X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

স্বামী কেন ভাই হয়ে গেলো?

রেজানুর রহমান
১৬ জুন ২০২২, ১৭:৫৮আপডেট : ১৬ জুন ২০২২, ১৭:৫৮
একটা ধাঁধা আপনাদের জন্য। বলুন তো স্বামী কখন ‘ভাই’ হয়ে যায়? কী ভাবছেন? স্বামী আবার ভাই হয় কী করে? কেন স্বামী ভাই হতে পারে না? চাচাতো, মামাতো, ফুফাতো অথবা খালাতো ভাইয়ের সঙ্গে যখন কোনও নারীর বিয়ে হয়ে যায় তখন তো আমরা বলি, ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। কিন্তু বিয়ের পর স্বামীকে কি কোনও নারী ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করতে পারে? তাও আবার কোনও প্রচার মাধ্যমে, প্রকাশ্যে...। বোধকরি পারে না? সামাজিক অনুশাসন মানলে স্বামীকে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করা যায় না। অথচ চিত্রনায়িকা মৌসুমী তার স্বামী ওমর সানীকে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করেছেন।

তর্কের খাতিরে যদি বলি, তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে স্বামীকে ‘ভাই’ বলাতে কী এমন অন্যায় হয়েছে? ভাই আর বোন অনেক মধুর সম্পর্ক। মৌসুমী তার স্বামীকে ‘ভাই’ বলেছেন। তার মানে মৌসুমী কি তাহলে ওমর সানীর বোন? বিয়ের পর তো ভাই-বোনের সম্পর্ক বদলে যায়। ভাই হয়ে যায় স্বামী আর বোন হয়ে যায় স্ত্রী। তাহলে কী পাল্টা প্রশ্ন এসে দাঁড়ায় না, ওমর সানী যদি মৌসুমীর ভাই হয়ে থাকে তাহলে কি তারা এখন আর স্বামী-স্ত্রী নন? কেন স্বামীকে ‘ভাই’ বললেন প্রিয়দর্শিনী নায়িকা মৌসুমী?

প্রিয় পাঠক, আজকের লেখাটি একটি তুচ্ছ বিষয় নিয়ে। এজন্য ক্ষমা করবেন। অবশ্য বিষয়টাকে তুচ্ছই বা বলি কী করে? বিষয়টি এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পাশাপাশি দেশের সংবাদপত্র ও টেলিভিশন মিডিয়ায়ও দারুণ আলোচিত। একই ঘটনার কতভাবেই না রিপোর্ট প্রকাশ হচ্ছে? একটার সঙ্গে অন্যটার কোনও মিল নেই। কোনও কোনও পত্রিকা ও টিভি মাধ্যমে ঘটনাটি এতই গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ ও প্রচার হচ্ছে যে মনে হবে এর চেয়ে বড় খবর আর দ্বিতীয়টি নেই। কোনও কোনও প্রচার মাধ্যমে মুখরোচক বানানো গল্প এমনভাবে প্রকাশ ও প্রচার করা হচ্ছে যে মনে হবে বানানো গল্প বলার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।

ও হ্যাঁ, ঘটনাটিই তো বলিনি আপনাদের। অবশ্য আমার ধারণা ঘটনার আদ্যোপান্ত সবাই ইতোমধ্যে আঁচ করে ফেলেছেন। তবু ঘটনাটা বলি। ডিপজলকে আমরা সবাই চিনি। দেশের বিশিষ্ট চলচ্চিত্র অভিনেতা ডিপজলের ছেলের বিয়েতে অন্যদের মতো আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন ওমর সানী ও জায়েদ খান। অনুষ্ঠানে এসে পাশাপাশি বসেন দুজন। ওই অনুষ্ঠানে হঠাৎ জায়েদ খানের প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন ওমর সানী। জায়েদ খান প্রায়শই ওমর সানীর স্ত্রী নায়িকা মৌসুমীকে উত্ত্যক্ত করেন বলে অভিযোগ তুলে প্রকাশ্যে তাকে চড় মারেন সানী। অভিযোগ উঠেছে, ওই সময় জায়েদ খান নাকি পিস্তল উঁচিয়ে ওমর সানীকে ভয় দেখিয়েছেন। ঘটনা ওই পর্যন্ত থামলে বোধকরি ভালো হতো।

‘ঘরের কথা পরে জানলো কেমনে?’– এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্যই বোধকরি ওমর সানী বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সভাপতির কাছে জায়েদ খানের বিরুদ্ধে নালিশ ঠুকে দেন। যেখানে স্পষ্ট বলা হয় চিত্রনায়ক জায়েদ খান প্রায়ই চিত্রনায়িকা মৌসুমীকে উত্ত্যক্ত করেন। সে (জায়েদ খান) সানী ও মৌসুমীর সংসারে ভাঙন ধরানোর চেষ্টায় লিপ্ত বলে নালিশনামায় তুলে ধরা হয়। কিন্তু যাকে কেন্দ্র করে এই ঘটনা অর্থাৎ মৌসুমী তার স্বামীর বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে অডিও বার্তা পাঠান। ওই অডিও বার্তায় মৌসুমী যা বলেন তার সারমর্ম হলো– জায়েদ খান তাকে উত্ত্যক্ত করে এই অভিযোগ সত্য নয়। জায়েদ খান অত্যন্ত ভালো ছেলে বলে সার্টিফিকেট দেন তিনি। স্বামী ওমর সানীকে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করে মৌসুমী একপর্যায়ে বলেন, আমাকে ছোট করে, অসম্মান করে সবার শ্রদ্ধার মানুষ ‘সানী ভাই’ কেন এত মজা পাচ্ছেন আমি জানি না।

মৌসুমীর কথায় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে ওমর সানী ও মৌসুমী দম্পতির মধ্যে কিছু একটা ঝামেলা চলছে। হতে পারে সেটা দাম্পত্য ঝামেলা। কিন্তু সব ঝামেলাই কী প্রকাশ্য হওয়া উচিত? তারকাদের, বিশেষ করে সিনেমার জনপ্রিয় নায়ক-নায়িকাদের ব্যক্তিগত জীবনের প্রতি সাধারণ মানুষের বেশি কৌতূহল থাকে। ফলে কোনও তারকার ছোট্ট একটি সংবাদকে তারা তিলকে তাল করার পর্যায়ে নিয়ে যায়। কাজেই তারকাদের উচিত নিজেদের সংযত রাখা।

পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ওমর সানী, জায়েদ খান ও মৌসুমীর ত্রিমুখী বাগবিতণ্ডায় সংবেদনশীল ও বিবেকবান মানুষেরা বেশ ক্ষুব্ধ। আবার একশ্রেণির মানুষ তিন তারকার বাহাসকে আনন্দ-কৌতুক ও উপহাসের পর্যায়ে এনে দাঁড় করিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিন তারকাকে নিয়ে আপত্তিকর ট্রল করা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একজন লিখেছেন, মৌসুমী, ওমর সানী ও জায়েদ খান তিন জনই বর্তমানে সিনেমার ফ্লপ তারকা। সেই অর্থে তাদের হাতে কোনও সিনেমা নেই। তাই আলোচনায় থাকার জন্য উদ্ভট সব ‘কাণ্ড-কারখানা’ চালাচ্ছে। তিন তারকার বাহাসকে কেন্দ্র করে দেশের ফিল্মপাড়ায়ও মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। চিত্রনায়িকা রোজিনা বলেছেন, আমাদের চলচ্চিত্রাঙ্গনের বর্তমান ঘটনায় খুবই লজ্জা পাচ্ছি। নায়ক উজ্জল বলেছেন, সত্যি কথা বলতে কী, আমাদের চলচ্চিত্রে সেই অর্থে কোনও অভিভাবক নাই। ফলে যার যা খুশি তা-ই করছেন। চিত্রনায়িকা ববিতা বলেছেন, আমাদের চলচ্চিত্রাঙ্গনের বর্তমান চিত্র মোটেই সুখকর নয়। সিনিয়র জুনিয়রের মধ্যে সদ্ভাব, সম্প্রীতি নেই। সবারই সংযত হওয়া দরকার। চিত্রনায়ক সোহেল রানা বলেছেন, আমাদের চলচ্চিত্রাঙ্গনের আশপাশে যা দেখছি, যা শুনছি, তা কোনোটাই সুখকর নয়। শিল্পীদের উচিত শিল্পীসুলভ আচরণ করা। জনপ্রিয় উপস্থাপক তানভীর তারেক তার ফেসবুক ওয়ালে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা লিখেছেন–‘রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নাই। আর আমগো শোবিজে কুনডা শেষ আর কুনডা শুরু হেইডা বুঝারও উপায় নাই।’

যারা শোবিজ তারকা তারাও মানুষ। তাদেরও ব্যক্তিগত জীবন আছে। কারও অধিকার নেই শিল্পীর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কুৎসা রটানো অথবা তাকে বিব্রত করা। কিন্তু শিল্পীরা যদি নিজেরাই নিজেদের খোলামেলা করে তোলেন, নিজেদের সার্কাসের জোকারে পরিণত করেন, তাহলে তো ব্যক্তিগত জীবন বলে কিছু থাকে না। একটা কথা মনে রাখতে হবে, জোকারকে দেখলে মানুষ বেশ আনন্দ পায়। পারলে খোঁচাতে চায়। তিন তারকার সাম্প্রতিক বাহাসকে অনেকটা জোকারের সঙ্গে তুলনা করা যায়। তিন তারকার বাহাস অনেকের আনন্দের খোরাকে পরিণত হয়েছে। রাস্তায়, চায়ের দোকানেও তিন তারকার বাহাস নিয়ে মুখরোচক আলোচনা চলছে। একটি ছোট্ট নিদর্শন তুলে ধরছি। ঢাকার মগবাজার এলাকায় একটি রাস্তার মুখে চায়ের দোকানের বেঞ্চি দখল করে বসে আছেন জনা সাতেক মানুষ। তিন জনের হাতে চায়ের কাপ। তাদের মধ্যে একজন বক্তা। অন্যরা তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছেন। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বক্তা মুখ খুললেন– আমারে আপনারা একটা কথা বুঝান তো। এই যে মৌসুমী, ওমর সানী আর জায়েদ খান ঝগড়া শুরু করছে, এই ঝগড়ায় কি সিনেমার কোনও কথা আছে? নেই। কথা আছে কে কারে উত্ত্যক্ত করছে, বিরক্ত করছে এসব নিয়া। তাকে বিরক্ত করার মানে কী? আবার দ্যাহেন স্বামী বলতেছে অমুক আমার স্ত্রীকে উত্ত্যক্ত করে। আমার সংসারে আগুন লাগাইতে চায়। অথচ স্ত্রী কইতেছে তার স্বামীর কথা ঠিক নয়। স্বামী মিথ্যা বলতেছে... এই সবের মানে কী-রে ভাই? যারা এতক্ষণ বক্তার কথা শুনছিল তারা সবাই এবার একেকজন বিদ্রোহী বক্তায় পরিণত হলো। আমাদের সিনেমার চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে শোভন অশোভন বক্তব্য দিতে থাকলো। ভাবটা এমন যে উল্লেখিত তিন তারকা অর্থাৎ ওমর সানী, মৌসুমী আর জায়েদ খানই আমাদের সিনেমার সবকিছু- হর্তা, কর্তা, বিধাতা... কাজেই এই সিনেমার কোনও ভবিষ্যৎ নেই।

সত্যিকার অর্থে মৌসুমী, ওমর সানী ও জায়েদ খানই কি আমাদের সিনেমার হর্তা, কর্তা, বিধাতা? অবশ্যই না। কিন্তু তারা এবং তাদের মতো আরও অনেকে আমাদের সিনেমার এই যে দুর্নাম ছড়াচ্ছেন তার ভবিষ্যৎ পরিণতি কি ভাবছেন কেউ? সিনেমা যেকোনও দেশের মূলধারার সংস্কৃতিকে বিকশিত করে। আমাদের দেশেও সিনেমার এমন যুগান্তকারী ভূমিকা আছে। আমরা কি এই কথাটি ভুলে যাচ্ছি?

সিনেমার এই সংকট সময়ে অভিজ্ঞজনের একটা সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। আসাদ চৌধুরীর কবিতার ভাষায় ‘খাচ্ছি, দাচ্ছি, ঝাঁকের কই ঝাঁকে মিশে যাচ্ছি’ এমন মানসিকতা পরিহার করে একটা আন্তরিক উদ্যোগ জরুরি। যে উদ্যোগের মূল সুর হবে ভালো সিনেমা। ভালো সিনেমার গাড়ি সচল হলেই তথাকথিত তারকাদের আপত্তিকর বাহাস গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে। কিন্তু সেটা করবে কে?


লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক- আনন্দ আলো।
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘গাজার গণকবরে অন্তত ২০ জনকে জীবন্ত দাফন’
‘গাজার গণকবরে অন্তত ২০ জনকে জীবন্ত দাফন’
‘বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন গড়তে হবে’
‘বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন গড়তে হবে’
প্রতি শ্রেণিতে ৫৫ শিক্ষার্থী ভর্তির নির্দেশ শিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর
প্রতি শ্রেণিতে ৫৫ শিক্ষার্থী ভর্তির নির্দেশ শিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর
উত্তাল চুয়েট, অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা
উত্তাল চুয়েট, অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ