X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

ব্রিটেনে বিপন্নতার আবর্তে বাংলা

মুনজের আহমদ চৌধুরী
১৪ মার্চ ২০২২, ১৯:৪৬আপডেট : ১৪ মার্চ ২০২২, ১৯:৫২
মুনজের আহমদ চৌধুরী বাংলাদেশ পশ্চিমবঙ্গের বাইরে সবচেয়ে বেশি বাংলাভাষী মানুষের বাস ব্রিটেনে। সে কারণে ‘তৃতীয় বাংলা’ বলা হয় ব্রিটেনকে। সেই ‘তৃতীয় বাংলা’তেই এখন বাংলা ভাষার ঘোর দুর্দিন। ব্রিটেনে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রজন্মের মধ্যে বাংলা পড়তে-লিখতে পারে সক্ষমদের সংখ‌্যা গত ১০ বছরে নেমে আসছে প্রায় পাঁচ শতাংশেরও নিচে।

কারণ, আশির দশক থেকে গত ৩০ বছরে পূর্ব লন্ডনের বাঙালিপাড়া টাওয়ার হ‌্যামলেটসে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ৩০টি বাংলা কমিউনিটি স্কুল। এসব স্কুলে ব্রিটেনে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশি শিশুরা বাংলা ভাষায় লেখাপড়ার পাশাপাশি বাংলা সংস্কৃতি চর্চার সুযোগ পেতো। এসব স্কুলে ভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস সম্পর্কে পাঠদান হতো। অর্থ সংকটের কারণ দেখিয়ে গত বছর ২০২১ সালে টাওয়ার হ‌্যামলেটস কাউন্সিল তহবিল বন্ধ করে দিলে সবগুলো স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। লন্ডনের বাইরে বিভিন্ন শহরে সময়ে সময়ে খণ্ডকালীন বাংলা স্কুল প্রতিষ্ঠা হলে সেগুলোও স্থায়ীত্ব পায়নি।

ব্রিটেনে বাংলাদেশি ও ব্রিটিশ বাংলাদেশি মিলিয়ে ১০ লাখ বাংলাদেশি আছে। এ কমিউনিটিতে লন্ডনের ক‌্যামডেন, কার্ডিফ, বার্মিংহামের হাতেগোনা চার পাঁচটি খণ্ডকালীন বাংলা স্কুলে সব মিলিয়ে বড়জোর শ’খানেক শিশু বাংলা পড়া ও লেখা শিখছে। হাজার হাজার ব্রিটিশ বাংলাদেশি শিশুর জন‌্য মাতৃভাষায় শুদ্ধভাবে বলতে, পড়তে বা লিখতে শেখার কোনও প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগই থাকছে না।

ব্রিটেনে আশির দশকে জিসিএসই এবং এ লেভেলের পাঠ‌্যসূচি এবং পরীক্ষায় ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে বাংলাকে অর্ন্তভুক্ত করা হয়। সে সময় বছরে কয়েকশ শিক্ষার্থী বাংলায় পড়াশোনা ও পরীক্ষা দিলেও চলতি বছরে এ লেভেলে বাংলা বিষয়ে পরীক্ষার্থী ছিলেন মাত্র একজন।

আশির দশকে পূর্ব লন্ডনে কয়েকটি মূলধারার প্রাথমিক বিদ‌্যালয়ের নাম বঙ্গবন্ধু প্রাইমারি স্কুল, বঙ্গবীর ওসমানী প্রাইমারি স্কুল, কবি নজরুল স্কুল, শাপলা স্কুল নামে নামকরণ করা হয়। গত ৩০ বছরে পূর্ব লন্ডনে বাংলাদেশিদের জনসংখ‌্যা কয়েকগুণ বাড়লেও কোনও মূলধারার স্কুল বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম নতুন করে বাংলায় রাখার উদ্যোগ দেখা যায়নি। উল্টো কবি নজরুল স্কুল, ওসমানী স্কুলের নাম পরিবর্তনের জন‌্য শ্বেতাঙ্গরা দফায় দফায় কিছুদিন পর পর পিটিশন দিচ্ছেন। নাম বদলে দেওয়ার জন‌্য যথারীতি পাবলিক কনসালটেশনও হচ্ছে। ব্রিটেনে বাঙালির ঐতিহ্যের প্রধান প্রতীক আলতাব আলী পার্কের নাম পরিবর্তন করে পুনরায় সেন্ট মেরিজ পার্ক নামকরণের অপচেষ্টাও হয়েছিল।

এসব ইস‌্যুতে কমিউনিটির বর্ষীয়‌ান কয়েকজন জীবিত নেতা কবি নজরুল বা বঙ্গবীর ওসমানী স্কুলের নাম বহাল রাখার দাবিতে পাল্টা ক‌্যাম্পেইন করে, বাংলাদেশি অভিভাবকদের সচেতন করে সভা সমাবেশ আন্দোলন করে স্কুলগুলোর নাম টিকিয়ে রাখছেন।

বাংলাদেশের আলতাব আলী, ইসহাক, কুদ্দুসের রক্ত-প্রাণের বিনিময়ে সত্তরের দশকের শেষার্ধ ও আশির দশকে ব্রিটেনে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের পথ বেয়ে জনদাবির পরিপ্রেক্ষিতে টাওয়ার হ‌্যামলেটস কাউন্সিল ১৯৯৭ সালে পূর্ব লন্ডনের ব্রিকলেনের একটি ক্ষুদ্র এলাকার নামকরণ করে বাংলাটাউন। এই বাংলাটাউন নামটিও পরিবর্তন করার জন‌্য গত দুবছর বাঙালি বিদ্বেষী একটি পক্ষ নানামুখী তৎপরতা চালিয়েছে।

পূর্ব লন্ডনে আজ থেকে ১০ বছর আগেও বিপুলসংখ‌্যক বাড়িঘর আর ব‌্যবসার মালিক ছিলেন বাংলাদেশিরা। এখন পরিস্থিতি প্রায় পুরোটাই পাল্টে গেছে। বাংলাদেশিরা বাড়িঘর-ব‌্যবসা বিদেশি প্রতিষ্ঠিত ব‌্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে ছাড়ছেন বাঙালিপাড়া পূর্ব লন্ডন।

পূর্ব লন্ডনের রয়েল লন্ডন হাসপাতালে সারা ব্রিটেনের মধ্যে বাংলাদেশি চিকিৎসা সেবা প্রার্থীর সংখ‌্যা বেশি। এ হাসপাতালের পুরনো ভবনে বাংলায় সব নির্দেশনা থাকলেও নতুন ভবনে বাংলায় কোনও নির্দেশনা রাখা হয়নি। একইভাবে বিভিন্ন স্টেশন, স্থাপনা, ট্রেন টিকিটের মেশিন থেকে শুরু করে ড্রাইভিং পরীক্ষার থিওরি টেস্ট; এমন বহু ক্ষেত্রে আগে বাংলা ভাষার অপশন থাকলেও তা এখন অতীত।

ব্রিটেনে ভাষা হিসেবে এখন বাংলার জয়-জয়কারের নানা গল্পগাথা, আখ‌্যান আর উপাখ্যান লেখা হলেও নিরেট বাস্তবতা আসলে এমনই।

দুই.

আজ থেকে একযুগ আগে আমি বিলেতে আসার তিন দিন পর যোগ দেই সে সময়ের সর্বাধিক প্রচারিত বাংলা টাইমসে। তখন লন্ডন থেকেই ১২টি বাংলা পত্রিকা প্রকাশ হতো। দূরের শহরে, দোকানে দোকানে বাংলা পত্রিকা বিক্রি হতো। শুধু বাংলা টাইমসই ছাপা হতো প্রায় ১০ হাজার কপি।

এখন সেখানে মাত্র চারটি বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশ হয় লন্ডন থেকে। কোনও কোনোটার মূল‌্য লেখা থাকলেও বিভিন্ন মুদিমালের দোকানে পত্রিকার স্তূপ ফ্রি সংগ্রহের জন‌্য রাখা থাকে। বিনামূল্যের হলেও সপ্তাহ শেষে স্তূপ থেকে যায় পত্রিকার। পাঠক কমেছে। অনেকগুলো বাংলাদেশি টিভি স্টেশন বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ হয়ে গেছে ব্রিটেনের একমাত্র বাংলা রেডিও বেতার বাংলা। বাংলাদেশি বহুল বিভিন্ন শহরে খুব সামান‌্য কিছু দোকানপাটের নাম বাংলায় লেখা হলেও ব্রিটেনে জন্ম নেওয়া বর্তমান প্রজন্মের প্রায় ৯০ ভাগ তরুণ বাংলাদেশি বাংলায় পড়তে বা লিখতে পারেন না।

অনেক ক্ষেত্রে কর্মক্ষেত্রে সুবিধার বিবেচনায় ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদেরও বাংলার চেয়ে স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ ভাষা শেখাবার আগ্রহ বেশি। সুবিধার সমীকরণের বিবেচনায় এমন করেই মার খাচ্ছে মাতৃভাষা।

শিশুদের মসজিদে আরবি শিক্ষা ব্রিটেনের বাংলাদেশি মুসলিম কমিউনিটির অর্ধ-শতকের ঐতিহ্য। লন্ডনের বাইরে অনেক স্থানে পর্যাপ্ত শিক্ষক ও ছাত্রের অভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে মসজিদগুলোতে মক্তব বা কোরআন শিক্ষার কার্যক্রম।

তিন.

স্কটিশ আঞ্চলিক সংসদে একজন ও ব্রিটিশ সংসদে চার বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এমপি ব্রিটেনে বাঙালির সম্মানের প্রতীক। ব্রিটেনে ইউরোপের সর্ববৃহৎ বৈশাখী মেলার উদ্যোক্তাও বাংলাদেশিরা। বৈশাখী মেলা নাম হলেও দেশ থেকে আসা তারকা শিল্পীদের কনসার্টই মূল অনুষ্ঠান। সেখানে দর্শকদের অনুরোধে শিল্পীদের হিন্দি গানও গাইতে হয়।

লন্ডনে কিছুদিন ধরে বাংলা একাডেমির বইমেলা হয়। এখানকার লেখকরাও ফি-বছর বই লিখছেন। ছাপাছাপি, প্রকাশনা উৎসব চলছে দেশে-বিদেশে। তারপরও আশঙ্কার কথাটি হলো তৃতীয়, চতুর্থ প্রজন্মে এসে ব্রিটেনে বাংলাদেশিদের ঘরের ভেতরেই বাংলায় বা সিলেটি আঞ্চলিক ভাষাতেও কথা বলা কমে আসছে একেবারেই।

সন্তান বাংলা লিখতে বা পড়তে না পারায় বাংলাদেশে থাকা সহায়-সম্পদের ভবিষ‌্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন প্রবাসীরা। মাছ-ভাতের জায়গায় পিৎজা আর টেক-অ্যাওয়ে, সুশি স্থান করে নিয়েছিল আগেই। করোনার পর অনেক ঘরে রান্নাই বন্ধ হয়ে গেছে ফুড ডেলিভারির দাপটে। ব্রিটেনের বহু পাঠাগারে পাঠক না থাকায় উঠে যাচ্ছে বাংলা বইয়ের শেলফ। বাংলাদেশ থেকে নতুন আসা অভিবাসী আর শিক্ষার্থীদের হাত ধরেই এখন বিলেতে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চার ছোট্ট জায়গাটি আবর্তিত হচ্ছে।

চার.
১৯১৬ সালের ১ নভেম্বর লন্ডনের মিলফোর্ড লেন থেকে প্রকাশ হওয়া পাক্ষিক সত্যবাণীর পর বিলেতে বাংলা সাংবাদিকতার ১০৬ বছর কেটে গেছে। ভাষার মতো জীবন, সময় সবকিছু তার গতিপথ বদলায়।

ব্রিটেনে পুরো জীবন কাটিয়ে শুধু বাংলায় কবিতা লিখে যাওয়া আতাউর রহমান মিলাদ, আবু মকসুদ বা কাজল রশীদদের পর হয়তো আর ব্রিটিশ-বাংলাদেশি কোনও কবি হয়তো বিলেত থেকে বাংলায় কবিতা লিখবেন না।

বায়ান্ন, ঊনসত্তর, একাত্তরে ব্রিটেনের বাংলাদেশিরা বাংলা ভাষা আর বাংলাদেশের জন‌্য রেখে গেছেন গর্বের ইতিহাস। ব্রিটেনে বাংলাদেশিদের ইতিহাস আলতাব আলীদের রক্তে লেখা ইতিহাস।

ব্রিটেনে বাংলা আর বাংলাদেশিদের নিয়ে সত্তর দশক থেকে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের নেতারা আজ বৃদ্ধ, অনেকে পরপারে। দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মের আগ্রহ নেই বাংলা আর বাঙালি নিয়ে। তাই কথা বলবার, আওয়াজ তোলবার মতো কণ্ঠের খুব অভাব।

তবু অন্তত আমার, আমাদের মৃত‌্যু পর্যন্ত বিলেতের বুকে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি যেন সগৌরবে সুসংহত থাকে, বাংলাদেশি হিসেবে এটিই আমার প্রথম প্রত‌্যাশা।

লেখক: সাংবাদিক, সাধারণ সম্পাদক, ইউকে-বাংলা প্রেসক্লাব।
/এসএএস/এফএ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
টাঙ্গাইল শাড়িসহ ১৪ পণ্যকে জিআই স্বীকৃতি
টাঙ্গাইল শাড়িসহ ১৪ পণ্যকে জিআই স্বীকৃতি
১৮ বছরের ক্যারিয়ারের ইতি টানলেন বিসমাহ মারুফ 
১৮ বছরের ক্যারিয়ারের ইতি টানলেন বিসমাহ মারুফ 
মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগে পিতার মৃত্যুদণ্ড
মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগে পিতার মৃত্যুদণ্ড
উপজেলা নির্বাচনে সহিংসতার শঙ্কা সিইসির
উপজেলা নির্বাচনে সহিংসতার শঙ্কা সিইসির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ