X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তায় শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রবণতা কি বাড়াচ্ছে?

গোলাম মোরশেদ
২৯ মার্চ ২০২২, ১৯:১৪আপডেট : ২৯ মার্চ ২০২২, ১৯:১৬
বাংলাদেশে প্রতিবছর আত্মহত্যায় কতজন মারা যাচ্ছে কিংবা কী পরিমাণ হ্রাস-বৃদ্ধি পাচ্ছে তা সংক্রান্ত কোনও জাতীয় জরিপ নেই। এক্ষেত্রে সাধারণত বাংলাদেশের পুলিশ এবং বিশ্বব্যাংকসহ কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রকাশিত উপাত্তের ওপর নির্ভর করতে হয়। গত এক দশকের আত্মহত্যা সম্পর্কিত প্রাপ্ত প্রতিবেদনসমূহ বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে বাংলাদেশে আত্মহত্যার হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ পুলিশের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ২০১৪ সালে যেখানে আত্মহত্যার পরিমাণ ছিল ১০ হাজার ২০০ জন, যা ২০২১ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৪৩৬ জনে। অর্থাৎ বাংলাদেশে গত বছর দৈনিক গড়ে প্রায় ৪০ জন ব্যক্তি আত্মহত্যা করেছে। ধারণা করা যায় বাস্তবে দেশে আত্মহত্যার হার আরও বেশি।

বাংলাদেশ পুলিশ কেবল সেই সংখ্যক উপাত্ত প্রকাশ করে, যা পুলিশি রেকর্ডের অধিভুক্ত হয়েছে। আমাদের সমাজের এখনও বেশিরভাগ আত্মহত্যার ঘটনাকে গোপন রাখা হয় কিংবা পুলিশকে অবগত করা হয় না।

অপরদিকে করোনাকালীন আত্মহত্যার ঘটনা অন্য সময়ের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। জরিপে দেখা যায় যে ২০২১ সালে যেখানে করোনায় আক্রান্ত হয়ে দৈনিক গড়ে ২৩ জন মারা গিয়েছে সেখানে আত্মহত্যা করেছে ৪০ জন, যা ৭০ শতাংশ বেশি। একই সঙ্গে আত্মহত্যার তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায় যে বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে (২০১৪ থেকে ২০১৭) যে পরিমাণ মানুষ অন্যের দ্বারা হত্যার শিকার হয়েছে তার দ্বিগুণের বেশি আত্মহত্যা করেছে। বাংলাদেশে প্রতিবছর যারা আত্মহত্যা করে তাদের মাঝে প্রায় অর্ধেকের (৪৯%) বয়স ২০ থেকে ৩৫ বছর। অর্থাৎ আত্মহত্যার শিকার ব্যক্তির অর্ধেক বয়সে তরুণ-তরুণী, যাদের একটা বড় অংশ বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী কিংবা চাকরি প্রার্থী। বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে শুধু ২০২১ সালে ১০১ জন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। প্রাথমিক পর্যায়ের অনুসন্ধানে এসব দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে প্রেমের সম্পর্কের টানাপোড়ন, নতুন পরিবেশে অভিযোজন করতে না পারা, মাদকাসক্তি, পারিবারিক কলহ, মানসিক অবসাদগ্রস্ততা, অর্থনৈতিক সংকট ইত্যাদিকে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু এর বাইরে আরও কিছু সামাজিক-সাংস্কৃতিক কারণ রয়েছে। যার মাঝে পড়াশোনা শেষে কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা, চাকরি প্রাপ্তিতে দীর্ঘসূত্রতা, আশানুরূপ চাকরি না পাওয়ার হতাশা, কর্মসংস্থান সম্পর্কিত সামাজিক ও পারিবারিক চাপ আত্মহত্যার প্রবণতা সৃষ্টি করে।

শিক্ষাজীবনে বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কলেজ পর্যায় এমন এক সময় যখন শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার পাশাপাশি ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে। কিন্তু শিক্ষাজীবন পরবর্তী দেশের শ্রমবাজারের বর্তমান অবস্থা এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে শিক্ষার্থীরা এখন অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার তুলনায় কর্মসংস্থান নিয়ে বেশি চিন্তিত থাকে। দেশের শ্রমবাজারের বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকেই চাকরির প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করে। তাই বেশিরভাগ শিক্ষার্থী গ্রন্থাগারগুলোতে অ্যাকাডেমিক কিংবা সাহিত্যের বই পড়তে যায় না, বরং চাকরির প্রস্তুতি নিতে যায়।

সম্প্রতি বেশিরভাগ ছেলেমেয়ের সরকারি চাকরির প্রতি আকর্ষণ বেশি। আর সরকারি চাকরির মধ্যে বেশিরভাগের প্রথম পছন্দ বিসিএস। কিন্তু বাংলাদেশের সরকারি চাকরির নিয়মিত শূন্য পদের সংখ্যা ও প্রার্থীর সংখ্যার মাঝে বিশাল ফারাক। প্রতিবারের বিসিএস নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে গড়ে দেড় হাজার থেকে দুই হাজার নতুন নিয়োগ দেওয়া হয়, অথচ পরীক্ষার্থী থাকে তিন থেকে চার লাখের বেশি। যেমন, গত ৪১তম বিসিএস পরীক্ষায় ২১৩৫টি পদের বিপরীতে ৪ লাখ ৭৫ হাজার জন আবেদন করেছিল। অর্থাৎ প্রতি পদের বিপরীতে ২২০ জনের বেশি প্রার্থী আবেদন করেছে। আবার একবারের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে কয়েক বছর সময় লাগে। গত কয়েক বছরের নিয়োগ কার্যক্রম বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে চিকিৎসকদের জন্য বিশেষ নিয়োগ ব্যতীত প্রতিটা বিসিএসে আবেদনের বিজ্ঞপ্তি থেকে শুরু করে কর্মস্থলে যোগদানের ক্ষেত্রে কমপক্ষে সাড়ে তিন বছর সময় লাগে। অর্থাৎ একজন শিক্ষার্থী যেখানে ৪ বছরের স্নাতক শেষ করে বিসিএসে আবেদনের যোগ্যতা অর্জন করে সেখানে আবেদনের পর তিন স্তরের পরীক্ষা শেষ করে যোগদান করতে সময় নেয় আরও প্রায় ৪ বছর। তাছাড়া বিসিএসের প্রস্তুতিতেই অনেকের চলে যায় আরও কয়েক বছর। শুধু বিসিএস নয়, অন্যান্য সরকারি চাকরির ক্ষেত্রেও বিজ্ঞপ্তি থেকে নিয়োগ পর্যন্ত সময় লেগে যায় কয়েক বছর। এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে আবেদনের পর পরীক্ষা গ্রহণ করা হয় কয়েক বছর পর। ফলে দেখা যাচ্ছে যে একজন শিক্ষার্থী স্নাতক শেষে চাকরির প্রস্তুতি গ্রহণ ও আবেদন করতে কিংবা শুধু পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতেই ব্যয় করছে কয়েক বছর। অর্থাৎ শুধু কাঠামোগত কারণেই একজন শিক্ষার্থীর স্নাতক-স্নাতকোত্তর শেষ করে কর্মস্থলে প্রবেশ করতে সময় লাগে ৪-৫ বছর। আবার বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়েই সেশনজটের কারণে পাঁচ বছরের স্নাতক-স্নাতকোত্তর শেষ করতে আরও অতিরিক্ত কয়েক বছর চলে যায়।

এছাড়া কর্মসংস্থান সংক্রান্ত কিছু কিছু অভিজ্ঞতা যেমন, একই দিনে একাধিক পরীক্ষা গ্রহণের সময়সূচির ফলে আবেদন করা সত্ত্বেও পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে না পারা, নিয়মিত পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস, আবেদন ফি গ্রহণ, অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার সঙ্গে চাকরির সিলেবাসের অসামঞ্জস্যতা, বছরের পর বছর নিয়োগ পরীক্ষা ঝুলে থাকা, পারিবারিক ও সামাজিক চাপসহ বিবিধ ঘটনা চাকরিপ্রার্থীদের মনে হতাশা সৃষ্টি করে। অপর পক্ষে দেশের শ্রমবাজারের চাহিদা এবং জোগানের অসামঞ্জ্যতার কারণে প্রতি বছর লাখ লাখ চাকরিপ্রার্থী শুধু সরকারি চাকরির প্রত্যাশায় আবেদন করতে করতে এবং পরীক্ষা দিতে দিতে সরকারি চাকরির আবেদনের বয়সসীমা অতিক্রম করে ফেলছে। সরকারি চাকরির প্রত্যাশায় থাকা বেশিরভাগ শিক্ষার্থী বেসরকারি খাতে চাকরির চেষ্টা করে না কিংবা সুযোগ পেলেও চাকরিতে যোগদান করে না। কিন্তু স্নাতক-স্নাতকোত্তরের পর সরকারি চাকরি পেতে ব্যর্থ হওয়া ব্যক্তি যখন বেসরকারি খাতে চাকরির চেষ্টা করে তখন তার এই দীর্ঘ বিরতি চাকরি পেতে অসুবিধা সৃষ্টি করে। এমনকি অনেক চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান দীর্ঘ সময় বেকার থাকা প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে অস্বীকৃতি জানায়।

বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় বেশিরভাগ ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ মেটানোর জন্য খণ্ডকালীন কাজ কিংবা টিউশনির মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করতে হয়। তাই একজন শিক্ষার্থী তার ছাত্রজীবন থেকে চাকরি পাওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত নিয়মিত মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিক্ষাজীবন শেষে একজন শিক্ষার্থী ও তার পরিবারের জন্য কাঙ্ক্ষিত চাকরি পাওয়া হাতে সোনার হরিণ পাওয়ার মতো ব্যাপার। কিন্তু দীর্ঘ সেশনজট পেরিয়ে স্নাতক-স্নাতকোত্তর শেষ করে যখন ৪-৫ বছরেও যখন একজন শিক্ষার্থী চাকরি পায় না, তখন তারা হতাশার সাগরে হারিয়ে যায়।

যেহেতু বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা কাজ পাওয়া যায় না। এজন্য উক্ত বিষয়ে নিবিড় গবেষণার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা কমানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের সুরক্ষা প্রোগ্রাম চালু করতে হবে। অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের জন্য পড়াশোনার খরচ বাবদ আর্থিক সহায়তা, নতুন পরিবেশে সামাজিকীকরণ ও অভিযোজনের জন্য ক্যাম্পাসে উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি, খেলাধুলা ও চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা, স্টুডেন্ট কাউন্সেলিং সেন্টার চালু, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত দক্ষতা উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, ইত্যাদি আত্মহত্যার প্রবণতা হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রবণতা রোধে বিশেষ গুরুত্ব হিসেবে চাকরির নিয়োগ প্রক্রিয়াকে আরও বেশি দ্রুত করতে হবে। যথাসম্ভব নতুন নতুন কর্মসংস্থানের খাত সৃষ্টি এবং নিয়োগ প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত করলে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রার্থীদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা হ্রাস পাবে।

লেখক: প্রোগ্রাম অফিসার, প্রজ্ঞা বাংলাদেশ।
[email protected]
 
/এমওএফ/এফএ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পাকিস্তানে জাপানি নাগরিকদের লক্ষ্য করে জঙ্গি হামলা
পাকিস্তানে জাপানি নাগরিকদের লক্ষ্য করে জঙ্গি হামলা
মাদারীপুরে কলেজছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা
মাদারীপুরে কলেজছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা
বেসিস নির্বাচনে ওয়ান টিমের প্যানেল ঘোষণা
বেসিস নির্বাচনে ওয়ান টিমের প্যানেল ঘোষণা
ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি লিভারপুল, সেমিফাইনালে আটালান্টা
ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি লিভারপুল, সেমিফাইনালে আটালান্টা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ