X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অনিয়ম, দুর্নীতি কি চলবেই?

রেজানুর রহমান
২৮ ডিসেম্বর ২০২১, ১৬:১৬আপডেট : ২৮ ডিসেম্বর ২০২১, ১৬:১৬
রেজানুর রহমান বিপদ বলে কয়ে আসে না এ কথা ঠিক। কিন্তু আমরা অনেকে জেনে বুঝেও বিপদ ডেকে আনি। কর্তব্যে অবহেলা করেও বিপদকে আহ্বান জানাই। বিপদ যখন আসে তখন আমরা অনেকে শিয়ালের ডাকের মতো সমস্বরে ‘হুক্কা হুয়া, হুক্কা হুয়া’ বলতে শুরু করি। প্রচার মাধ্যমে হৈ চৈ শুরু হয়ে যায়। তারপর হঠাৎই হৈ চৈ, শোরগোল থেমে যায়। যেন কিছুই হয়নি। আসাদ চৌধুরীর কবিতার ভাষায় খাচ্ছি, দাচ্ছি, ঝাঁকের কই ঝাঁকে মিশে যাচ্ছি...।

এই মুহূর্তে দেশে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা হলো মাঝ নদীতে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ড। ভয়াবহ এই অগ্নিকাণ্ডে এ পর্যন্ত ৩৮ জনের করুণ মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আগুনে পুড়ে কাঠ কয়লার আকার পেয়েছে সবাই। স্বজনরাও তাদের চিনতে পারছেন না। ওই লঞ্চের অসংখ্য যাত্রী এখনও নিখোঁজ রয়েছেন। লাশ শনাক্ত করতে না পারায় ২৭টি লাশের গণকবর দেওয়া হয়েছে বরগুনায়। ওই লঞ্চে ত্রুটি পেয়েছে তদন্ত কমিটি। ইঞ্জিন রুম থেকেই লঞ্চে আগুন লেগেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক খবর হলো, লঞ্চটি যে মাস্টারের অর্থাৎ চালকের চালানোর কথা ছিল তিনি ওই রাতে লঞ্চে ছিলেন না। তার পরিবর্তে লঞ্চটি চালাচ্ছিলেন অন্য একজন। আমরা এতদিন মূল চালকের পরিবর্তে হেলপার দিয়ে সড়ক পথের বাহন চালানোর ঘটনা দেখেছি। এখন নদী পথেও একই ঘটনার প্রকাশ্য প্রমাণ পাওয়া গেলো। অর্থাৎ দেশের সড়ক পথের মতো নৌপথও নিরাপদ নয়। নৌপথেও কেউ আইনের ধার ধারে না। যদি তা না হতো তাহলে মূল চালকের পরিবর্তে অন্য চালক লঞ্চটি চালাতো না। আগুন ধরার পরও চালক নাকি অন্য লঞ্চের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জন্য লঞ্চের গতি বাড়িয়ে দিয়েছিল এমন অভিযোগও পাওয়া গেছে। সবচেয়ে ভয়ংকর তথ্য হলো, লঞ্চটি ছাড়ার আগে বিআইডব্লিউটিএ যে ‘চেক লিস্ট’ করেছিল তাতে উল্লেখ আছে ‘লঞ্চে কোনও ত্রুটি নাই’। অথচ তদন্ত কমিটি বলছে লঞ্চে ত্রুটি আছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়ে লঞ্চটিতে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন নতুন ইঞ্জিন লাগানো হয়। অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রও ছিল না। ফলে পরিস্থিতি যখন ভয়াবহ আকার ধারণ করে তখন লঞ্চের চালক ও কর্মচারীরা প্রাণ বাঁচাতে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে লঞ্চ থেকে পালিয়ে যায়।

দৃশ্যটা কল্পনা করুন তো একবার। গভীর রাত। কয়েক শত যাত্রী লঞ্চে যার যার মতো ঘুমে প্রায় অচেতন। হঠাৎ দেখলো লঞ্চে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। এ সময় লঞ্চের কর্মকর্তা কর্মচারীদের উচিত ছিল যাত্রীদের অভয় দেওয়া এবং যত দ্রুত সম্ভব লঞ্চটিকে পাড়ে ভিড়িয়ে নেওয়া। অথচ সেটা না করে তারা প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে গেছে। ফলে একদল অসহায় মানুষ নদীর মাঝখানে আগুনে পুড়ে কয়লা হয়ে গেলো। তাদের অনেকের পরিচয়ও মেলেনি। কাঠ কয়লার শরীর নিয়ে গণকবরে ঠাঁই হয়েছে তাদের। কী নিষ্ঠুর, কী নির্দয় ঘটনা। এ জন্য শেষ পর্যন্ত দোষী ব্যক্তিরা কি শাস্তি পাবে?

এই লেখাটি যখন লিখছি তখনই দেশের অধিকাংশ দৈনিক সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি ছবি দেখে শুধু অবাক নয়, বিস্মিত হলাম। নারায়ণগঞ্জ শহরে ১নং রেলগেট সংলগ্ন রেলক্রসিংয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটি বাসকে ধাক্কা দেয় ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা একটি ট্রেন। এর ফলে দু’জন নিহত ও কয়েকজন আহত হয়েছে। এটিকে কি আমরা নিছক দুর্ঘটনা বলবো? দুর্ঘটনার ওপর কারও নিয়ন্ত্রণ থাকে না। কিন্তু রেলক্রসিংয়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা বাসকে যেভাবে একটি ট্রেন ধাক্কা দিলো এটা  কি দুর্ঘটনার মধ্যে পড়ে? একটি ট্রেন তার নিজস্ব গতিতে রেললাইন দিয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক। সেখানে রেলক্রসিংয়ে বাস ঢুকবে কেন? বাসের জন্য কি একটি ট্রেন দাঁড়িয়ে যাবে নাকি বাসটিই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করবে? উপরন্তু রেলক্রসিং ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারী আছে। তার বা তাদের ভূমিকা কী? প্রায়শই রেলক্রসিংয়ে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে। দুই একদিন দুর্ঘটনা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়। অপরাধীর কিছুই হয় না। বরং অপরাধীর দৌড়-ঝাঁপের ফলে একসময় সবকিছুই আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়।

কক্সবাজার দেশের অন্যতম পর্যটন এলাকা। পর্যটনকে জনপ্রিয় করার প্রথম শর্ত হলো পর্যটকদের নিরাপত্তা বিধান করা। সম্প্রতি কক্সবাজারে একজন নারী পর্যটককে ধর্ষণের ঘটনা শুধু দেশে নয়, গোটা বিশ্বে নেতিবাচক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অপরাধীদের ব্যাপারে উপযুক্ত প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তারা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়িয়েছে। আশার কথা, এই অপরাধের মূলহোতাসহ ৪ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এখন দেখার বিষয় এই গ্রেফতারের ঘটনা শুধু আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয় কিনা। কারণ, অপরাধের মূলহোতা নাকি এলাকায় বেশ প্রভাবশালী। সরকারি ছাত্র সংগঠনের সঙ্গেও নাকি তার গভীর সখ্য রয়েছে। ফলে তার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যাপারে অনেকেই সন্দিহান।

কক্সবাজারের পর্যটন ব্যবস্থাকে আরও জনপ্রিয় করতে হলে এলাকার পরিবেশের উন্নয়ন জরুরি। পর্যটকদের নিরাপত্তার বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এলাকার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত না করা গেলে পর্যটনের কাঙ্ক্ষিত সুফল পাওয়া দুরূহ হয়ে দাঁড়াবে।

দেশের চতুর্থ ধাপের ইউপি নির্বাচন শেষ হয়ে গেলো। বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন অনেকে। অর্থাৎ দলীয়ভাবে প্রতীক পাওয়ার পর অনেক প্রার্থীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামতে হয়নি। এই যে বিনা ভোটে নেতারা নির্বাচিত হলেন তারা কি সঠিকভাবে দায়-দায়িত্ব পালন করবেন? বাংলাদেশে যেকোনও নির্বাচন মানেই এক ধরনের উৎসব। জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচন মানে তো জনতার মহোৎসব। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে নির্বাচন মানেই পেশিশক্তির দাপট গুরুত্ব পাচ্ছে। ফলে জাতীয় নির্বাচনের ব্যাপারে জনগণের আগ্রহ, আস্থা ও ভরসার জায়গাটা নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থা নিশ্চয়ই একটি উন্নয়নকামী দেশের জন্য মঙ্গলজনক নয়।

দেখতে দেখতে ইংরেজি ২০২১ সাল শেষ হতে চললো। আমাদের দেশের জন্য বিদায়ী এই বছরটি ইতিহাস হয়ে থাকবে। কারণ, ২০২১ সাল ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছর। একই সঙ্গে স্বাধীনতার মহান স্থপতি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বছর পালিত হলো এই ২০২১ সালে। এই বছরই দৃশ্যমান হয়েছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু, ঢাকার মেট্রোরেল, চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু টানেলসহ আরও অনেক উন্নয়ন অবকাঠামো। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় আরও বদলে যাবে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। কিন্তু উন্নয়ন অগ্রযাত্রা রক্ষার প্রথম ও প্রধান শর্ত হলো ন্যায়নিষ্ঠ পরিবেশ, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ও দেশপ্রেমিক মানুষের আন্তরিক ভূমিকা। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, ৫০ বছরেও দেশে সেই অর্থে ন্যায়নিষ্ঠ পরিবেশ তৈরি করতে পারিনি আমরা। আমাদের দেশপ্রেমিক প্রিয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দেশটা আলোর পথে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে সীমাহীন দুর্নীতি ও অনিয়ম। কাজেই এ ব্যাপারে মানসিক দৃষ্টিভঙ্গির বদল প্রয়োজন। দেশের স্বার্থে আমি বা আমরা অন্যায়, দুর্নীতি করবো না। অন্যকেও অন্যায়, দুর্নীতি, অনাচার করতে দেবো না। এই হোক আগামী বছরে আমাদের সমবেত অঙ্গীকার। দেশকে ভালোবেসে আসুন ভালো থাকি সবাই।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো।
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
তীব্র গরমে সিল্কসিটি ট্রেনে আগুন
তীব্র গরমে সিল্কসিটি ট্রেনে আগুন
দ্বিতীয় বিয়ে করায় স্বামীর অঙ্গহানি করলেন স্ত্রী
দ্বিতীয় বিয়ে করায় স্বামীর অঙ্গহানি করলেন স্ত্রী
প্রচণ্ড গরমেও ভোটকেন্দ্রে ভোটার, ভোটদানের হার ৬১ শতাংশ
ভারতে দ্বিতীয় দফায় ভোটপ্রচণ্ড গরমেও ভোটকেন্দ্রে ভোটার, ভোটদানের হার ৬১ শতাংশ
‘খেলাধুলার মাধ্যমে বেড়ে ওঠা ব্যক্তিরা দ্রুত নেতৃত্ব দিতে সক্ষম’
‘খেলাধুলার মাধ্যমে বেড়ে ওঠা ব্যক্তিরা দ্রুত নেতৃত্ব দিতে সক্ষম’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ