X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

আমার ‘আমি’ হয়ে ওঠার ঋণ স্বীকার

নিরুপমা রহমান
১২ জানুয়ারি ২০২২, ২০:২৯আপডেট : ১২ জানুয়ারি ২০২২, ২০:২৯

নিরুপমা রহমান যদি বলি আমার জীবনের অধিকাংশ সময়ই কেটে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে – তাতে একবিন্দুও ভুল বলা হবে না। আমি প্রায়ই আমার ছাত্রদের বলি যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের এক প্রবল আকর্ষণশক্তি আছে, এক অদ্ভুত মায়া আছে; এর প্রেমে যে একবার মজেছে, তার আর মুক্তি নেই। খুব কৌতুকের স্বরেই বলি কথাটা, নানান দেশ থেকে আসা ছাত্ররাও ভারি আনন্দ পায় শুনে, কিন্তু এ কথাটার মাঝে এক গভীর উপলব্ধি নিহিত আছে, যা একান্ত আমার নিজস্ব।

দেশের সীমানা পেরিয়ে অন্য দেশে এসে, কিংবা আজন্ম চেনা সংস্কৃতির ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে বহুমাত্রিক সংস্কৃতির বলয়ে পৌঁছেও, সুদীর্ঘ ‘কুড়ি বছরের পার’ করেও এ বোধ শুধু দৃঢ় থেকে দৃঢ়তরই হয়েছে, বিন্দুমাত্র সংশয় জন্মায়নি মনে কখনও এই বিষয়ে।

এই যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরের প্রতি গভীর ভালোবাসা, প্রগাঢ় মমতার সূত্রপাত কিন্তু বহু আগে, সেই শৈশবে। দিনক্ষণ মনে নেই, মনে থাকবার কথাও নয়। কিন্তু এটা খুব স্পষ্ট করেই মনে আছে যে স্কুলে যাবার ঠিক আগেই ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ নামক প্রতিষ্ঠানকে এর প্রাতিষ্ঠানিকতার বাইরে গিয়ে ভালোবাসতে শিখেছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস দেখে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গল্প শুনে, এর কৃতী ছাত্রদের সম্পর্কে জেনে আর এর শিক্ষকদের সম্পর্কে পড়ে বা শুনে।

আশৈশব ঢাকা শহরে বড় হয়ে ওঠা আমার চোখে দেখা প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। জীবনের প্রথম স্কুলটাও ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতেই। তাই কেন যেন আমার কাছে ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ শব্দটার সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল সেই কোন ছোটবেলাতেই। সেই নার্সারি ক্লাস পড়ুয়া আমি স্কুলে যাবার সময় যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার ভেতর দিয়ে যেতাম, তখন মনে মনে স্বপ্নের জাল বুনতাম এই ভেবে যে একদিন সেখানকার ছাত্রী হবো আমি।    

বাবা আর এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই প্রাক্তনী মায়ের হাত ধরে কবে যে প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে গেছি, মনেও পড়ে না আজ। কী সুন্দর তার ক্যাম্পাস। মনে হতো ঢাকা শহরের ঠিক মাঝখানটা জুড়ে আছে সেই ক্যাম্পাস,  যেখানে কান পাতলে ঠিক যেন শহরটার হৃৎস্পন্দন শোনা যাবে।  তারপর ঠিক কবে  আর কখন কলাভবন, কার্জন হল, চারুকলা, রোকেয়া হল, টিএসসি খুব চেনা কিছু জায়গা হয়ে উঠলো তা নিজেরই মনে নেই। বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে যখন এই বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে বাবা মায়ের কাছে কিংবা পরিচিতজনদের কাছে শোনা হলো, নানান বইয়ে কিংবা পত্রিকায় পড়া হলো, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু আমার চিরচেনা, চোখে দেখা প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হয়েই থাকলো না, হয়ে উঠলো আমার গর্বের অংশ, বাঙালি হিসেবে আমার অহংকারের নামান্তর। নার্সারি ক্লাসে পড়া যেই আমি একদিন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চাইতাম, কারণ এর বিশালতা আমাকে টানতো আর বিশ্ববিদ্যালয় বলতে তখন তো একেই বুঝতাম; সেই আমিই কৈশোরে পা দেবারও আগে নিশ্চিত করে ভেবে নিলাম এখানে একদিন পড়তেই হবে এই অহংকারের ইতিহাসের অংশ হতে। এই যে বিশ্ববিদ্যালয়কে কেবল উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান না ভেবে, অস্তিত্বের অংশ বা গর্বের সম্পদ বলে ভাবা যেতে পারে সেই বোধও আমার তৈরি হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরেই বেশ ছোটবেলাতেই এই বিষয়ে তাত্ত্বিক কোনও জ্ঞান জন্মাবার আগেই। তাই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আমার মনন তৈরির ঋণ, মানস সৃষ্টির ঋণ।

আর সেই মনন আর মানস থেকেই জানি আর মানি যে হতে পারে বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান অর্জন, জ্ঞান নির্মাণ আর বুদ্ধিক চিন্তাচেতনা সৃষ্টির সূতিকাগার কিন্তু এটা শুধু শ্রেণিকক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে পঠন-পাঠের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, আর কোনও পরীক্ষা পাস বা সনদ প্রাপ্তি তা নিশ্চিতও করে না। এখন যখন পৃথিবীর অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা আর গবেষণার কাজ করতে গিয়ে দেখি সেই ১৮৫২ সালে ব্রিটিশ বিদ্বজন হেনরি নিউম্যান থেকে শুরু করে তাবড় তাবড় সব শিক্ষাবিদ আর গবেষক এই ভাবনার প্রতিধ্বনিই করেছেন তাঁদের কাজে, তাঁদের লেখায়; তখন মনে মনে চিন্তা করি আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে অযুত সীমাবদ্ধতার মাঝেও তার  শত বছরের ইতিহাসে বাঙালির স্বতন্ত্র কিন্তু অনন্যমাত্রিক আত্মপরিচয় গড়ে তুলবার পীঠস্থান হয়ে উঠেছে। সেখানে নানান মতের দ্বন্দ্ব যেমন আছে, তেমনি সেই জ্ঞানজাগতিক দ্বন্দ্ব আর পারস্পরিক সাংঘর্ষিক ভাবনাপ্রসূত জ্ঞানের মিথস্ক্রিয়ায় নতুন নতুন জ্ঞান, বুদ্ধিক চিন্তাচেতনার জন্ম হয়েছে নানান ক্রান্তিকালে, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বাঙালিকে দিশা দেখিয়েছে বারবার।

এই যে সীমিত সম্পদ, সীমাহীন সমস্যাকে তুচ্ছ জ্ঞান করে শুধু সপ্রাণ তারুণ্যের দুর্মর শক্তি, মেধাবিকাশের প্রগাঢ় অভিলাষ, ‘জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার, তবু মাথা নোয়াবার নয়’ তেজোদীপ্ত মনোবৃত্তিকে ভিত্তি করে একটি বিশ্ববিদ্যালয় একটি জাতির শুধু জ্ঞানচর্চার পীঠস্থান নয় বরং আত্মপরিচয়ের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে পারে, এই ভাবনাটা আমাকে ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ নামক প্রতিষ্ঠানকে সম্মান করতে শিখিয়েছে, তার প্রাতিষ্ঠানিকতার বেড়াজাল ছাপিয়ে তার মৌলিক মূল্যবোধে বিশ্বাস রাখতে শিখিয়েছে। বাংলাদেশে এবং দেশের বাইরে আমার গত একুশ বছরের শিক্ষকতা জীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দেখে জন্মানো এই প্রতীতী, এই উপলব্ধি আমাকে কঠিন কাজ হাতে নিতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার মতো ধনী দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নানান নতুন উদ্যোগের শুরুতে যখনই আমার সহকর্মীরা সম্ভাব্য নানান বাধাবিপত্তির কথা ভাবতে বসেন, ঠিক তখনই আমার ভাবনাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদাহরণ মনে আসে। তখন আর কোনও বাধাকেই বাধা মনে হয় না বরং নিজে সাহস করি, অন্যদের সাহস দেই চ্যালেঞ্জ নিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বোধকরি আমাদের এই ‘ঘুরে দাঁড়াবার শিক্ষাটা’ খুব মনেপ্রাণে গেঁথে দিয়েছে। তাই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে রয়েছে আমার নিজেকে বিশ্বাস করতে শেখার ঋণ, নিজের শক্তিতে বিশ্বাস রাখবার শিক্ষার ঋণ, ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য আর উচ্চ যেথা  শির’ রেখে মুক্তজ্ঞানচর্চায় বিশ্বাস রাখতে শেখার ঋণ।

আমার ধারণা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পর থেকে গত একশ’ বছরে এই মুক্তজ্ঞানচর্চার উৎসাহ কিংবা আপন বলে বলীয়ান হবার প্রেরণা অর্পিত হয়েছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে খুব সাবলীলতায়, স্বভাবগত অভ্যাসে। এর পেছনে এক বিরাট ভূমিকা আছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের। আসলে অধিকাংশ শিক্ষকই যেহেতু একসময় এখানকার ছাত্র থাকেন, তাই তাঁরা যেন খুব ভালো করেই ছাত্রদের মনন আর মানসের ধমনীস্পন্দন অনুভব করতে পারেন। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, শিক্ষক হিসেবে নিযুক্তি পাওয়ার পরেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অন্তরমহলে তাঁদের নিজস্ব অনন্য ছাত্রসত্তাটা বিলুপ্ত হয় না। তাই গত একশ’ বছরেও এই বিশ্ববিদ্যালয় তার তারুণ্য, তার সতেজ সপ্রাণ অস্তিত্বকে হারায়নি, হারাতে পারেনি। খুব অল্পদিন এখানে শিক্ষকতার সময় আমার এই অনুভব আরও দৃঢ়তর হয়েছে।

কী সব শিক্ষকদেরই না নিজের করে পেয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়! এই শিক্ষকেরা একদিকে যেমন তাঁদের গভীর প্রজ্ঞা, পাণ্ডিত্য ও গবেষণার দ্বারা নিত্যনতুন জ্ঞানজাগতিক বোধ বা সামাজিক মূল্যবোধেরই জন্ম দিয়েছেন, অন্যদিকে কৃষিভিত্তিক গ্রামনির্ভর একটি জাতিকে আপন আলোয় নিজেকে চেনার পথ তৈরি করবার রাস্তা দেখিয়েছেন। সাধারণ ছা-পোষা বাঙালিকে নিজের আত্মপরিচয় তৈরি করবার মতো সাহসী চেতনাবোধেরও জন্ম দিয়েছেন। আবার প্রয়োজনে নিজেদের জীবন বাজি রেখে, কখনও হয়তো বা বিসর্জন দিয়েই নিজেদের ভূখণ্ডের হিস্যা বুঝে নিতেও পিছপা হননি।  আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার ছাত্রদের অবদান যেমন অনস্বীকার্য, আমি মনে করি সেই ছাত্রদের মনন আর মানস যেই শিক্ষকেরা, অধ্যাপকরা তৈরি করেছেন, তাঁদের ভূমিকাও বিন্দুমাত্র কম নয়। এসব শিক্ষক-অধ্যাপক ছিলেন বলেই না অমন সব উজ্জ্বল, তেজোদীপ্ত, স্বপ্নবাজ তরুণপ্রাণ ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এই ক্ষুদ্র ব-দ্বীপকে নিজের একটি পতাকা দেবার আন্দোলনে; বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক নেতৃত্বে, রবীন্দ্রনাথের লেখায় বিমূর্ত বাংলাদেশ নামক দেশটিকে বিশ্বমানচিত্রে প্রতিষ্ঠা করতে। পাকিস্তানি শাসক আর সেনাবাহিনী খুব বুঝেছিল এই শিক্ষকেরা, এই অধ্যাপকরা আমাদের জাতির মানসপুত্র, এঁরা যতদিন থাকবেন বাঙালির মুক্তচিন্তাচর্চা, বাঙালির মননশীলতার অভিযাত্রা স্তব্ধ হবে না। তাই একাত্তরে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ঠিক প্রাক্কালে পাকহানাদার বাহিনী চেয়েছিল এই ধীমান, মানসপুত্রদের হত্যা করে বাঙালিকে মানসিক আর আত্মিকভাবে বিকলাঙ্গ করে দিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে বাঙালির আত্মপরিচয়ের সূতিকাগার সেও তাদের অজানা ছিল না। পঁচিশে মার্চ রাতে প্রথম অতর্কিত হামলার শিকারও ছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকেরা। তাই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে রয়েছে আমার বাঙালি আত্মপরিচয়ের ঋণ, বাঙালি হিসেবে আমার আত্মশ্লাঘার ঋণ, আমার আজন্মলালিত বাঙালিয়ানা বোধের ঋণ।

সেই কোন শৈশবে মুনীর চৌধুরী, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, গোবিন্দ চন্দ্র দেব, রাশিদুল হাসান, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, আনোয়ার পাশার মতো অধ্যাপকদের কথা পড়ে, জেনে মনে হতে শুরু করলো বড় হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকই হতে হবে। বুঝি বা না বুঝি গোটা পত্রিকা গোগ্রাসে পড়বার তাড়না থেকে সেই পত্রিকার পাতা থেকেই পরিচয় হলো সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, কবীর চৌধুরী, আনিসুজ্জামান, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম (পরে তাঁকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি আর তাঁর কাছে আমার অযুত ঋণ, সে গল্প এখানে সংকুলান হবার নয়) – মনের ইচ্ছা, জীবনের লক্ষ্য আরও দৃঢ় হলো যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকই হতে হবে। আশৈশব চোখের সামনে উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে ছিলেন অধ্যাপিকা সনজীদা খাতুন। তাঁর কথায়, গানে, ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ আমি সেই কোন ছোটবেলাতেই তাঁকে আদর্শ মেনেছিলাম, আর মনে মনে তাঁর মতো হয়ে উঠবার স্বপ্ন দেখতাম। কীভাবে বাঙালিয়ানাকে ধারণ করে, গানকে যাপন করে ব্যক্তিত্বে, প্রজ্ঞায় উজ্জ্বল থাকা যায় তার মূর্তিময়ী উদাহরণ ছিলেন তিনি। শৈশব থেকে কৈশোরে গেছি সময়ের নিয়মে, ভালোলাগা – মন্দলাগার ভাবনাতে বদল এসেছে বয়সের চাহিদায় কিন্তু আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে জীবন কাটাবার ইচ্ছাতে ভাটা পড়েনি একফোঁটাও । পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, ফকরুল আলম, খোন্দকার আশরাফ হোসেন, কায়সার হক, কাশীনাথ রায়দের মতো শিক্ষকদের পড়াতে দেখে স্বপ্ন বুনতাম মনে মনে যে একদিন আমার ছাত্ররাও আমাকে এমন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনবে, তাদের ভাবনার জগতে আমার চিন্তার আলো পড়বে আর সেই আলোয় পথ হাঁটবো আমরা একসাথে। এমন শিক্ষক হতে পেরেছি কিনা জানিনা, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতাকেই পেশা আর নেশা হিসেবে জীবনে নিয়েছি। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে, তাঁর শিক্ষক অধ্যাপকদের কাছে রয়েছে আমার স্বপ্ন দেখতে শেখার ঋণ, আমার স্বপ্নপূরণের ঋণ।

আজ আমি দীর্ঘ কুড়ি বছর ধরে বাংলাদেশের বাইরে, অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন শহরে নতুন আবাস গড়েছি। এই শহর বিশ্ববিদ্যালয়ের শহর – আটটি বিখ্যাত, প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় আছে এই শহরে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের, বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরের প্রতি যে গভীর ভালোবাসা সেই কোনকালে তৈরি হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে, সেই ভালোবাসার জোরেই নতুন দেশে, নতুন এই শহরকে কবে যেন নিজের অজান্তেই ভালোবেসে ফেলেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে দেখেছি ছাত্রদের সবার ব্যক্তিগত বা সামাজিক পরিচয় সেখানে গৌণ। গ্রামের কৃষকের ছেলে আর শহুরে ক্ষমতাবান আমলার ছেলে অবলীলায় হয়ে ওঠে হরিহর আত্মা । শহরের নামজাদা অভিজাত মিশনারি স্কুলে পড়া কেতাদুরস্ত মেয়ে আর মফঃস্বলের সাধারণ লাজুক মেয়ে হয়ে উঠতে পারে প্রাণের বন্ধু।

জাত - ধর্ম – বর্ণ – সামাজিক পরিচয় সবকিছুর বেড়াজাল কাটিয়ে একই মাঠে বসে চলে প্রলম্বিত আড্ডা, যেখানে প্রাণ আছে, গান আছে, হুল্লোড় আছে, আছে সহমর্মিতা আর বিশ্বাসের শক্তি। স্বপ্ন বা লক্ষ্যে ফারাক থাকতে পারে কিন্তু তাতে আস্থা রাখায় ফারাক নেই, পারস্পরিক হাত বাড়ানোতে কুণ্ঠা নেই। এটাই তো সামুদয়িক শিক্ষার মূল কথা – যার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঘটিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আজ যখন এদেশে পড়াতে গিয়ে দেখি এঁরা বারবার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যবোধে এই সামুদয়িকতার কথা বলেন, উচ্চশিক্ষার সর্বজনীনতার কথা বলেন, তখন ভাবি,  এসব তাত্ত্বিক ও দার্শনিক বোধের মূর্তরূপের প্রকাশ তো আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই দেখেছি।

উচ্চশিক্ষাকে সুলভ, সহজলভ্য করে তুলবার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এখানেই আমি প্রথম দেখেছি কীভাবে শুধু সামুদয়িক, সর্বজনীন উচ্চশিক্ষার সুলভতা মানুষের জীবন বদলে দিতে পারে, কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন একজন মানুষকে স্বপ্ন দেখবার সাহস জোগায়, একটি সাদামাটা মানুষকে দৃঢ়চিত্ত, আত্মবিশ্বাসী কর্মী নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। তাই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আমার উচ্চশিক্ষার তাত্ত্বিক ও দার্শনিক জ্ঞানজাগতিকবোধে বিশ্বাস জন্মাবার ঋণ; সামুদয়িক, সর্বজনীন উচ্চশিক্ষার গবেষণায় নিজেকে ব্রতী করবার অভিলাষের ঋণ; সামগ্রিকভাবে ভবিষ্যতের যোগ্য, দৃঢ়চিত্ত, আত্মবিশ্বাসী কর্মী নাগরিক গড়ে তুলতে উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও আধুনিক করে তোলবার কর্মযোগে শামিল হবার স্পৃহার ঋণ।    

সবশেষে এক কথায় বলি, তোমার কাছে আমার ‘আমি’ হয়ে ওঠার অযুত অতল ঋণ। জয়তু প্রাণপ্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

 

লেখক: শিক্ষক, কলা ও সমাজবিজ্ঞান অনুষদ, মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়া; শাস্ত্রীয় সংগীতশিল্পী

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দ্বিতীয় বিয়ে করায় ছেলের আঘাতে প্রাণ গেলো বাবার
দ্বিতীয় বিয়ে করায় ছেলের আঘাতে প্রাণ গেলো বাবার
নুসিরাত শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি হামলা, শিশুসহ নিহত ৮
নুসিরাত শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি হামলা, শিশুসহ নিহত ৮
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
লাল কৃষ্ণচূড়া, বেগুনি জারুলে ছুঁয়ে যায় তপ্ত হৃদয়
লাল কৃষ্ণচূড়া, বেগুনি জারুলে ছুঁয়ে যায় তপ্ত হৃদয়
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ