X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

গুরু-হেনস্তা ও শিক্ষক হত্যা: সমাধান আছে তো!

শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন
১৭ জুলাই ২০২২, ১৪:০৯আপডেট : ১৭ জুলাই ২০২২, ১৭:১৬

কলেজ অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতোর মালা পরানো হয়েছে, হত্যা করা হয়েছে পৌরনীতি ও সুশাসন বিষয়ের শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে। প্রথম ঘটনাটি ১৮ জুনের, দ্বিতীয় ঘটনাটি ২৫ জুনের। মাত্র ৭ দিনের ব্যবধানে ঘটে গেলো ভয়ংকর দুটি ঘটনা। একজন শিক্ষকের গলায় উঠলো জুতার মালা, আর আরেকজনকে হত্যা করা হলো স্ট্যাম্প দিয়ে পিটিয়ে। কয়েক মাস আগে বিজ্ঞানের শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে বিজ্ঞান ও ধর্ম নিয়ে আলোচনা করার সময়ে ধর্ম নিয়ে মন্তব্য করার দায়ে কারাগারে যেতে হয়েছিল। অথবা ষড়যন্ত্র করে পরিকল্পিতভাবে হৃদয় মণ্ডলকে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। এ তিনটি ঘটনার কেন্দ্রে যারা আছেন, দুর্ঘটনাক্রমে তাদের সকলেই শিক্ষক এবং কাকতালীয়ভাবে সকলেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ!

ঘটনাগুলো কি বার্তা দিচ্ছে? দায়টি কার? শিক্ষকদের, শিক্ষার্থীদের, ধর্মান্ধ নির্বোধ জনগোষ্ঠীর? সমাজ, রাষ্ট্র, শিক্ষা ও সংস্কৃতির? নাকি সকল কালে জনগোষ্ঠীর একটি অংশ, অথবা কোনও কোনও সময় জনগোষ্ঠীর বৃহত্তর অংশের মধ্যে সংস্কারজাত, বা ধর্মান্ধতাজাত কিছু আদিম অন্ধকার থাকে এবং প্রজন্ম পরম্পরায় মস্তিষ্কের মূল প্রকোষ্ঠে থেকেই যায় সেই অন্ধকার? তাই যদি না হবে, তাহলে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে আমরা যে ধর্মান্ধতা ও হিন্দু-মুসলিমের ধর্মভিত্তিক ঘৃণাকে জয় করে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করলাম, সেই বাংলাদেশ কেন আবার ধর্মান্ধতার অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে? 

মানছি রাজনীতিটা রাজনীতির জায়গায় নেই। বঙ্গবন্ধু, শের-ই-বাংলা, ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী, তাজউদ্দীন আহমদরা যে আদর্শ ও মাটি-মানুষের রাজনীতি করেছেন, সেই প্রো-পিপল রাজনীতি আর নেই। রাজনীতি ঢুকে গেছে ব্যবসায়ীদের পকেটে। একসময় রাজনীতি করতেন আইনজীবী, শিক্ষকও চিকিৎসকেরা, যাদের সঙ্গে জনমানুষের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ছিল। একদিকে বঙ্গবন্ধুর মাটি ও মানুষের রাজনীতির অনুপস্থিতি, অন্যদিকে গঠনমূলক রাজনীতির পরিবর্তে বিরোধী দলের অর্থহীন বিরোধিতা, জ্বালাও-পোড়াও ও ভাংচুরের রাজনীতি। এদিকে করপোরেট হাউজগুলো ক্ষমতার ভাগ দাবি করছে। অবসরপ্রাপ্ত ও ব্যবসায়ীরা ক্ষমতার বড় অংশীদার, যারা শুধু মুনাফা বোঝে, যারা শুধু সুবিধা চেনে। এরা শুধু নিতেই জানে, দিতে জানে না। এই নব্য রাজনীতিকদের সঙ্গে জনগণের কোনও যোগাযোগ নেই। এরা টাকা দিয়ে মনোনয়ন কিনে নেন। 

অসংখ্য বুভুক্ষু কাক এসে জড়ো হয়েছে এই রাজনীতিতে। এরা জীবনানন্দ দাশের ঝলমলে রোদ ওঠা ‘ভোরের [মায়াবী] কাক’ নয়। এসব বুভুক্ষু কাক টেন্ডার খেয়ে ফেলে, নির্মাণকাজের বরাদ্দের কমিশন চায়, হাসপাতালের ওষুধ ও শিক্ষা বোর্ডের বই ছাপানোর টাকাও খেয়ে ফেলে। এই খাই-খাই রাজনীতির জন্য সমাজের সর্বত্র একটা লোভ ঢুকেছে। এরাই স্কুল ও কলেজের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান কিংবা  ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য। এদের খুশি রেখে, খাই-খাই এমপিদের মন জুগিয়ে গ্রামগঞ্জ ও জেলা শহরের স্কুল ও কলেজগুলোতে শিক্ষকদের চলতে হয়। ফলে অধিকাংশ শিক্ষক মেরুদণ্ড সোজা করে শিক্ষকতাসুলভ ব্যক্তিত্ব নিয়ে শিক্ষকতা করতে পারেন না।

একটা সময়ে গ্রামগঞ্জ ও মফস্বলে পড়াশোনা জানা নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক ছিলেন। এখন গ্রামগঞ্জ ও মফস্বলের স্কুল ও কলেজগুলোতে মেধাবীরা যেতে চান না, বা যান না। তাই বলে গ্রাম, ইউনিয়ন ও জেলা শহরগুলোতে দক্ষ ও মেধাবী শিক্ষক একদমই নেই—আমি সে কথা বলছি না। কিন্তু একটি দেশের শিশু-কিশোরদের দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য গ্রাম ও জেলা শহরগুলোতে যে মানের দক্ষ ও মেধাবী শিক্ষক প্রয়োজন, সেটা যে আমাদের নেই তা মোটামুটি নিশ্চিত। এদিকে শিক্ষারও বাণিজ্যিকীকরণ হয়েছে। স্কুল-কলেজে পড়াশোনা হয় না বলে ব্যাঙের ছাতার মতো কোচিং সেন্টার গজিয়েছে। অনেক শিক্ষক আবার কোচিং করান, বা ব্যাচে প্রাইভেট পড়ান। অনেকে আর্থিক প্রয়োজনের জন্য করেন। অনেকে আবার এটিকে ব্যবসা হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। এতে শিক্ষকদের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। 

আমাদের বুঝতে হবে যে–বাংলাদেশটাকে একটি টেকসই অগ্রগতির ভিত্তি দিতে হলে প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার ক্ষেত্রে ভালো অবকাঠামো হয়েছে, প্রায় শতভাগ নারীকে শিক্ষার আওতায় আনা গেছে, বৎসরের শুরুতে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হচ্ছে। এখন প্রয়োজন গ্রামগঞ্জ, ও মফস্বলের স্কুল ও কলেজগুলোতে সবচেয়ে মেধাবী ও দক্ষদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করা। মাদ্রাসাও এ পরিকল্পনার বাইরে থাকা উচিত নয়। প্রত্যেকটি মাদ্রাসায় মেধাবী, যোগ্য ও উদারমনা শিক্ষক প্রয়োজন। আমাদের মনে রাখতে হবে—ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ আমল এবং তারও আগে অত্যন্ত মানসম্পন্ন মাদ্রাসা ছিল। রাজা রামমোহন রায়ের মতো পণ্ডিত ব্যক্তি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছিলেন। মাওলানা ভাসানী, কাজী নজরুল ইসলাম, মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, শওকত ওসমানসহ অনেক উদারমনা লেখক, সাহিত্যিক, ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার রাজনীতিবিদের পড়াশোনা শুরু হয়েছে মক্তব থেকে। অনেকে মাদ্রাসায়ও পড়াশোনা করেছেন।

রাজনীতির কথা বলছিলাম, বঙ্গবন্ধু, সোহরাওয়ার্দী ও তাজউদ্দীন আহমদের গণমানুষের রাজনীতি। সেই রাজনীতি আজ অবসরপ্রাপ্ত, ব্যবসায়ী, কর্মকর্তা, বাহিনী, গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ ও করপোরেট হাউজের হাতে চলে গেছে। বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়সহ অল্প কিছু উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষার মানটি ধরে রাখলেও, প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষার মান নিম্নগামী। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি ইউনিটের প্রকাশিত ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, ৯০ শতাংশ বা তারও অধিক শিক্ষার্থী পাসই করতে পারেনি। অথচ এদের অধিকাংশ গোল্ডেন জিপিএ ও জিপিএ-৫ পাওয়া। 

শিক্ষার মানের নিম্নগামিতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ছেলেমেয়েদের খেলার মাঠের অভাব, পাঠাগারের অভাব ও সুস্থ বিনোদনের অভাব। খেলার মাঠ ও পাঠাগারবিহীন যে সকল শিশু-কিশোর ও কিশোরী  ইউটিউব দেখে, ফেসবুকিং ও টিকটক করে বড় হচ্ছে তাদের চেতনা তো দুর্বল হবেই, তাদের মননে থাকবে প্রকৃত শিক্ষার আলোকোজ্জ্বল বিভার অভাব, তাদের মস্তিষ্কের কোষে কোষে ধর্মান্ধতার অন্ধকার থেকে যাওয়াও অস্বাভাবিক কিছু নয়। এই শিশু-কিশোর ও কিশোরীরা অনুসরণ করার মতো সাহসী, নিষ্ঠাবান, বলিষ্ঠ ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি বা নায়ক-নায়িকা খুঁজে পাচ্ছে না। ফলে তারা বেছে নিচ্ছে খলনায়ক ও খলনায়িকা। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী প্রতারকরা ঢুকে পড়ছে বঙ্গবন্ধুর দল ও পেশাজীবী সংগঠনগুলোতে। খন্দকার মোশতাকের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনকারী হয়ে যাচ্ছেন সর্বোচ্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি চরম মিথ্যাচার করা ব্যক্তি হয়ে যাচ্ছেন গাজীপুরের প্রভাবশালী মেয়র, শাহেদ, পাপিয়া ও হেলেনা জাহাঙ্গীরেরা দলে ঢুকে জাতীয় ও বৈশ্বিক প্রতারণার ফাঁদ পেতে অসংখ্য মানুষের সর্বনাশ করছেন।

খেলার মাঠ, পাঠাগার ও সুস্থ বিনোদনের অভাব ও অনুসরণ করার মতো ব্যক্তিত্ব খুঁজে না পেয়ে শিশু-কিশোরেরা ঝুঁকে পড়ছে ভিডিও গেমস, ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক, সহিংস কার্টুন, অশালীন চলচ্চিত্রের দিকে। ফলে তাদের শরীর, মন ও বুদ্ধিবৃত্তির যে সুস্থ বিকাশ প্রয়োজন সেটি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অনেকেই মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। দারিদ্র্যের কারণে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অনেক কিশোর ও কিশোরী ভয়ংকর সব অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে। এদিকে পারিবারিক ও সামাজিক নজরদারির অভাবে সচ্ছল পরিবারের কিশোরেরা জিরো জিরো সেভেন, ডিসকো বয়েজ, জেমস বন্ডসহ নানা নামে ‘কিশোর গ্যাং’ তৈরি করে চুরি, ডাকাতি, চাঁদাবাজি ও হত্যা করছে।

এই শিশু-কিশোরেরা ২৫ থেকে ৫০ জন একসাথে মোটরসাইকেল নিয়ে জোরে হর্ন বাজিয়ে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব তৈরি করছে। ভয়ে কেউ এদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে না। অভিভাবকরা কথা বলেন না, শাসন করেন না। রাজনৈতিকভাবে এদের ব্যবহার করা হয়। অপরাধীরাও এদের ব্যবহার করে। তারপর কোনও গ্যাং লিডারের হাতে কোনও কিশোর, বা শিক্ষক, বা নিরপরাধ কোন মানুষ খুন হলে শুরু হয় তুমুল হৈ চৈ। এভাবেই ২০১৭ সালে ঢাকার উত্তরায় আদনান কবির খুন হন, ২০১৯ সালে স্ত্রীর সামনে প্রকাশ্য দিবালোকে বরগুনায় খুন হন রিফাত শরীফ। এবার গ্যাং লিডার জিতুর হাতে খুন হলেন তারই শিক্ষক উৎপল কুমার সরকার। তিনি ছিলেন হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের পৌরনীতি ও সুশাসন বিষয়ের শিক্ষক। আর অভিযুক্ত হন্তারক আশরাফুল আহসান জিতু হচ্ছে ওই স্কুলের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী।

এই যে শিক্ষক অবমাননা, সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন, ধর্মান্ধতার অন্ধকার, কিশোর অপরাধ ও কিশোর গ্যাংয়ের বাড়বাড়ন্ত— সবকিছুরই সমাধান হচ্ছে গণমানুষের রাজনীতি, প্রকৃত শিক্ষার বিস্তার, সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা, মানবিক বোধের উন্মেষ এবং ধর্ম ও দর্শনের গভীর বোধ ও তার চর্চা। 

লেখক: অধ্যাপকআইন বিভাগঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এফডিসিতে মারামারি: যৌথ বৈঠকে যে সিদ্ধান্ত হলো
এফডিসিতে মারামারি: যৌথ বৈঠকে যে সিদ্ধান্ত হলো
বাংলাদেশকে ‘সিকিউরিটি প্রোভাইডার’ দেশ হিসেবে দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র
বাংলাদেশকে ‘সিকিউরিটি প্রোভাইডার’ দেশ হিসেবে দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র
আরও কমলো সোনার দাম  
আরও কমলো সোনার দাম  
 ১ পদে ২৩৮ জনকে চাকরি দেবে ভূমি মন্ত্রণালয়, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ
 ১ পদে ২৩৮ জনকে চাকরি দেবে ভূমি মন্ত্রণালয়, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ