X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

নায়িকা গ্রেফতার!

ফারজানা হুসাইন
০৯ আগস্ট ২০২১, ১৪:৪৯আপডেট : ০৯ আগস্ট ২০২১, ১৬:০৬

ফারজানা হুসাইন কয়েক দিন আগে একজন নায়িকা গ্রেফতার হয়েছেন। নায়িকার নাম পরীমণি। পরীমণির গ্রেফতারের ঘটনা জেনেছি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। চোখে পড়েছে পরীমণির ফেসবুকের লাইভ ভিডিও।

কয়েক দিন আগে বিকালে পরীমণি তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে লাইভে এসে দাবি করলো– একদল মানুষ তার বাসার নিচে জড়ো হয়েছে, তারা নিজেদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য বলে দাবি করছেন এবং তারা অফিসিয়াল ইউনিফর্ম পরা নেই।

এবার পরীমণির স্থানে আপনি নিজেকে চিন্তা করুন। এ রকম পরিস্থিতিতে নিজের এবং পরিবারের নিরাপত্তা রক্ষায় আপনি কী করবেন? যদি তার দাবিকে সত্যি বলেই ধরে নিই।  

পুলিশ, ডিবি বা র‌্যাবের সদস্য শুনেই কোনও যাচাই-বাছাই ছাড়াই যাকে-তাকে দরজা খুলে দিতেন?

তথ্য অনুসন্ধান বা অপরাধী খুঁজতে পুলিশ যে কারও বাড়ি যেতে পারে। এ সময় যাতে মানবাধিকার লঙ্ঘন না হয় সেজন্য রয়েছে আইনের সুনির্দিষ্ট কিছু বিধান। একটি সংবাদপত্রে বেশ কয়েক বছর আগে এ নিয়ে পরামর্শ দিয়েছিলেন  রাজারবাগ ডিটেকটিভ ট্রেনিং স্কুল (ডিটিএস)-এর একজন ইন্সট্রাকটর, মো. আফজাল হোসেন।

তার পরামর্শ অনুযায়ী, বাড়িতে পুলিশ এলে যদি সন্দেহ হয়, তবে কাছের থানায় ফোন করে নিশ্চিত হতে পারেন। এজন্য যুক্তিসঙ্গত সময় তাদের অপেক্ষা করতে বলা যেতে পারে। চাইলে স্থানীয় থানায় ফোন করে নিশ্চিত হতে পারেন, আসলেই বাসায় থানা থেকে কোনও পুলিশ পাঠানো হয়েছে কিনা।

ফিরে আসি পরীমণির ফেসবুক লাইভে। পরীমণিকে  সেখানে আমরা বলতে শুনি যে তিনি তার নিকটস্থ বনানী থানায় ফোন দিয়েছেন তার বাসার নিচে উপস্থিত সাধারণ পোশাকের দলটির পরিচয় নিশ্চিত করতে। বনানী থানা থেকেই পরীমণিকে  জানানো হয় এ রকম কোনও অভিযানের কথা তাদের জানা নেই।

আবার আপনি নিজেকে এই স্থানে কল্পনা করুন। ওই সময়ে আপনার মানসিক অবস্থাই বা কী হতো? এই লোকগুলো কারা?

পরীমণি ফেসবুক ভিডিওতে জানান, তিনি ধারণা করছেন এই লোকগুলো ‘ডাকাত’ হতে পারে। এরা তাকে খুন করতে আসতে পারে। এই সময়ে পরীমণিকে তার বাসার কোনও সদস্যের সঙ্গেও কথা বলতে শোনা যায়, যাকে পরীমণি মামা সম্বোধন করছিলেন। এই ব্যক্তিকেও বলতে শোনা যায়, নিচে জড়ো হওয়া সাধারণ পোশাকের দলটি কেবল বলছেন, আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য। তারা বলছেন, আপনারা দরজা খুলুন। আর কোনও ইনফরমেশন তারা দিচ্ছেন না। পরীমণির ওই লাইভ ভিডিও’র শেষদিকে যখন পরীমণিকে নিজে দরজা খুলে দিতে দেখা যায়, তখন আমরা অপর পক্ষের বাড়িতে ঢোকার শব্দ এবং পরীমণির সঙ্গে তাদের কথোপকথন শুনতে পাই। এমনকি এ সময়েও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ তাদের পরিচয় দেননি বা কেন তারা পরীমণির বাসায় ঢোকার চেষ্টা করছেন তা তাদের বলতে শোনা যায়নি।

‘আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য’– এটুকু দাবি করলেই কাউকে দরজা খুলে দিতে হবে, তা কতটা যৌক্তিক? প্রতিটি বাহিনীর নাম আছে, সদস্যদের পদবি আছে, কোন এলাকার বাহিনী, কেন এসেছে, সার্চ ওয়ারেন্ট আছে কিনা- এগুলো জানানোর দায়িত্ব তো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। আইনের এই প্রয়োগই তো সাধারণ এবং স্বাভাবিক হওয়া উচিত। কেবল বাড়িতে হাজির হয়ে, গেটের তালা ভেঙে কোনও নাগরিকের বাড়িতে ঢোকা কোনও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য কতটা যৌক্তিক এবং আইনসিদ্ধ?

আবার অন্যদিকে, পরীমণির ভাষ্যমতে, বনানী থানাকে বারবার ফোন করার পরও কেন থানা থেকে পরীমণির বাড়িতে তার নিরাপত্তার জন্য কোনও পুলিশ পাঠানো হলো না? কোনও নাগরিক যদি তার লোকাল থানাকে ইনফর্ম করে যে কে বা কারা তার বাড়িতে জোরপূর্বক ঢোকার চেষ্টা চালাচ্ছে এবং ওই ব্যক্তি নিজের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত, তাহলে ওই লোকাল থানার তৎক্ষণাৎ পদক্ষেপ কী হওয়া উচিত? জনগণের জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই তো পুলিশের কাজ।

পরের প্রশ্ন হলো, পরীমণির বিরুদ্ধে অভিযোগ আসলে কী? বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের সৌজন্যে দুই রকম বিষয় জানতে পারি। প্রথমে জানা যায় যে পরীমণির বিরুদ্ধে পাওয়া সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই তার বাড়িতে এই অভিযান এবং তল্লাশি চালায় এলিট ফোর্স নামে পরিচিত র‌্যাব।

গ্রেফতারের পর সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে, পরীমণির একাধিক প্রেম এবং বিয়ে ছিল, তার বাড়িতে ডিজে পার্টি হতো, সমাজের বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। এগুলোর কোনটা অপরাধ? যদিও সবশেষে পরীমণিকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে।

বিভিন্ন কারণে কারও বাড়িতে পুলিশ আসতে পারে। যেমন, যদি কোনও ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হয়, তখন আসামি গ্রেফতারের উদ্দেশ্যে পুলিশ যেতে পারে। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে যদি জানা যায় কোনও বাড়িতে বা সুনির্দিষ্ট কোনও জায়গায় আগ্নেয়াস্ত্র বা বিস্ফোরক পদার্থ মজুত আছে, তখন পুলিশ তল্লাশির জন্য সেই জায়গায় যেতে পারে। এছাড়া কোনও মামলার পলাতক আসামিকে খুঁজে বের করার জন্য ওই বাড়িতে ‍পুলিশ তল্লাশি করতে পারে।

এলিট ফোর্স র‌্যাবের সৃষ্টি হয়েছিল বড় বড় অপরাধ নির্মূলের লক্ষ্যে। সেই বড় অপরাধ হতে পারে যেমন, জঙ্গি দমন, নারী পাচারকারী সংঘবদ্ধ দলকে গ্রেফতার, চোরাকারবারি দলকে দমন, দুর্ধর্ষ  সন্ত্রাসীকে পাকড়াও করা  ইত্যাদি। পরীমণি একজন সিনেমার নায়িকা, বর্তমান সময়ের বেশ বড়সড় একজন সেলিব্রেটি। একজন নায়িকা কত বড় অপরাধী বা কত দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী হলে তার বাড়িতে সার্চ করতে বা তাকে গ্রেফতার করতে কয়েক ঘণ্টা ধরে অভিযান চালাতে হয়? এ তো রীতিমতো মশা মারতে কামান দাগানো!

আরেকবার ফিরে যাই পরীমণির ওই দিনের ফেসবুক লাইভের শেষ অংশে। এক পর্যায়ে এসে দরজা খুলে দিলেন পরীমণি। বাড়িতে ঢুকতে শুরু করলো বাইরে অপেক্ষারত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পরীমণির ওই লাইভ থেকেই আমরা শুনতে পারি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বাড়িতে ঢুকেই পরীমণিকে ফেসবুক লাইভ বন্ধ করতে বলেন এবং পরীমণি ও তার বাড়িতে উপস্থিত সবার ফোন নিয়ে নেয়। একই সঙ্গে আমরা আরও জানতে পারি যে ওই সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিচে অবস্থান করা সংবাদকর্মীদেরও বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি। 

লাইভের একেবারেই শেষাংশে ভীত গলায় পরীমণি প্রশ্ন করেছিলেন, কেন র‌্যাবের সদস্যরা একে-অপরকে ফিস ফিস করে বলছে পরীমণির লাইভ ভিডিও চলছে। কেন তারা পরীমণিকে লাইভ শেষ করতে বলছে? কেন সবার মোবাইল ফোন নিয়ে নেওয়া হচ্ছে? উত্তর আসেনি অপর পক্ষ থেকে।

এ প্রসঙ্গে আলোচনার শুরুতেই আমি আমেরিকার জর্জ ফ্লয়েডের ঘটনাটা সবাইকে আরেকবার মনে করিয়ে দিতে চাই। ২০২০ সালের মে মাসে জর্জ ফ্লয়েড মারা যায় পুলিশ কাস্টোডিতে হাতকড়া পরা অবস্থায়। তার বিরুদ্ধে গ্যাস স্টেশনের দোকানদার অভিযোগ এনেছিল নকল ২০ ডলারের নোট দিয়ে জিনিস কেনার। আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ পুলিশ মাত্র ২০ ডলার নকল নোটের জন্য অভিযুক্ত এই কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডকে হাতকড়া পরা অবস্থায় তার গলায় হাঁটু গেড়ে তাকে মাটিতে চেপে ধরে রাখে পুরো  ৯ মিনিট ২৯ সেকেন্ড। পরে পুলিশ হেফাজতে ফ্লয়েডের মৃত্যু হয়। এই মৃত্যু পুরো আমেরিকা এবং বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বসবাসকারী অধিকার সচেতন মানুষকে পুলিশের নির্মমতার বিরুদ্ধে সোচ্চার করে, সরব করে তোলে। পুরো ঘটনাটা এত দ্রুত সমগ্র বিশ্ববাসীর কাছে ছড়িয়ে পড়ার কারণ হলো একটি ভিডিও ক্লিপ। পুলিশ যখন ফ্লয়েডের সঙ্গে এই নিষ্ঠুর আচরণ করছিল তখন পাশ দিয়ে যাচ্ছিল ১৭ বছরের এক কিশোরী। সে দ্রুত তার ফোনে এই ভিডিওটি করে এবং পরে তা ছড়িয়ে দেয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, যা ভাইরাল হয়ে যায় তাৎক্ষণিকভাবে। ভিডিওটি চিত্রে ফ্লয়েডকে ক্ষীণকণ্ঠে  বলতে শোনা যায়– আই ক্যান্ট ব্রিদ। পরবর্তীতে ‘আই ক্যান্ট ব্রিদ’ এই বাক্যটিই হয়ে ওঠে বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদের ভাষা।

পরীমণির সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কোনও খারাপ আচরণ করেছে তা আমরা শুনিনি। বরং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নারী সদস্যদের দেখা গেছে পরীমণিকে পাহারা দিয়ে তার বাসা থেকে গ্রেফতারের পর নিয়ে যেতে, আদালতেও পরীমণির চারপাশে পুলিশের নারী সদস্যরাই ছিলেন।

কিন্তু, অভিযানের সময়ে যখন পরীমণিকে ফেসবুক লাইভ বন্ধ করতে বলা হলো, তার বাড়ির নিচে অবস্থান করা সাংবাদিকদের ওপরে আসতে দেওয়া হলো না, তখন জনমনে এ প্রশ্ন আসতেই পারে এই অভিযান কতটুকু স্বচ্ছ। পরীমণির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ আদতে কতটুকু সত্য?

গ্রেফতারের পরদিন আদালতে পরীমণিকে উপস্থাপনের পর মিডিয়ার সামনে পরীমণির আইনজীবীকে দেখা গেলো। তিনি বললেন, পরীমণির বিরুদ্ধে আনা মাদকের অভিযোগ মিথ্যা। যে পরিমাণ মাদকদ্রব্য পরীমণির বাড়িতে পাওয়া গেছে বলে পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, তা ভিত্তিহীন।

ফৌজদারি কার্যবিধির ১০৩ ধারা (১) অনুযায়ী তল্লাশি চালানোর আগে, প্রস্তুত অফিসার বা অন্য কোনও ব্যক্তি যে স্থানে তল্লাশি চালানো হবে সেই এলাকার দুই বা ততধিক সম্মানিত অধিবাসীকে তল্লাশিতে হাজির থাকা ও সাক্ষী হিসেবে আহ্বান জানাতে হবে।

১০৩-এর ধারা (২) অনুযায়ী সাক্ষীদের উপস্থিতিতে তল্লাশি চালাতে হবে। এ সময় উক্ত অফিসার বা অন্য কোনও ব্যক্তি তল্লাশির সময় জব্দকৃত সমস্ত জিনিস এবং যে জায়গায় ওই জিনিসগুলো পাওয়া গেছে, তার একটি তালিকা প্রস্তুত করবেন। সে তালিকায় উক্ত সাক্ষীরা স্বাক্ষর করবেন।

১০৩-এর উপধারা ৩ অনুযায়ী তল্লাশি করা কোনও জিনিস আটক গ্রহণ করা হলে আটককৃত বস্তুর তালিকার একটি অনুলিপি সেই স্থানের মালিক বা দখলদার পাওয়ার অধিকার রাখেন।

যদি এই প্রক্রিয়া উপেক্ষা করা হয় তাহলে জব্দকৃত জিনিস এভিডেন্স হিসেবে আদালতে গ্রহণযোগ্যতা হারাবে। শুধু তাই নয়, পুরো অভিযান এবং তল্লাশির প্রক্রিয়াটিও যথাযথ আইন মেনেই হতে হবে।

অতীতে আমাদের দেশে বহুবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান ও তল্লাশির আইনি প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হতে দেখা গেছে। উপরন্তু পরীমণির মতো একজন সেলিব্রেটির বাড়িতে সব মিলিয়ে দুই লক্ষ টাকার কিছু বেশি মূল্যের মাদকদ্রব্যের জন্য র‌্যাবের এহেন অতর্কিত আর সাঁড়াশি তল্লাশি সাধারণ জনগণের অবস্থানকে বিভক্ত করে ফেলেছে ইতোমধ্যে। সাধারণের এই দ্বিধান্বিত অবস্থানকে জানতে কেবল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে চোখ বুলালেই হয়।

উপরন্তু পরীমণির সঙ্গে কেবল ব্যক্তিগত সম্পর্ক থাকার কারণে নাট্যপরিচালক চয়নিকা চৌধুরীকে পান্থপথ থেকে ডিবি পুলিশের তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া এবং জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচ ঘণ্টা আটকে রাখা ব্যক্তিমনের প্রশ্নের সংখ্যাকে বাড়িয়েই তোলে। ঘটনার আকস্মিকতায় ভীতসন্ত্রস্ত-হতবিহ্ববল চয়নিকা চৌধুরীকে বারবার প্রশ্ন করতে শোনা যায়, আমাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, আমাকে কেন ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? 

তদন্তের স্বার্থে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যে কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে। কিন্তু এই জিজ্ঞাসাবাদের আইনগত প্রক্রিয়া হলো তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য উপস্থিত হওয়ার নোটিশ দেওয়া। নির্দিষ্ট দিন ও সময়ে ওই ব্যক্তি উপস্থিত না হলে, তাকে কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করা যেতে পারে, কোর্ট থেকে সমন জারি করা যেতে পারে তার ওপর। তারপরও ওই ব্যক্তি অনুপস্থিত থাকলে তখন তাকে আটকের যৌক্তিকতা সৃষ্টি হয়। যেভাবে পরীমণি এবং তার আশপাশের মানুষদের ধরপাকড় চলছে, তাতে মূল বিষয়টা অভিযোগকেন্দ্রিক আর থাকছে না; বরং কেবল বাহুবলের প্রদর্শন আর অহেতুক জনমনে ভয়ভীতি সঞ্চার করার জন্য এই আটকগুলো করা হচ্ছে বলেই প্রতীয়মান হয়ে ওঠে।

পরীমণি গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে সমাজের উঁচু থেকে নিচু সব স্তরের মানুষের কাছ থেকেই বারবার একটি প্রশ্ন শোনা যাচ্ছে, এই অভিযান, তল্লাশি, গ্রেফতার কি কেবল পরীমণির বাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া দু’লক্ষ টাকা মূল্যের মাদকদ্রব্যকে ঘিরে, নাকি এর পেছনে আছে কোনও প্রভাবশালী ব্যক্তি বা চক্রের প্রতিহিংসা পরায়ণতা?

জুন মাসের ঢাকা বোট ক্লাবের ঘটনা আবারও সামনে চলে আসছে। যারা ওই ঘটনায় তখন গ্রেফতার হয়েছিল, মিডিয়ার সামনে নতমুখে দাঁড়িয়েছিল, তারা কি এই তল্লাশির পেছনে কলকাঠি নাড়ছে?

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের এই অভিযান কেবল পরীমণি আর কিছু উঠতি মডেলদের বাড়িতেই কেন হঠাৎ শুরু হলো? গুলশান, বনানীর মতো সম্ভ্রান্ত এলাকাগুলোতে অনেক বাড়িতে এ রকম মিনিবার আছে, অনেকেই নিয়মিত মাদক সেবন করে সেখানে– এ তো সবাই জানে। তাহলে আর কারও বাড়িতে কেন এ ধরনের অভিযান চলছে না- এ প্রশ্নও মুখে মুখে।

আবার এই যে এত এত মদের বোতল পরীমণির বাড়ি থেকে র‌্যাব জব্দ করলো, মিডিয়ার সামনে দিয়ে তা প্রকাশ্যে নিয়ে গেলো, পরীমণিকে কাস্টডিতে নিয়ে র‌্যাবের কর্মকর্তা সংবাদ সম্মেলন করলেন– সে বিষয়ে আইনি প্রক্রিয়া কতখানি মানা হলো। আইন বলে ইনোসেন্ট, A person is  innocent until proven guilty. যতক্ষণ পর্যন্ত অপরাধ প্রমাণ না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত ওই ব্যক্তি কেবল অপরাধের জন্য অভিযুক্ত, দোষী নয়। কিন্তু পরীমণির বাড়িতে অভিযানের সময় লাইভ ভিডিওতে আপত্তি, মিডিয়ার কাউকে সেখানে ঢুকতে দেওয়া হলো না তল্লাশি এবং নিরাপত্তার খাতিরে,  কিন্তু তল্লাশি শেষে পরীমণির বাড়ি থেকে র‌্যাব এবং পুলিশের সদস্যরা বেরোলেন জব্দকৃত মদের বোতলসহ, সেখানেও কোনও রাখঢাক নেই, পুরোটা মিডিয়ার জন্য উন্মুক্ত।

এভাবে উন্মুক্ত বেশিরভাগই মদের খালি বোতল, বিভিন্ন বাহারি গ্লাস আর কিছু কালো প্যাকেটের মোড়া সামগ্রী, যা পরে বলা হলো ওগুলো মদসহ মদের বোতল। মিডিয়ার মাধ্যমে জনগণকে এসব দেখিয়ে বিচারের আগেই কি পরীমণিকে মব ট্রায়াল আর মিডিয়া ট্রায়ালের দিকেই ঠেলে দেওয়া হলো না?

বাংলা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি সম্পর্কে, বিনোদন জগৎ সম্পর্কে সাধারণ জনগণের মনকে বিষিয়ে দেওয়া হলো না? ওই মুহূর্তেই সাধারণ মানুষের কাছে বাংলা সিনেমা আর সিনেমার জগৎ নিয়ে কী ধারণা হলো?

অপরাধীকে আইনের আওতায় আনা, আইনের যথাযথ প্রয়োগ করা এবং আইন অনুযায়ী তার শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ। অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করা তো তাদের জুরিসডিকশনে পড়ে না, ওটা আদালতের কাজ।

এমনিতেই নারীর প্রতি আমাদের রক্ষণশীল সমাজের আচরণ সব সময়ই বিমাতাসুলভ। তার ওপর নারী যদি হয় নায়িকা, অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী এবং বিলাসবহুল জীবনযাপনে অভ্যস্ত, তবে তো মিডিয়া ট্রায়ালের নামে তাকে অভিযোগ প্রমাণের আগেই অভিযুক্ত করতে পারলে পাথর ছুড়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে সমাজকে শূচি করে পুণ্যবান পুরুষতন্ত্রের ধারক-বাহকেরা!

পরীমণির বাড়ি থেকে যে পরিমাণ মদের বোতল উদ্ধার  করা হয়েছে, তা দেখে প্রশ্ন জাগে এই পরিমাণ বোতল তো পরীমণি বাড়ির পাশের মুদির দোকান থেকে কেনেনি বা নিজে বাড়িতে তৈরি করেনি। তাহলে এই মাদকদ্রব্যের সরবরাহ কোথা থেকে হলো, কার কাছ থেকে এগুলো কিনলো বা সংগ্রহ করলো।

গত কয়েক বছরের মাদক সংক্রান্ত মামলাগুলোকে আমরা যদি পর্যালোচনা করি তাহলে কি আমরা সর্বস্তরে মাদকের ব্যবহার এবং চালান বন্ধে একটা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগোচ্ছি– তা দেখা যাবে, নাকি পুলিশের গ্রেফতার, তল্লাশি কেবল লোক দেখানো আর মাদকের  চুনোপুঁটি কনজিউমার স্তরকেই আটক করা পর্যন্ত তা প্রতীয়মান হবে?

যখন এই লেখাটি লিখছি, তখন পরীমণি পুলিশের রিমান্ডে আছেন। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। যদি তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করা যায় বা জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আরও নতুন কোনও তথ্য সামনে আসে, যা থেকে অন্য কোনও অভিযোগে তাকে অভিযুক্ত করা যায়, তাহলে তা হতে হবে আইন অনুযায়ী, আইন মেনে। এটাই আইনের সাধারণ আর স্বাভাবিক নিয়ম।

এ ধরনের আইনি প্রক্রিয়ায় আইন প্রয়োগে সর্বস্তরেই বিশেষ সতর্কতা আর স্বচ্ছ্তা নিশ্চিতকরণই পারে আইনকে, আইনের প্রায়োগিক দিকগুলোকে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কলুষমুক্ত রাখতে। আমরা আইন প্রয়োগের বিভিন্ন ধাপ যতবেশি স্বচ্ছ আর আবেগমুক্ত রাখতে পারবো, ততবেশি করে নিশ্চিত করতে পারবো দেশে আইনের শাসন এবং আইনের প্রতি জনগণের আস্থা।একজন আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নাগরিক হিসেবে একটি সাধারণ, স্বাভাবিক, মর্যাদাপূর্ণ  আর নিরাপদ জীবন আমাদের দাবি। এই দাবি পূরণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তাদের দায়িত্বের অংশটুকু যথাযথভাবে পালন করতে হবে। তাদের ভুলে গেলে চলবে না- With great power, comes great responsibility.

লেখক: আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী।

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
টিভিতে আজকের খেলা (২৭ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৭ এপ্রিল, ২০২৪)
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ