X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

‘টাকা রফতানি’তে সরকারি প্রণোদনা

রুমিন ফারহানা
১৮ মে ২০২২, ১৮:০২আপডেট : ১৮ মে ২০২২, ১৮:০৪
টাকা পাচার কারা করে? কেন দেশ থেকে টাকা পাচার হয়? টাকা পাচার রোধে আইনটাই বা কী? সেই আইনের প্রয়োগই বা কতটুকু? টাকা পাচার বন্ধে সরকার কি আদৌ আন্তরিক? যদি সত্যিকার অর্থেই সরকার ব্যবস্থা নিতো তাহলে প্রতি বছর এত টাকা পাচার হয় কী করে? এই প্রশ্নগুলো উঠেছিল গত বছর সংসদ অধিবেশনে, অর্থমন্ত্রীর উপস্থিতিতে। টাকা পাচারের সঙ্গে কারা জড়িত এই প্রশ্ন তোলার সাথে সাথেই অর্থমন্ত্রী পরিষ্কার বলেছিলেন, কারা টাকা পাচার করে সেই তথ্য তার কাছে নেই। এখানেই শেষ নয়। তিনি একধাপ এগিয়ে বিরোধী দলের সদস্যদের কাছে নামও চেয়েছিলেন টাকা পাচারকারীদের।

অর্থমন্ত্রী যখন টাকা পাচারকারী খুঁজে বেড়াচ্ছেন তার ঠিক কিছু দিন আগেই মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, দেশে টাকা পাচারকারীদের মধ্যে রাজনীতিবিদদের চেয়ে আমলা আর ব্যবসায়ীর সংখ্যাই বেশি। কানাডার বেগমপাড়ায় গোপন জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, ২৮টি পরিবারের মধ্যে কেবল ৪টি রাজনীতিবিদ, বাকি ২৪টি আমলা আর ব্যবসায়ী। তাই বিরোধী দলের কাছে পাচারকারীদের নাম না খুঁজে নিজ সহকর্মীর কাছে খুঁজলেই অন্তত ২৮টি নাম পেতে পারতেন অর্থমন্ত্রী।

গত একযুগের বেশি সময় ধরে যে ধরনের শাসন চলছে তাতে বাংলাদেশ টাকা পাচারের অতি উর্বর ভূমি হয়ে থাকারই কথা। টাকা পাচারের ক্ষেত্রে একটি বিষয় স্পষ্ট হওয়া জরুরি– বৈধ, অবৈধ দুই রকম টাকাই পাচার হতে পারে এবং হয়ও। যদিও অবৈধ পথে তৈরি হওয়া টাকা পাচার হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি। তবে এই দুই ধরনের টাকা পাচারের ক্ষেত্রেই প্রধান ভূমিকা পালন করে সরকারের অপশাসন আর পৃষ্ঠপোষকতা।  

ব্যাংক লুট, প্রকল্পের দুর্নীতি, ঘুষ, মাদকের মতো নিষিদ্ধ পণ্যের ব্যবসা থেকে যে অবৈধ টাকা তৈরি হয় তার বিরাট একটি অংশ পাচার হবেই। একজন বড় দুর্নীতিবাজ মানুষ দেশে টাকা রাখতে কখনও নিরাপদ বোধ করবেন না। বর্তমানে একটি দুর্নীতিবান্ধব সরকার থাকায় হয়তো তারা জবাবদিহির আওতায় আসছে না। কিন্তু ভবিষ্যতে এমন একটি সরকার যদি আসে, যারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে সত্যি-সত্যিই কঠোর পদক্ষেপ নেবেন, তাহলে তারা ধরা পড়বেনই। সেই আশঙ্কা মাথায় রেখে তাদের বিদেশে টাকা পাচার করে দেবারই কথা। দেশ থেকে পাচার হওয়া টাকার প্রধান অংশটিই নানা রকম অবৈধ, বেআইনি পথে অর্জিত।

এই দেশে বৈধ উপার্জন করা মানুষও টাকা পাচার করেন। একটা উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। রফতানিমুখী শিল্পের একজন বড় শিল্পপতির কথা কল্পনা করি, যিনি পণ্য রফতানি করে অনেক টাকা উপার্জন করেন। তিনি যত টাকা উপার্জন করেন সেই টাকা দেশে এনে আবার বিনিয়োগ করতে অনীহা আছে। কারণ, এই দেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতি নানাদিক বিবেচনায় ভালো নয়। তার চাইতে বড় কথা, তার পরিবার এখন আর এই দেশে থাকতে চাইছে না। এই দেশ, ঢাকা শহর বাসযোগ্য নেই আর। তার পরিবার এই দেশে বাস না করে ইউরোপ কিংবা উত্তর আমেরিকার কোনও উন্নত গণতান্ত্রিক সভ্য দেশে বসবাস করছেন এবং কখনোই আর দেশে ফিরতে চান না। এই শিল্পপতিও তার উপার্জিত সম্পদের একটা বড় অংশ রফতানি মূল্য কম দেখিয়ে ধীরে ধীরে পাচার করে দেবেন। একই সূত্র আমদানিকারকের জন্যও প্রযোজ্য। পার্থক্য হলো, সে দাম কম দেখানোর বদলে বেশি দেখিয়ে টাকাটা পাচার করে দেবে কোনও উন্নত নিরাপদ আশ্রয়ে।  

গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) জানিয়েছে, ২০০৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ৮ হাজার ৯৬৬ কোটি ডলার, যা বর্তমান ডলারের মূল্যে সাড়ে ৮ লাখ কোটি টাকার বেশি। অর্থাৎ প্রতি বছর ৮৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এখানে জেনে রাখা জরুরি, এই প্রতিষ্ঠান শুধু আমদানি (ওভার ইনভয়েসিং) এবং রফতানির (আন্ডার ইনভয়েসিং) মাধ্যমে ব্যাংকিং চ্যানেলে পাচারকৃত টাকার হিসাব দেয়। এই গবেষণার জন্য তারা ব্যবহার করে জাতিসংঘে দেশগুলোর দেওয়া আমদানি-রফতানি সংক্রান্ত ডাটা। প্রতিষ্ঠানটি পরবর্তী সময়ে অন্যান্য সব দেশের ক্ষেত্রে হালনাগাদ ডাটার ভিত্তিতে তথ্য দিলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেটা পারেনি। ২০১৫ সালের পর থেকে বাংলাদেশ জাতিসংঘে আমদানি-রফতানি সংক্রান্ত ডাটা দেয়নি। কেন সেই ডাটা দেওয়া হয়নি তার কারণ বোঝা নিশ্চয়ই ‘রকেট সায়েন্স’ নয়।

এ তো গেলো ব্যাংকিং চ্যানেলে পাচারকৃত অর্থের হিসাব। এর বাইরেও বিপুল পরিমাণ টাকা পাচার হয় ব্যাংকবহির্ভূত পথে, হুন্ডির মাধ্যমে। হুন্ডির মাধ্যমে কত টাকা পাচার হয় সেই হিসাব করা খুব কঠিন। সেই পরিমাণ যদি ব্যাংকিং চ্যানেলের সমানও হয়, তাহলেই পাচারের অংকটা বছরে দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।

কোনও সরকার যদি কোনও অপরাধ বন্ধ করতে, নিদেনপক্ষে কমাতে আন্তরিক হয়, তাহলে সেই অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সংস্থা গঠন করে, শক্তিশালী করে এবং সর্বোপরি সেগুলোকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়। বাংলাদেশের চিত্র পুরোই আলাদা। নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্রমাগত দুর্বল করে কাগুজে প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে, যাদের মূল কাজই হচ্ছে বিরোধীদলীয় মানুষদের হয়রানি করা।  

এরমধ্যে কোনও প্রতিষ্ঠান যদি কিছু কাজও করে থাকে তাহলেও সেটার ভিত্তিতে কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। দেশে ও দেশের বাইরে অর্থপাচারের ঘটনা তদন্তে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। বছর খানেক আগে জানা যায়, বিদেশে অর্থ পাচারের ঘটনা তদন্ত করে গত পাঁচ অর্থবছরে ১ হাজার ২৪টি ঘটনার প্রমাণ পেয়েছে সংস্থাটি। এরমধ্যে অর্ধেক ঘটনায় দেশের বাইরে অর্থপাচারের প্রমাণ মিলেছে।

সংস্থাটি যেসব ঘটনার প্রমাণ পেয়েছে, তার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছে পাঠিয়েছে। যেসব সংস্থার কাছে এসব প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বাংলাদেশ পুলিশ, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে তথ্য-প্রমাণ থাকার পরও এসব ঘটনায় কোনও সংস্থা এখন পর্যন্ত কোনও ব্যবস্থা নিয়েছে বলে জানা যায়নি। এছাড়াও পানামা এবং প্যারাডাইস পেপার্সে এসেছে ৮৪ জনের নাম টাকা পাচারকারী হিসেবে, যাদের কারও বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানা যায় না।

ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে টাকা পাচার হয় হুন্ডির মাধ্যমে। এ দেশে কোন এলাকায় কে হুন্ডি ব্যবসা করে, সেটা জানে এলাকার মানুষ, জানে লোকাল থানা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এটা এতটাই প্রকাশ্য বিষয়, এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া মোটেই কঠিন কোনও কাজ নয়। সরকার কঠোর হলে হুন্ডি ব্যবসা পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া না গেলেও সহনীয় মাত্রায় নামিয়ে আনা যাবে তো বটেই। কিন্তু সরকার এদের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে, এমনটা দেখা যায় না কখনও।      

টাকা পাচার রোধ করা সারা পৃথিবীতে খুব চ্যালেঞ্জিং একটি বিষয়। এ জন্যই বলা হয়, পাচার রোধ করার প্রধান উপায় হচ্ছে অবৈধ ও বেআইনি উপার্জনকে যাতে ন্যূনতম পর্যায়ে নামিয়ে আনা যায় সেই চেষ্টা করা। এ দেশে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্নীতি-লুটপাট যেমন চলছে, তেমনি চলছে সংস্থাগুলোকে দুর্বল ও অকার্যকর করে রাখার চেষ্টা। সর্বোপরি দেশি এবং বিদেশি সব সংস্থার তথ্য সামনে থাকার পরও অর্থমন্ত্রী ন্যূনতম কোনও ব্যবস্থা না নিয়ে যখন বিরোধী দলের কাছে পাচারকারীদের তথ্য খুঁজে বেড়ান তখন পাচার বন্ধে সরকারের আন্তরিকতা কতটুকু বুঝতে বাকি থাকে না। আর সে কারণেই পি কে হালদার বা পাপুল কাউকেই দেশে ধরা পড়তে দেখা যায় না।    

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ও বিএনপি দলীয় হুইপ।   

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ইরাকি ঘাঁটিতে হামলায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার যুক্তরাষ্ট্রের
ইরাকি ঘাঁটিতে হামলায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার যুক্তরাষ্ট্রের
উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ও আওয়ামী লীগ সভাপতির সাহসী পদক্ষেপ
উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ও আওয়ামী লীগ সভাপতির সাহসী পদক্ষেপ
‘তীব্র গরমে’ চু্য়াডাঙ্গা ও পাবনায় ২ জনের মৃত্যু
‘তীব্র গরমে’ চু্য়াডাঙ্গা ও পাবনায় ২ জনের মৃত্যু
ডাগআউট থেকে রিভিউ নিতে বলায় ডেভিড, পোলার্ডের শাস্তি
ডাগআউট থেকে রিভিউ নিতে বলায় ডেভিড, পোলার্ডের শাস্তি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ