কিত অধ্যাদেশকে বিল হিসেবে পাস করিয়ে নেয়। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর পর সেদিন সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করা হয় এই কালো আইনটি। সপরিবার বঙ্গবন্ধু-হত্যা তো বটেই, ১৯৭৫-এর ৩  নভেম্বরের জেলহত্যা পর্যন্ত বিচার থেকে অব্যাহতি পেয়ে যায়।

এ কথা তো আজ সবারই জানা, ঘাতক চক্রকে যাতে কোনও দিন বিচার করা না যায়, সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করার পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাংলাদেশ দূতাবাসে চাকরি দিয়েও পুরস্কৃত করা হয়। সেনাপ্রধান হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। মেজর জেনারেল হয়ে যান লেফটেন্যান্ট জেনারেল। সামরিক শাসন জারি থাকা অবস্থায়ই প্রেসিডেন্ট পদে থাকার বৈধতা নিয়েছিলেন হ্যাঁ-না ভোটের প্রহসন করে। কয়েক কোটি টাকা খরচ করে সারাদেশে ভোটকেন্দ্র বসিয়ে সেই হ্যাঁ-না গণভোটের নাটক হয়েছিল।

সামরিক পোশাকেই জেনারেল জিয়ার রাজনৈতিক দল বিএনপি গঠন এবং ১৯৭৯ সালে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিজয় নিয়ে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী আনার পূর্বাপর সব ঘটনাই আজ ইতিহাসের অংশ। সেই সংসদেই সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী এনে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই পর্যন্ত জিয়া-মোশতাকদের কৃত সব কার্যক্রমকেই বৈধতা দেওয়া হয়। খন্দকার মোশতাকের জারি করা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশও আইনে পরিণত করে সংবিধানভুক্ত করা হয় ৯ জুলাইয়ের পঞ্চম সংশোধনীতে।

অনাগতকাল ধরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি কালো দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে এই দিনটি। বিএনপি এবং তার দোসরদের ললাটেও এই কলঙ্কের দাগ অমোচনীয় হয়ে থাকবে অনন্তকাল।

ইতিহাসের শিক্ষাই হচ্ছে এই যে কেউ ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে না। যদি করতো, তাহলে খন্দকার মোশতাক বাংলার ইতিহাসে আরেক মীর জাফর হিসেবে ধিকৃত হয়ে বিদায় নেওয়ার পরও ১৫ আগস্টের হত্যাকারীদের পক্ষে কারও দাঁড়াবার কথা ছিল না। মোশতাক মাত্র কয়েকদিনের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন খুনিদের ক্রীড়নক হিসেবে। তার পতনের পর বিচারপতি সায়েমকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল জিয়া নামমাত্র রাষ্ট্রপতি বানিয়ে নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে রাজনীতিতে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন মাত্র।
প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে, খন্দকার মোশতাকের মতো  গণধিকৃত, সেই একই বেইমানি তিনিও কি করেননি? এই উপমহাদেশে সেনাপ্রধানের পাশাপাশি একজন উপ-সেনাপ্রধানের পদ কোনও দেশে আছে কিনা জানি না। বঙ্গবন্ধু সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ ক্ষুণ্ন হবে জেনেও জিয়াউর রহমানকে পদোন্নতি দিয়ে উপ-সেনাপ্রধান পদ সৃষ্টি করেছিলেন। জিয়ার প্রতি অশেষ স্নেহের কারণেই সেটা করেছিলেন। কিন্তু তার চরম মূল্য দিতে হলো উদারপ্রাণ বঙ্গবন্ধুকে।

জিয়াউর রহমান যে ক্ষমতার কী তীব্র পিপাসু, সেটা শুরু থেকেই টের পাওয়া গিয়েছিল। কালুরঘাটে স্থাপিত বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠের জন্য ২৭ মার্চ জিয়াউর রহমানকে নিয়ে যাওয়ার পরে তিনি যে কাণ্ড করেছিলেন, তাও ইতিহাসে লিপিবদ্ধ। চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এমএ হান্নান ঘোষণা দেওয়ার পরও সবাই ভাবলেন যে একজন বাঙালি সেনা কর্মকর্তাকে দিয়ে ঘোষণাটি দেওয়ানো গেলে সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত বাঙালি সেনারা মুক্তিযুদ্ধে যেতে উদ্বুদ্ধ হবেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ঘোষণা না করে সরাসরি নিজেকে রাষ্ট্রপতি বলে সে ঘোষণা পাঠ করেছিলেন জিয়া। সঙ্গে সঙ্গে বিরূপ প্রতিক্রিয়া! আবার পাঠ করলেন তিনি এবং এবার বললেন,  ‘অন বিহাফ অব আওয়ার ন্যাশনাল লিডার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান...’

সুতরাং সেই জিয়ার স্বরূপ উন্মোচন যে একদিন হবে সে তো ছিল অনিবার্য সত্য এবং সময়ের ব্যাপার মাত্র। বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে জিয়া কেন যাবেন? তার অন্তরে যে পাকিস্তান। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়াউর রহমানের গভীর পাকিস্তানপ্রীতি প্রকটভাবে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিল।

পঞ্চম সংশোধনীতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মতো জঘন্য কালা-কানুন শুধু সংবিধানে অন্তর্ভুক্তই করেননি রাষ্ট্রপতি জিয়া, বঙ্গবন্ধু-হত্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িতদের বিচারের পথ চিরতরে রুদ্ধ করার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের মূল প্রেরণা বাঙালি জাতির জাগরণের মূলশক্তি ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ই সংবিধান থেকে মুছে দিলেন। যে জয় বাংলা রণধ্বনি দিয়ে বাংলার মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেছে, সেই জয় বাংলা মুছে দিয়ে মৃত পাকিস্তানের জিন্দাবাদ ফিরিয়ে আনলেন সংশোধনীতে। বাংলাদেশ বেতারের নাম বদলে রেডিও পাকিস্তানের স্টাইলে করলেন রেডিও বাংলাদেশ!

বঙ্গবন্ধু যে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য গণতন্ত্র রেখেও নতুন এক সাম্যবাদী অর্থ ব্যবস্থার স্বপ্নে সংবিধানে সমাজতন্ত্র কথাটা রেখেছিলেন, সংবিধান থেকে জিয়া তাও মুছে দিয়েছিলেন। যাকে বঙ্গবন্ধু অনেক বিশ্বাস করেছিলেন সেই জিয়ার জ্ঞাতসারেই ১৫ আগস্ট ভোরে নিহত হলেন তিনি সপরিবারে।

জ্ঞাতসারে বলতে হবে এই কারণে, কর্নেল ফারুক -রশিদ, ডালিমদের ১৫ আগস্টের পরিকল্পনা জিয়াউর রহমান জেনেছিলেন বঙ্গবন্ধু হত্যার ৪ মাস ১৯ দিন আগে। ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে কর্নেল ফারুক ও রশিদ গং প্রথমে ঢাকা থেকে ব্যাংককে চলে গিয়েছিলেন। সেনাপ্রধান জিয়া তাদের দ্রুত বিশেষ ব্যবস্থায় দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেন। সেখানেই সাংবাদিক ম্যাসকারাহ্যান্সকে টেলিভিশনের জন্য যে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন, রশিদ, ফারুকরা তাতে উল্লেখ করেছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমানের ভূমিকার কথা। দুজনই বলেছেন ২০ মার্চ সন্ধ্যায় আমরা জিয়ার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাই। আমাদের পরিকল্পনা শুনে তিনি বললেন সিনিয়র অফিসার হিসেবে আমি তোমাদের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকতে পারি না। তোমরা ইয়াং অফিসাররা করতে চাইলে এগিয়ে যাও। শেষ বাক্যটা ছিল, গো এহেড।

ফারুক ও রশিদের সেই সাক্ষাৎকার আগ্রহী পাঠক ইচ্ছে করলে ইউটিউবে সার্চ দিয়ে এখনও শুনতে পারেন।

যাহোক, পৃথিবীর ইতিহাসের এই কলঙ্কিত আইন, বিচারহীনতার এই বিধানটি বঙ্গবন্ধু হত্যার ২১ বছর পর তার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে সংবিধানে সংশোধনী এনে সংবিধানকে কলঙ্কমুক্ত করেন কালো আইনটি বাতিলের মাধ্যমে।

দুঃখের বিষয়, এই ২১টি বছর দেশ যারা পরিচালনা করেছেন তাদের কারও বিবেক দংশিত হয়নি এই কালো আইনটি দেখে। বিচারপতি আব্দুস সাত্তার, জেনারেল এরশাদ এবং বেগম খালেদা জিয়ার সরকার এই ২১ বছর দায়িত্ব পালন করেছে। একটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতার স্থপতি, জাতির পিতাকে হত্যা করা হলো, তার হত্যাকারীদের বিচারের কোনও ব্যবস্থাই নেওয়া যাবে না। এমন কালো আইন সংবিধানে লিপিবদ্ধ থাকলে তা জাতি হিসেবে তাদের কোনও আদিম বর্বর যুগে ঠেলে দেয়? এ প্রশ্ন কি তাদের কারও মনে জাগেনি?

নিশ্চিত জাগেনি। কারণ, যারা ক্ষমতায় ছিলেন তারা সবাই পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দর্শনের অনুসারী। তারা পোশাকে আধুনিক কিন্তু মনমানসিকতায় ধর্মান্ধ। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প পাকিস্তান আমলে যেভাবে ছড়ানো হয়েছে এই সমাজে, সেভাবেই ছড়িয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ জয়ী লাখো শহীদের রক্তস্নাত বাংলাদেশেও। বিচারের পথ রুদ্ধ করে রাখা হলেও বাংলাদেশের গণমাধ্যম, সাংবাদিক সমাজ, লেখক- বুদ্ধিজীবী সমাজ সোচ্চার থেকেছেন এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে, বারবার বিচারের দাবি তুলেছেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে বাংলার কবি- সাহিত্যিকরা শুধু নন, বিশ্বের বহু দেশের কবি- সাহিত্যিক- লেখকরা সোচ্চার হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর দেশপ্রেম, সাহস আর নেতৃত্বে অভিভূত হয়েছে তাদের চেতনা। লেখায় সেই মুগ্ধতা তারা প্রকাশ করেছেন সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালের সম্পাদনায় অন্তত ৩০ বছর আগে এরকম একটি সংকলন ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল, যেখানে ইউরোপ-আমেরিকা, ভারত-পাকিস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রগতিশীল কবিদের বন্ধুকে নিয়ে লেখা কবিতা ছাপা হয়েছিল।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সংবিধান থেকে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের কালো আইন বিলুপ্ত হলে বঙ্গবন্ধুর আবাসিক পিএ মোহিতুল ইসলাম ওই বছরই ২ অক্টোবর ধানমন্ডি থানায় মামলা দায়ের করেন, আদালতে যার বিচার সম্পন্ন হয়েছিল ১৯৯৮ সালের 8 নভেম্বর। কর্নেল ফারুক, রশিদ, ডালিম, হুদাসহ ১৫ আগস্টের নৃশংস হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ। আসামিরা হাইকোর্টে আপিল করলে ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে। ৩ জন খালাস পান।

কিন্তু ২০০১ সালের অক্টোবরে বিএনপি-জামায়াতসহ চারদলীয় জোট ক্ষমতায় এলে এ মামলার পরবর্তী কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে!

দীর্ঘ ৭ বছর পর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ী আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে এই মামলার পরবর্তী কার্যক্রম আবার শুরু হয়। সর্বোচ্চ আদালতও হাইকোর্টের রায় বহাল রাখে। ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারির মধ্যে ৫ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় এবং ২০২০ সালে আরেক খুনি ধরা পড়লে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। একজন বিদেশে মারা যান। বাকিরা বিভিন্ন দেশে পলাতক। তাদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা এখনও অব্যাহত।

বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ যারা রুদ্ধ করে রেখেছিলেন তারা  দেশের যে সর্বনাশ করে গেছেন, তা কোনও দিন মোচন হওয়ার নয়। ১৫ আগস্ট কোনও সরকার প্রধানকেই হত্যা করা হয়নি, হত্যা করা হয়েছিল একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন আর আকাঙ্ক্ষাকেও। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন একটি ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক মানবিক রাষ্ট্র, যেখানে থাকবে না কোনও অর্থনৈতিক বৈষম্য আর ধর্মীয় সহিংসতা। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের রাষ্ট্রে থাকবে না ধর্মের নামে রাজনীতি আর শোষণ-বঞ্চনার মতো পাকিস্তানি অভিশাপ। মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে। সেই কাঙ্ক্ষিত শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই বঙ্গবন্ধু সমাজের সর্বস্তরের প্রতিনিধিত্ব নিয়ে বাকশাল গঠন করেছিলেন। শোষণহীন সাম্যনীতির, অর্থব্যবস্থার প্রচলন করতেই তিনি সবুজ বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন নতুন ব্যবস্থায়। সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠাই ছিল তার স্বপ্ন।

কিন্তু আন্তর্জাতিক পরাশক্তি এবং আঞ্চলিক রাজনীতির চক্রান্তে বঙ্গবন্ধু সরকার যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে মনোযোগও ধরে রাখতে পারছিলেন না। সমাজতন্ত্রের নামে বাম, অতিবাম এবং গণবাহিনী, গলাকাটা বাহিনী, সর্বহারা এবং ‘হক কথা’র নামে বেহক কথার অপপ্রচারের ফুলঝুরি দেশটাকে অস্থির করে তুলেছিল। যার ফলে এত বড় বিশ্বনেতা বঙ্গবন্ধুকে চিলির আলেন্দের মতো করুণ হত্যাযজ্ঞের শিকার হতে হলো স্বাধীনতা অর্জনের সাড়ে তিন বছরের মধ্যে।

বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে জিয়াউর রহমান দেশে ফিরিয়ে আনলেন স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-শিবির মুসলিম লীগ নেজামে ইসলামসহ পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলোকে। সরকারের প্রধানমন্ত্রী বানালেন শাহ আজিজের মতো কট্টর স্বাধীনতা বিরোধীকে। মন্ত্রিসভায় ঠাঁই দিলেন উত্তরবঙ্গের আব্দুল আলিমের মধ্যে ঘৃণ্য রাজাকার নেতাকে আর বেগম খালেদা জিয়া জামায়াতকে ক্ষমতার শরিক করে পবিত্র জাতীয় পতাকা তুলে দিলেন যুদ্ধ অপরাধী রাজাকার নেতাদের গাড়িতে। জিয়ার পরে জেনারেল এরশাদ একই পথ ধরে ছিলেন অর্থাৎ ধর্মান্ধতার রাজনীতি করেছেন আধুনিক পোশাকে। একাত্তরে বঙ্গবন্ধু প্রগতিশীলতার পথে যেতে এই বাংলাদেশকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন আর জিয়াউর রহমান, এরশাদ-খালেদা সরকার সেই জাতীয় ঐক্য বিনাশ করেছেন ধর্মান্ধতার রাজনীতি ছড়িয়ে দিয়ে।

তাই সমৃদ্ধির পথে দুর্বার গতিতে দেশ এগিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে আজ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে ধর্মান্ধতার রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে, অনৈক্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হচ্ছে। তার প্রতিপক্ষ হিসেবে আজ দাঁড়িয়েছে দেশি- বিদেশি ষড়যন্ত্র আর মৌলবাদ, সশস্ত্র জঙ্গিবাদ। সেই চির পুরাতন পাকিস্তানি আইএসআই তো আছেই। আছে তাদের এদেশীয় রাজনৈতিক এজেন্টরাও।

বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সেই যে দেশ বিভক্ত হয়েছিল প্রগতি আর মৌলবাদী শিবিরে, সেই মৌলবাদী ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধেই প্রতিনিয়ত লড়াই করতে হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী রাজনীতিকে। আজ এই কালো দিনে আমরা যেন বাংলাদেশের গৌরব-বিনাশী সেই ষড়যন্ত্রের বিষয়ে সচেতন থাকি, আগামী প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে যেন উন্মোচিত করে দিই ইতিহাসের সেই কালো পৃষ্ঠাগুলো, যাতে তারা সতর্ক পদক্ষেপ ফেলতে পারে আগামী দিনগুলোতে।

লেখক: কবি ও সিনিয়র সাংবাদিক; সাবেক পরিচালক (বার্তা), বিটিভি।
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ