X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

গণমাধ্যমকর্মীদের মূল্য কোথায়?

ইকরাম কবীর
১০ অক্টোবর ২০২১, ১৬:২১আপডেট : ১০ অক্টোবর ২০২১, ১৬:২৫

ইকরাম কবীর একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরির সাক্ষাৎকার দিতে গেছি ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে। যোগাযোগ প্রধানের পদ। এর আগেও কয়েকবার সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। সেদিন ছিল শেষ সাক্ষাৎকার। প্রশ্ন করবেন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তিনি আমায় সুধালেন– আমি কেন সাংবাদিকতা ছেড়ে করপোরেট চাকরিতে আসতে চাইছি।

আমি বিনয়ের সঙ্গে দু’টি বিষয় তাকে জানিয়েছিলাম। ২৪ বছর সাংবাদিকতা করে আমি কখনোই আর্থিক সচ্ছলতার মুখ দেখতে পারিনি। আমাদের সন্তানদের জীবন সহজ করতে পারিনি। আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কোনও অর্থ জমা নেই। পরিবারের জন্য আমার আয় বাড়াতে চাই।

তাকে আরও জানিয়েছিলাম, এখন যত খবরের কাগজ এবং টেলিভিশন চ্যানেলের জন্ম হয়েছে, তা দেখে আমার মনে হয়েছে সাংবাদিকতায় আমার দেওয়ার মতো আর কিছু নেই এবং আমার নিজের শেখারও আর কিছু নেই।

যাহোক, চাকরিটা আমি পেয়েছিলাম।

অনেক বছর পেছনে ফিরে যাই।

১৯৯১ সালে যখন ‘দ্য ডেইলি স্টার’-এ কাজ শুরু করি, তখন কাগজের সংখ্যা তেমন খুব বেশি ছিল না। ইংরেজি কাগজ বলতে ‘বাংলাদেশ অবজারভার’ ও ‘মর্নিং সান’ ছিল। ‘ডেইলি স্টার’ প্রকাশিত হওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই ‘টেলিগ্রাফ’ প্রকাশিত হলো কিন্তু সেটি বেশি দিন চলেনি। তার কাছাকাছি সময়ে ‘দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ এলো। ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ এখনও আছে তবে ছাপার সংস্করণ নেই।

প্রধান বাংলা কাগজ ছিল সংবাদ, ভোরের কাগজ, ইত্তেফাক, ইনকিলাব ও জনকণ্ঠ। ঢাকার বাইরেও অনেক ভালো কাগজ ছিল কিন্তু সেগুলোর কথা আজকের প্রসঙ্গে আনতে চাই না।

‘ডেইলি স্টার’-এ মায়না পেতাম তিন হাজার টাকা। মায়না নিয়ে আসলে তখন এতটা চিন্তা ছিল না। লক্ষ্য ছিল সাংবাদিকতা। সাংবাদিকতা শিখতে হবে এবং নিজের পেশার মাধ্যমে দেশের মানুষকে সাহায্য করতে হবে; জাতি গঠনে অবদান রাখতে হবে। ছেলেবেলা থেকে আমি তাই-ই দেখে এসেছি। আমি এখনও মনে করি, সাংবাদিকরা অন্যান্য অনেক পেশার কর্মীদের চেয়ে জাতীয় পর্যায়ে অনেক বেশি অবদান রাখেন। জনমানুষের কথা বলে এবং তাদের অধিকারের কথা বলে নিজেদের পেশা অনেক অর্থবহ তোলেন। গণমাধ্যম না থাকলে দেশের পরিস্থিতি যে আরও করুণ হতো তাও আমি বিশ্বাস করি।

কেন আমি সাংবাদিক হতে চাইলাম? প্রশ্নটি আবারও রাখি।

সাংবাদিকই হতে চেয়েছিলাম। তথ্য সংগ্রহ করে তথ্য প্রচার। অন্য অনেক অর্থকরী পেশা বেছে নেওয়ার সুযোগ ছিল। সরকারি চাকরি, করপোরেট চাকরি। কিন্তু অর্থ রোজগার তখন এতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি। তখন যারা সাংবাদিকতা করতেন তারাও তেমন অর্থ  উপার্জনে মনোযোগী ছিলেন না। মনের এবং এক ধরনের মূল্যবোধের তাগিদেই এই পেশায় আসতেন। আমার উদ্দেশ্য ছিল লেখা। সাংবাদিকরা সারা জীবনই লেখালিখি করেন।

সাংবাদিক হিসেবে অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হলো। এক কাগজ ছেড়ে অন্য কাগজে ডাক পড়ে।

‘ডেইলি স্টার’-এর পর ‘দ্য ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস’, ‘একুশে টেলিভিশন’, ‘বিবিসি’, ‘একাত্তর টেলিভিশন’ ও ‘এবিসি রেডিও-প্রথম আলো’তে কাজ করার অভিজ্ঞতা হলো। কাজ করেছি চব্বিশ বছর। কাজের মাধ্যমে কী অবদান রাখতে পেরেছি তা যদি ভাবি তাহলে বলতে হবে– ‘খুব বেশি নয়’। তবে দিতেই চেয়েছিলাম। চব্বিশ বছরের প্রথম ভাগে কর্মজীবন বেশ তৃপ্তিদায়কই ছিল।

তারপর শুরু হলো অর্থকষ্ট। প্রথম ভাগে অর্থকে অত গুরুত্বপূর্ণ না মনে হলেও পরে টের পেয়েছি কতটা আর্থিক অসচ্ছলতায় কেটেছে আমার এবং আমার পরিবারের জীবন।

বাংলাদেশে সাংবাদিক এবং সংবাদ কর্মীদের বেতন বা ভাতা অন্যান্য যেকোনও খাতের চেয়ে অনেক অনেক কম। সরকারের কিছু নিয়ম-কানুন (তথাকথিত ‘ওয়েজ বোর্ড’) আছে সংবাদকর্মীদের ন্যূনতম বেতন ও ভাতা দেওয়ার ব্যাপারে। তবে কতটি প্রতিষ্ঠান তা দিচ্ছে বা দেওয়ার ইচ্ছে আছে তা ভাবলে মন বিমর্ষ হয়। এই বিষয়টি নিশ্চিত করবে কোন সংস্থা সেটিও একটি প্রশ্ন। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের নিজেরই তেমন আয় নেই। তাহলে দেবে কোথা থেকে? বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং গ্র্যাচুইটি সুবিধা নেই যে একজন কর্মী অবসর নেওয়ার পর কিছু অর্থ নিজের হাতে পেতে পারেন।

অনেক সাংবাদিককে অনেক ব্যাধি নিয়ে ধুঁকে-ধুঁকে মারা যেতে দেখেছি। অসুস্থতার সময় তাদের কাছে চিকিৎসার জন্য অর্থ ছিল না। কেউ কেউ হয়তো সরকারি সাহায্য পেয়ে থাকেন কিন্তু তা পেতে গেলে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকতে হয় বা সাংবাদিকের অনেক নামডাক থাকতে হয়। সবাই তো আর ডাকসাইটে সাংবাদিক হতে পারেন না। সাংবাদিকদের হয়তো সমাজের অনেকেই চেনেন, কিন্তু সংবাদমাধ্যমের অন্যান্য কর্মীদের কেউ চেনেন না। তাদের অবস্থা আরও করুণ।

সমাজের মানুষদের ধারণা ছিল যে সাংবাদিক হবেন অতি সাধারণ,গরিব অথবা মধ্যবিত্ত এবং সৎ। অন্যান্য পেশাজীবীরা যেমন আর্থিক সচ্ছলতা ভোগ করবেন, সাংবাদিকদের তার প্রয়োজন নেই। তারা অর্থ দিয়ে কী করবেন? তারা তো সাংবাদিক! সাংবাদিকের আবার অর্থের কী প্রয়োজন? দু’মুঠো খেয়ে-পরে বাঁচতে পারছেন, সেটাই যথেষ্ট। সুখে থাকুন।

পরিস্থিতি এখনও তেমনই আছে। আরও অবনতি হয়েছে বলেই মনে হয়। আমরা যখন সংবাদমাধ্যমে কাজ শুরু করি তখন দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা অনেক কম ছিল এবং পত্রিকা বিক্রি ও বিজ্ঞাপন থেকে তাদের আয় মোটামুটি ছিল। শুনেছি এখন প্রায় ত্রিশটির বেশি টেলিভিশন চ্যানেল, পাঁচশ’র বেশি পত্রিকা এবং কয়েক হাজার অনলাইন খবরের পোর্টাল আছে। অনলাইন পোর্টালগুলোর মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চলছে অল্প কয়েকটি। এগুলো চলবে কী করে? এত পত্রিকায় বিজ্ঞাপনদাতারা বিজ্ঞাপন দেবেনই বা কেমন করে?

সংখ্যার দিকে তাকিয়ে আমরা হয়তো বুক চাপড়াতে পারি এই বলে যে বাংলাদেশে গণমাধ্যমের বন্যা বইছে। বেশি বেশি সংবাদ প্রতিষ্ঠান, বেশি বেশি সাংবাদিকতা, বেশি বেশি বলার স্বাধীনতা এবং তার সঙ্গে বেশি বেশি গণতন্ত্র।

কিন্তু হাজার হাজার সংবাদকর্মী যে আর্থিক দুর্দশার মধ্যে জীবন কাটাচ্ছেন তা দেখতে বা বুঝতে বোধহয় ব্যর্থ হচ্ছি। হয়তো বুঝেও সংবাদকর্মীদের জীবনের মানোন্নয়ন থেকে বিরত থাকছি।

কয়েক বছর আগে আমি একটি টেলিভিশন চ্যানেলে কাজ করতাম। সেখানে একেবারে নতুন প্রতিবেদকদের ১৫ হাজার টাকা বেতন দেওয়া হতো।  তাদের বেতনও সহজে বাড়তো না। চিন্তা করুন, ঢাকার মতো এক শহরে ২০১২ সালে একজন সাংবাদিকের বেতন ১৫ হাজার টাকা! তিনি যদি বিবাহিত হন, তাহলে স্ত্রীকে নিয়ে কোথায় বসবাস করবেন? একমাত্র বস্তিগুলোতেই আড়াই-তিন হাজার টাকায় ছাপরা ভাড়া পাওয়া যায়। আমরা যদিও অনেকে মনে করি যে একজন সাংবাদিক তার জীবনের শুরুতে কষ্টে বসবাস করবেন, তাহলে আর কথা বাড়াতে চাই না।

তবে আমরা বোধহয় তেমনটা চাই না। একজন গাড়িচালক, একজন গৃহকর্মী বা একজন অফিস সহকারীর চেয়ে বোধহয় সংবাদকর্মীকে বেশি বেতন দিতে চাই।

সেই টিভি স্টেশনে স্বাস্থ্যসম্মত একটি শৌচাগারও ছিল না। মেয়েদের জন্যও না। অতিথিদের জন্য তো না-ই। খাওয়া-দাওয়া করার কোনও স্থান ছিল না। আমি বলছি না যে সব প্রতিষ্ঠানই এমন, তবে আমরা যদি কোনও সমীক্ষা চালাই তাহলে দেখা যাবে অনেক অফিসেই স্বাস্থ্যসম্মত কাজের পরিবেশ তেমন প্রশংসাযোগ্য নয়।

‘ডেইলি স্টার’-এর প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আমরা যখন সেখানে কাজ করতাম, ‘ডেইলি স্টার’-এর পরিবেশ ছিল প্রশংসনীয়। এখন আরও ভালো হয়েছে। অগ্রজেরা সারাক্ষণ অনুজদের শেখাচ্ছেন, প্রায়ই দেশি-বিদেশি প্রশিক্ষক আসছেন এবং সবার মধ্যে শেখার আগ্রহ, ভালো কাজ করলে প্রশংসা পাচ্ছেন সবাই, ভুল করলে তাকে আবারও হাতে-কলমে শেখানো হচ্ছে। এখন ভাবলে খুবই ভালো লাগে।

‘ডেইলি স্টার’-এ কর্মীদের বেতন-ভাতা নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হতো। সেখানে প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং গ্র্যাচুইটি পাওয়ার সুবিধা ছিল। তখন আরও অনেক কাগজেই তা ছিল। এখনও আছে, তবে এত পত্রিকার ভিড়ে তা তেমন চোখে পড়ে না।

একটি সংবাদপত্র, একটি টেলিভিশন চ্যানেল বা নিউজ পোর্টালের আয় কোথা থেকে আসবে তা নিয়ে আলাপ জরুরি। এক-একটি খবরের কাগজ, টেলিভিশন চ্যানেল বা অনলাইন নিউজ পোর্টালকে যদি এক-একটি দোকানের সঙ্গে তুলনা করি, তাহলে বোঝা যাবে। কর্মীদের বেতন দেওয়ার জন্য আয় আসবে নিশ্চয়ই বিজ্ঞাপন থেকে। পত্রিকা বা টেলিভিশন চ্যানেল প্রকাশ বা সম্প্রচারের অনুমতি দেওয়ার আগে সরকার এ বিষয় ভেবে দেখে কিনা জানি না। তবে ভাবা প্রয়োজন। খুব সততার সঙ্গেই ভাবা প্রয়োজন। সরকারি দল হয়তো মনে করতে পারে, যত বেশি সংবাদপত্র তত বেশি সরকারি দলের প্রচার। ব্যাপারটি আসলে গণমনে এভাবে কাজ করে না। জনমানুষ কয়েকটি পত্রিকার ওপরই আস্থা রাখেন, সেগুলোই পড়েন– বাকিগুলোর প্রতি সেভাবে আস্থা অর্জন করতে পারেনি বলেই মনে হয়।

বিজ্ঞাপনদাতারা কারা? যেসব কোম্পানি তাদের পণ্য বিক্রি করতে চায়। এখন যদি কোনও একটি সংবাদপত্র বা টিভি চ্যানেল বিজ্ঞাপনদাতার ক্রেতারা না পড়েন বা না দেখেন, তাহলে সেখানে বিজ্ঞাপন দিতে তারা আগ্রহী হন না। এটি একটি সাধারণ জ্ঞান। কোনও কাগজ যদি কেউ না পড়েন বলে বিজ্ঞাপনদাতা জানতে পারেন, তাহলে সেখানে তারা বিজ্ঞাপন দেবে না। পত্রিকার সম্পাদকের সঙ্গে কোম্পানির মালিকের সুসম্পর্ক থাকলে হয়তো এক’দু’বার দেবে – তারপর আর দেবে না।

তাহলে পত্রিকার আয় আসবে কোথা থেকে? পত্রিকার কর্মীদের বেতন-ভাতাই বা আসবে কোথা থেকে?

উত্তর খুব সহজ। পুঁজি ফুরিয়ে গেলে, পত্রিকার ব্যবস্থাপনা পর্ষদ বা মালিকরা কর্মীদের বেতন-ভাতা দেওয়ার বিষয়ে অন্য চিন্তা করবেন। হয়তো কর্মী কমিয়ে আনার চেষ্টা করবেন। ভালো কর্মীদের বেতন বেশি হয়, সে ক্ষেত্রে দেখা যাবে সেই দক্ষ ও ভালো কর্মীদের ছাঁটাই করে দিতে হবে। এতে পত্রিকা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলা শুরু করবে।

এখন প্রশ্ন হলো, এভাবে চললে কি সংবাদকর্মীরা না খেয়ে কষ্ট করবেন? আমাদের এই সমাজে অনেক শিল্পপতি এবং অর্থবান মানুষরা পত্রিকা বা টেলিভিশন চ্যানেলের মালিক হতে চান। তারা লাইসেন্স পান। আদর করে এখান-ওখান থেকে সংবাদকর্মীদের আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে আসেন নিজের প্রতিষ্ঠানে। অনেক প্রতিশ্রুতি থাকে। ভালো সাংবাদিকতা হবে। দেশোদ্ধার হবে, সমাজ পরিবর্তন হবে, গণমাধ্যমকে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে দাঁড় করাতে হবে, ইত্যাদি। এই সংবাদকর্মীরাও খুব আবেগী। এসব কথা শুনলে তারাও আপ্লুত হয়ে যান। তারপর একদিন মালিকের সামনে বাস্তবতা চলে আসে। তখন মিডিয়ার দাঁড় করানোর শখে আঘাত আসে।  ‘শখের দাম লাখ (এখন কোটি) টাকা’। টাকাও শেষ হয়। শখও শেষ হয়।

গেলো এক দশকের বেশি সময় ধরেই বাংলাদেশের মিডিয়া খাতে এমন পরিস্থিতিই চলছে। কিছু অর্থ বা একটি ব্যবসায়ী-গ্রুপের মালিক হলে এবং সঙ্গে সঠিক রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থাকলেই যে মিডিয়ার মালিক হওয়া যায় তা এখন সবাই বোঝেন। এমন অনেক মিডিয়া প্রতিষ্ঠানের উদাহরণ আছে যেখানে সংবাদকর্মীদের বেতন-ভাতা দিতে গড়মসি করা হয়। মাসের বেতন মাসে দেওয়া হয় না; দুই-তিন মাস পর পর বেতন দেওয়া হয়। এসবের মধ্যে ভালো প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা খুবই কম।

সাংবাদিকদের এমনই অবস্থা। তারা নিজেরা বলতে পারেন না। বলবেন কেমন করে? তার নিজের চাকরির অবস্থাই তো টলমল।

একটি পত্রিকা বা টিভি চ্যালেনকে দোকানের সঙ্গে তুলনা করছি। কারণ হচ্ছে যে অন্য যেকোনও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মতো এগুলোও কিছু না কিছু বিক্রি করে। তাদেরও পণ্য আছে। কন্টেন্টই হলো তার পণ্য।

তবে যারা এসব প্রতিষ্ঠানের মালিক, তারা এই মিডিয়া- দোকানদারি বিষয়টি কতটা বোঝেন। অন্যান্য খাতের দোকানদারি তারা খুব ভালো বোঝেন তা আমরা জানি।

তারা অনেকেই বোঝেন না এবং বুঝতেও চান না। দোকানটি প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই তারা খুশি। সেটি কেমন করে চলবে, তার মুনাফা কোথা থেকে আসবে তা নিয়ে তাদের চিন্তা খুব নগণ্য। আগেই বলেছি, তাদের জন্য এমন একটি দোকানের মালিক হওয়া এক ধরনের শখ। এই শখের প্রতিষ্ঠানে যারা কাজ করেন, তাদের জীবন কেমন করে চলবে তা নিয়ে তাদের কোনও মাথাব্যথা নেই।

অনেকেই মনে করেন, ‘ আরে ওরা কি মানুষ নাকি? আমার শখটাই সব। ওদের কী হলো তা ভেবে আমার কাজ কী?’

এই শখের মূল্য গণমাধ্যমকর্মীরা কেমন করে দিয়েছেন তা আমরা ২০২০ সালে করোনাকালে দেখেছি। বেতন-ভাতা না দিতে পেরে শত শত সংবাদকর্মী চাকরি থেকে ছাঁটাই হয়েছেন। অন্যান্য অনেক ব্যবসা থেকেই কর্মী ছাঁটাই হয়েছে। অন্যান্য খাতের ছাঁটাইয়ের কথা সাংবাদিকরা সংবাদপত্রের লিখতে পারলেও নিজেদের কর্মস্থানের ছাঁটাই নিয়ে তাদের পক্ষে কিছুই লেখা সম্ভব হয়নি। নিজে ছাঁটাইয়ের খপ্পড়ে পড়ে যাননি সেই তো বড় ভাগ্য।

গেলো কুড়ি মাসে আমার অনেক সংবাদকর্মীর সঙ্গে আলাপ হয়েছে। কেউ নিজে টেলিফোন করেছেন, অনেকের সঙ্গে আমিই যোগাযোগ করেছি। অনেকেই আমায় অনুরোধ করেছেন তাদের জন্য অন্য কোনও চাকরি খুঁজে দেওয়ার জন্য।

‘দৈনিক ইত্তেফাক’, ‘বাংলাদেশ অবজারভার’, ‘মর্নিং নিউজ’, ‘মর্নিং সান’-এর কথা নিশ্চয়ই মনে আছে। এই কাগজগুলোর মালিকদের কাগজের মালিকানার কোনও শখ ছিল না। শখ থাকলে সাংবাদিকতার শখ ছিল। তারা সাংবাদিকতা বাঁচিয়ে রাখতে চাইতেন। তারা তাদের কর্মীদের সঙ্গে কেমন আচরণ করতেন? না, প্রজাদের সঙ্গে রাজা-বাদশাহরা যেমন ব্যবহার করতেন তেমন নয়। তাদের কর্মীদেরও আধাপেট খেয়ে জীবনযাপন করতে হতো না।

এই কাগজগুলো পাঠকের মাঝে পৌঁছাতে পেরেছিল। কয়েকটি পত্রিকা আমাদের স্বাধীনতা অর্জনেও ভূমিকা রাখতে পেরেছিল। সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানই তাদের বিজ্ঞাপন এই কাগজগুলোতে দিতেন এবং সেখান থেকেই কাগজের আয় আসতো। এখনও তেমন কাগজ রয়েছে, যারা শুধু শখের বশে পত্রিকা প্রকাশ করেননি। সাংবাদিকতা করবেন বলে বাজারে আছেন। অনেক কাগজ আছে যাদের ব্যবস্থাপনা পর্ষদ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। শখের বশে নয়, সাংবাদিকতা এবং একই সঙ্গে পত্রিকাটিকে একটি অর্থপ্রদ প্রতিষ্ঠানে রূপ দিতে। কিছুটা পারছেন,কিছুটা ব্যর্থ হচ্ছেন। তবে চেষ্টা আছে।

তবে পরিস্থিতি আগেকার মতো নেই। নেতিবাচকভাবে বদলে গেছে।

আমি কেন একটি খবরের কাগজের বা একটি টেলিভিশন চ্যানেলের মালিক হবো তা নিয়ে সততার সঙ্গে ভাবা প্রয়োজন। যদি এই ‘কেন’র সঠিক উত্তর না পাওয়া যায়, তাহলে শুধু শুধু কতগুলো জীবন নষ্ট করার জন্য মালিক বনে যাওয়ায় কারণ দেখি না। অনেক পত্রিকা এবং টিভি চ্যানেলের ভিড়ে আমার পত্রিকা বা চ্যানেল মানুষ পড়বে কিনা, দেখবে কিনা তা নিয়ে যদি একটি বাজার-সমীক্ষা না করা হয়, তাহলে একেবারেই এমন প্রকাশনার প্রয়োজন নেই।

বাজার-সমীক্ষা ছাড়া মিডিয়ায় ব্যবসা-সাফল্য আসবে না। শখের বশে মিডিয়ার মালিক হয়ে সংবাদকর্মীদের জীবন নষ্ট না করাই ভালো।


লেখক: গল্পকার ও যোগাযোগ পেশায় নিয়োজিত

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
টিভিতে আজকের খেলা (২৫ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৫ এপ্রিল, ২০২৪)
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ