X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

কার নাম প্রস্তাব করবে অনুসন্ধান কমিটি?

এরশাদুল আলম প্রিন্স
১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৭:২১আপডেট : ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৭:২১

এরশাদুল আলম প্রিন্স নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন ২০২২ পাস হয়েছে। আইন অনুযায়ী সার্চ কমিটিও গঠন করা হয়ে গেছে। সার্চ কমিটি এখন রাষ্ট্রপতির কাছে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য কমিশনারদের নাম প্রস্তাব করবে। ১৪ ফেব্রুয়ারি (সোমবার) সার্চ কমিটি ৩২২ জনের একটি তালিকা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে প্রকাশ করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই ৩২২ জন থেকে সার্চ কমিটি এখন কাদের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে প্রস্তাব করবে। এখানে আরেকটি প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ, এই ৩২২ জনের নাম কোন কোন দল প্রস্তাব করেছে।

এ দুই প্রশ্নের উত্তর জনগণ হয়তো কখনও জানতে পারবে না। তবে, কোন দল কাকে প্রস্তাব করেছে সেটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সার্চ কমিটি রাষ্ট্রপতির কাছে কাদের নাম প্রস্তাব করবে সেটি প্রকাশ করা।

১৪ ফেব্রুয়ারি নুরুল হুদা কমিশনের মেয়াদ শেষ হয়েছে। তার আগেই রাষ্ট্রপতি কর্তৃক কমিশনার নিয়োগ হওয়ার কথা। কিন্তু সময় পার হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত কমিশনার নিয়োগ দেওয়া হয়নি। সার্চ কমিটি ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ নিয়ে কাজ করছে।

আইন প্রণয়নের জন্য রাজনীতিক ও সুশীল সমাজের দাবি অনেক পুরনো। কিন্তু জনদাবি তারচেয়েও বেশি কিছু। আসল জনদাবি একটি সুষ্ঠু নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠা, যারা স্বাধীনভাবে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্পন্ন করতে সক্ষম হবে। আইন জনগণের সে ইচ্ছা পূরণ করতে পারবে কিনা এখন সেটাই দেখার বিষয়। প্রবাদ আছে, জনগণের ইচ্ছাই আইন। কিন্তু এখানে আইনে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন থাকে না। আইন এখানে সার্বভৌমের ইচ্ছা।

আইন অনুযায়ী সার্চ কমিটি আইনসিদ্ধ হলেও রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে এই কমিটি কতটা গ্রহণযোগ্য হলো সে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তি হিসেবে সার্চ কমিটির সদস্যরা কে কেমন তার চেয়েও বড় বিষয় তারা শেষমেশ রাষ্ট্রপতির কাছে কাদের নাম সুপারিশ করে। তবে, সবচেয়ে বড় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কমিশন কেমন হবে ও সেই কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবে কিনা।

আইন অনুযায়ী ছয় সদস্যের একটি ‘সার্চ কমিটি’ গঠন করা হয়েছে, যারা হচ্ছেন– বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি মনোনীত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন বিচারক ও হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারক, কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল, পিএসসির চেয়ারম্যান এবং রাষ্ট্রপতি মনোনীত দু’জন বিশিষ্ট নাগরিক। আপিল বিভাগের বিচারপতি কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।

প্রধান বিচারপতি কর্তৃক মনোনীত আপিল বিভাগের বিচারপতি হচ্ছেন ওবায়দুল হাসান ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এসএম কুদ্দুস জামান। এছাড়া মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মুসলিম চৌধুরী, সরকারী কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন। রাষ্ট্রপতি মনোনীত করেছেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন ও কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক আনোয়ারা সৈয়দ হককে।

এখন কথা হচ্ছে, সার্চ কমিটির ৬ সদস্যের ৪ সদস্যই পদাধিকার বলে সরকারি কর্মচারী। বাকি দুজন রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মনোনীত। কাজেই এটা বলাই যায় যে সার্চ কমিটির ৬ সদস্যই সরকারের মনোনীত ও নিয়োগকৃত। এটাই আইনের বিধান। এছাড়া এসব গুরুত্বপূর্ণ পদে সরকারের অনুরাগভাজনরাই আসীন হয়ে থাকে। এটা দোষের কিছু নয়। সব সরকারই তা করে। তাদের যোগ্যতা নিয়েও কোনও প্রশ্ন নেই। কিন্তু সবচেয়ে বড় যোগ্যতা যেখানে সরকারের প্রতি আনুগত্য, সেখানে তারা নিরপেক্ষ লোককে কমিশনার নিয়োগের সুপারিশ কেন করবেন? কাজেই, এই অনুরাগভাজনরা নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের সার্চ কমিটির সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দিয়ে নিজেরা সরকারের বিরাগভাজন হবেন, সেটা ভাবলে ভুল হবে। যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক, বিষয়টি এমনই হবে। কাজেই, ৩২২ জন থেকে অনুরাগভাজনদের খুঁজে বের করাই সার্চ কমিটির কাজ হবে বলে মনে হয়।

আইন অনুযায়ী সরকারের অনুরাগভাজনদের নিয়োগদানে পরামর্শ দিতে সার্চ কমিটির কোনও বাধা নেই। তবে ৩২২ জনের মধ্যে একজন নুরুল হুদা খুঁজে পাওয়া এতটা সহজ নাও হতে পারে।

আইনে বলা আছে, সার্চ কমিটি স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করে দায়িত্ব পালন করবে। কিন্তু স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার নীতিটি কীভাবে অনুসরণ করা হবে সেটিই প্রশ্ন। সংবিধানে তো বলা আছে, ‘নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন এবং কেবল এই সংবিধান ও আইনের অধীন হইবেন [অনুচ্ছেদ ১১৮(৪)]।’ কিন্তু আজিজ, রকিবুদ্দিন বা নুরুল হুদা কমিশনের মতো স্বাধীন কমিশনের ভূমিকা তো জাতি দেখেছে। স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতা মাপার কোনও বাটখারা নেই। তাই আইনে এসব ভালো ভালো কথা থাকা বা না থাকা সমান কথা। সে কারণেই বিদায়ী নুরুল হুদা মোটেও বিব্রত নয়। তিনি আইন অনুযায়ী তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি পদের ‘হক আদায়’ করেছেন। জনগণের ‘হক আদায়’ করা তার কাজ না।

আইনের ৪(২) ধারায় বলা আছে, অনুসন্ধান কমিটি ‘রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী সংগঠনের নিকট হইতে নাম আহ্বান করিতে পারিবে।’ সেখান থেকেই ৩২২ জনকে পাওয়া গেছে। যদিও রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী সংগঠন কাদের নাম প্রস্তাব করেছে, বা সার্চ কমিটি কাদের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে প্রস্তাব করেছে সে বিষয়টি প্রকাশ করার কোনও বাধ্যবাধকতা আইনে নেই। এ বিষয়ে সার্চ কমিটি একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করলে স্বচ্ছতার বিষয়টি কিছুটা হলেও নিশ্চিত হতো।

আইনে বলা হয়েছে, সার্চ কমিটি প্রার্থীদের যোগ্যতা, অযোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, সততা ও সুনাম বিবেচনা করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনারদের নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করবে। যোগ্যতা, অযোগ্যতার বিষয়টি প্রস্তাবিত আইনে বলা আছে। সার্চ কমিটি সেগুলো বিবেচনা করেই কমিশনারদের নাম প্রস্তাব করবে। কিন্তু এখানেও সেই একই প্রশ্ন– সততা ও সুনাম ঠিক করার মাপকাঠি কী? একজন লোক ঘুষ না খেলেই কি আমানতদার হতে পারেন? বড় পদে চাকরি করলেই কি সবার মেরুদণ্ড থাকে? বয়স ৫০ হলেই কি সবাই অভিজ্ঞ হয়? ২০ বছর কাজ করলেই কি সবার মেরুদণ্ড শক্ত হয়? মেরুদণ্ড থাকলেই কি সবাই নিরপেক্ষ হয়?

যোগ্যতা-অযোগ্যতা এক জিনিস আর দায়িত্ববোধ ও আমানতদারিতা আরেক জিনিস। দায়িত্ববোধ ও আমানতদারিতা থাকলে কারও দায়মুক্তি লাগে না। দুর্নীতি, দায়িত্বহীনতা ও আমানতের খেয়ানত করলে দায়মুক্তি লাগে। প্রস্তাবিত আইনেও দায়মুক্তির বিধান রয়েছে। সবকিছু ‘বৈধ ছিল বলিয়া গণ্য হইবে’ বললেই সবকিছু বৈধ হয়ে যায় না, ‘আদালতে কোনও প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না’ বললেই আদালতের দরজা বন্ধ হয়ে যায় না। এতে আপাত দৃষ্টিতে আসামিরা স্বস্তি পেলেও ফরিয়াদিরা সবকিছু ভুলে যান না। আইনে দায়মুক্তির বিধান থাকলেও, শাপমুক্তির বিধান থাকে না।

সার্চ কমিটি কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পেরেছে সেটি আমাদের জানা নেই। তবে আপিল বিভাগের সাবেক এক জ্যেষ্ঠ বিচারপতি আবদুল মতিন, যিনি দুদক, মানবাধিকার কমিশন ও তথ্য কমিশনের নিয়োগ সংক্রান্ত সার্চ কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি বলেছেন, সার্চ কমিটির চেয়ারম্যান বা সদস্যদের করার তেমন কিছুই থাকে না। কয়েকটি খামের মধ্যে ক্যাবিনেট ডিভিশন দ্বারা সরকারের পছন্দের কিছু ব্যক্তির জীবনবৃত্তান্ত ধরিয়ে দেওয়া হয়। এর বাইরে যাচাই-বাছাই করার কোনও সুযোগ থাকে না (প্রথম আলো, ২৩ জানুয়ারি ২০২২)। এটি আগের কথা। তবে অবস্থা যদি এখনও সেরকম থাকে তবে নুরুল হুদা বা আজিজের মতো কমিশন গঠিত হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

এদিকে বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী নবগঠিত সার্চ কমিটির চেয়ারম্যান, সদস্য ছহুল হোসাইন, কুদ্দুস জামান ও আনোয়ারা সৈয়দ হককে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে অভিযোগ করেছেন। বাকি দুই সদস্য সম্পর্কে তার মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে, বিএনপি মোটের ওপর সার্চ কমিটি গঠন তথা নতুন আইনটিকেই প্রত্যাখ্যান করেছে।

সার্চ কমিটির সদস্যরা সরকারি লোক সেটি তাদের পদেই প্রকাশিত। তারা রাষ্ট্রের দায়িত্বপূর্ণ পদে কাজ করছেন। দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কোনও বিষয় থাকলেও তারা যে নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে পারবে না, বিষয়টি সেরকম নয়। একটি শক্তিশালী নির্বাচন গঠনে তাদের সুপারিশ অন্ধকারেও পথ দেখাতে পারে। সদিচ্ছাই মুখ্য।

সংবিধান ও আইন অনুযায়ী আমাদের নির্বাচন কমিশন যথেষ্ট স্বাধীন। কমিশনের স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ ভূমিকা একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পূর্বশর্ত। যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে কমিশন গঠন হলে সেই কমিশনই পারে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে। আইন পাস করা সহজ, কিন্তু আইন দিয়ে নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করা কঠিন। আইন দিয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পন্ন করা আরও কঠিন।

অনুসন্ধান কমিটি চাইলে আগের মতো রকিবুদ্দিন কমিশন বা নুরুল হুদা কমিশনের মতো কমিশন গঠনের সুপারিশও করতে পারে। আবার চাইলে একটি শক্তিশালী কমিশন গঠনেরও সুপারিশ করতে পারে। অনুসন্ধান কমিটি ৩২২ জনের তালিকা থেকে এবার কাকে খুঁজবে, জাতি এখন সেটাই দেখার অপেক্ষায়।

 

লেখক: আইনজীবী ও কলাম লেখক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
নির্দেশের পরও হল ত্যাগ করছেন না চুয়েট শিক্ষার্থীরা, বাসে আগুন
নির্দেশের পরও হল ত্যাগ করছেন না চুয়েট শিক্ষার্থীরা, বাসে আগুন
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়, হাইকোর্টের রায় প্রকাশ
রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়, হাইকোর্টের রায় প্রকাশ
এক কোরাল ৩৩ হাজার টাকায় বিক্রি
এক কোরাল ৩৩ হাজার টাকায় বিক্রি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ