নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের কাছে নাম চাইবে নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য গঠিত সার্চ কমিটি। এছাড়া বিশিষ্ট নাগরিক ও গণমাধ্যমের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সঙ্গেও বসবে কমিটি। উদ্দেশ্য পরিষ্কার – গ্রহণযোগ্য একটি ভালো কমিশন গঠন।
এর আগেও সার্চ কমিটির মাধ্যমে দুটি নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছিল। তবে এবার আইনের মাধ্যমে গঠিত সার্চ কমিটি কাজটি করছে। এতে যে আমরা একটি বিতর্কমুক্ত নির্বাচন কমিশন পেয়ে যাবো সেই নিশ্চয়তাও নেই। কারণ, আমাদের রাজনীতির ভিত্তিমূলে আছে শত্রু-মিত্র বিভাজন। গণতন্ত্রের প্রধানতম শর্ত অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। সেখানে রেফারির ভূমিকায় থাকে নির্বাচন কমিশন, যে পুরো খেলাটি পরিচালনা করবে শক্ত হাতে, শৃঙ্খলার মাধ্যমে। কিন্তু মাঠের খেলোয়াড়রা যদি দখলের সংস্কৃতিতে পারদর্শী হয়ে ওঠে তখন শক্তি প্রয়োগ করেও কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যায় না বা করার সাহস থাকে না।
কারণ হলো ব্যক্তির ওপর আস্থাহীনতা। এখন যে সার্চ কমিটি কাজ করছে তার সভাপতি আপিল বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। তিনি আগের অনুসন্ধান কমিটির একজন সদস্য ছিলেন। সেই অনুসন্ধান কমিটি নিয়ে বহু বিতর্ক। কমিটির আরেক সদস্য সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন। তার নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন অনেকে। কেননা, গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। ফলে কখনোই হয়তো এমন কমিশন আমরা পাবো না যারা বিতর্কমুক্ত থাকবেন। তবু প্রত্যাশা থাকে যে যারা আসবেন তারা শক্ত মেরুদণ্ডের হবেন এবং তাদের অন্তরাত্মায় ন্যায্যতার ভাবনা থাকবে একটি ভালো নির্বাচন করার জন্য।
দেশে বহু বছর ধরে চলছে বিভাজনের দাঙ্গাবাজির রাজনীতি। কে কাকে কখন বিনাশ করবে সেই রাজনীতি দেখে দেখে মানুষ আজ নির্বাচন নিয়ে আর কোনও পুলক অনুভব করে না। সম্প্রতি সমাপ্ত সাত ধাপের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে শতাধিক মানুষ খুন হয়েছে সহিংসতায়। রাজনীতিটা এমন এক জায়গায় গেছে যে প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ না থাকার পরও এমন সহিংসতা হলো একটা প্রান্তিক পর্যায়ের নির্বাচনে। একেই বলে অবক্ষয়িত সামাজিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কের পরিবেশ। এখানে একমাত্র প্রাসঙ্গিক কে কাকে শেষ করে দিতে প্রস্তুত আছে। যাদের কল্যাণের কথা বলে তারা রাজনীতি করেন সেই জনগণের জন্য প্রাপ্তি শেষ পর্যন্ত ত্রাস, আতঙ্ক, ভীতি, মৃত্যু আর হয়রানি।
দলাদলি শত্রু ও মিত্রের বিভাজনকে একটা নির্দিষ্ট চেহারা দেয়। আমরা আর ওরা’য় বিভাজিত রাজনীতি এমন এক অবস্থা সৃষ্টি করেছে যে এখানে সবকিছু পরিচালিত হয়ে আসছে বৈষম্যমূলক, পক্ষপাতমূলকভাবে, যার অনিবার্য পরিণতি সহিংসতা ও কট্টর বিভেদের নীতি। এখানে ব্যক্তির বা নাগরিকের অস্তিত্ব সীমিত, খণ্ডিত। হত্যা, বিরোধ, সংঘাতের এই পরিবেশে নাগরিকদের পরস্পরনির্ভরতা সম্ভব নয়। শত্রু-মিত্রের রাজনীতি তা হতেও দেয় না। তাই আমরা বলতে পারি দলাদলি, শত্রু-মিত্র, হিংস্রতা দেশে গণতন্ত্রের এক স্থায়ী পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। আমাদের শেষ যে কোথায় কেউ জানে না।
হত্যা, হুমকি, ভয় প্রদর্শন, সন্ত্রাস সবসময়ই আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে এক কার্যকর ও শক্তিশালী অস্ত্র। তথাকথিত গণতান্ত্রিক কাঠামোর মাধ্যমে এমন এক ব্যবস্থার প্রবর্তন, যেখানে নাগরিকদের কোনও শাস্তির ভয় ছাড়া হত্যা করা যায়, পঙ্গু করে দেওয়া যায়। রাজনীতি এখানে মানুষের জীবনকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে, মানুষের অস্তিত্ব ক্ষমতার সম্পর্কের লক্ষিত বস্তু হয়ে উঠেছে। নইলে কী করে এতগুলো মানুষের প্রাণ যায় একটি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে? সবাই নির্বিকার। কোথাও কোনও উদ্বেগ নেই, দুঃখ প্রকাশ নেই এতগুলো মানুষের প্রাণহানিতে, তাদের পরিবারগুলোর জন্যও কোনও শোক বার্তাও নেই।
হিংসা ও হিংস্রতার এমন রাজনৈতিক পরিসরে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সহজ কাজ নয়। যারাই দায়িত্ব নেবেন তারা জেনে বুঝে আসবেন যে এখনকার রাজনীতিতে উদারনৈতিক মতবাদের আর কোনও অস্তিত্ব নেই। অক্ষম বিচারব্যবস্থা, আজ্ঞাবহ আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা ও অনুপস্থিত নাগরিক সমাজ এখানে সৃষ্টি করেছে এমন এক লুম্পেনরাজ, যারা কোনোরকম আইন-কানুনের তোয়াক্কা করে না। সেরকম একটি পরিবেশে আমরা আবার সবাই আশা করছি যে খুব ভালো মানুষ আকাশ থেকে উড়ে এসে একটি অসাধারণ নির্বাচন করে ফেলবেন। আসলে আমাদের রাজনৈতিক গতি-প্রকৃতির বাস্তববাদী মূল্যায়ন করলে বড় প্রত্যাশা করা যায় না। এখানকার বিবদমান গোষ্ঠীর কোনও পক্ষেরই কোনও নৈতিক বাধ্যবাধকতা নেই। এই রাজনীতির একমাত্র নৈতিকতা হলো, শত্রুকে কোনও ছাড় নয়। তাকে শেষ করে দিতে পারলে সবচেয়ে ভালো। শত্রুর হত্যাই হলো সবচেয়ে বড় জয়।
এমন বাস্তবতাতেই সৎ, যোগ্য, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনারদের খুঁজে বের করার জন্য অনুসন্ধান কমিটি দায়িত্ব হাতে নিয়েছে। সবাই বলছেন, সৎ, দক্ষ, প্রজ্ঞাবান ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠনের বিকল্প নেই। কিন্তু সেই মানুষ কোথায়?
লেখক: সাংবাদিক