X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ভাবনা

নাসরীন সুলতানা
০৩ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৬:৪০আপডেট : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৬:৫১

আমি খুব মনোযোগ দিয়ে আমাদের শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য শুনছিলাম। কথাগুলো নিরেট সত্যি, বাস্তব এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি তাঁর সঙ্গে শতভাগ একমত। বিশ্ব যেখানে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে গবেষণায় ব্যস্ত, সেখানে আমাদের দিনের বেশিরভাগ সময় কাটে নারীর পোশাকের দৈর্ঘ্য, এবং প্রস্থ নিয়ে। আমরা দিনে দিনে শিক্ষিত হচ্ছি, সভ্য হচ্ছি। আসলেই কি হচ্ছি?

গত সেমিস্টারে আমি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইথিক্স কোর্সের ‘টিচিং অ্যাসিসটেন্ট (টিএ)’ হিসেবে কাজ করি। এই কোর্সের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে বুঝেছি আমরা জাতি হিসেবে কতটা পিছিয়ে আছি, কত হাজার বছর পিছিয়ে আছি। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে যে সকল নীতিবিদরা কাজ করেন তাদের মূল ভাবনা হলো– আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের বহুল ব্যবহার এবং প্রসারের ফলে পৃথিবী এক সময় মানবশূন্য হয়ে যেতে পারে। কারণ ধীরে ধীরে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স মানুষের বিকল্প হয়ে উঠেছে, মানুষের জায়গা দখল করে নিচ্ছে।  

আমি যে বাসায় থাকি তার পাশেই একটা গ্রোসারি স্টোর। আমি যখন এখানে প্রথম আসি, তখন সেলফ চেক আউট কাউন্টার ছিল মাত্র একটি। গত মাসে তারা নতুন করে সেলফ চেক আউটের মেশিন বসিয়েছে ১০টি। এখন বাজারের বিল পরিশোধ করতে ক্রেতাকে আর অন্য কারও সাহায্য নিতে হয় না। নিজেই ক্রয়কৃত পণ্য স্ক্যান করে নিজের ক্রেডিট কার্ড দিয়ে বিল পরিশোধ করতে পারে। গতদিনই লক্ষ্য করলাম এই স্টোরে আগের তুলনায় স্টাফ সংখ্যা অনেক কম। কারণ, স্টাফের জায়গা মেশিন এখন দখল করে নিয়েছে। এতে করে তাদের প্রতি মাসে কর্মচারীর বেতন বাবদ যে টাকা খরচ হতো তার একটা বড় অংশ সাশ্রয় হচ্ছে।

অফিস কিংবা বাসা বাড়ির সিকিউরিটি থেকে শুরু করে গাড়ি চালানো পর্যন্ত আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ওপর মানুষ নির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছে। উন্নত বিশ্বে মানুষ এখন আর মানিব্যাগে টাকা ক্যারি করে না। কষ্ট করে টাকা গুণে সময়ও নষ্ট করতে হয় না। একটা ছোট্ট ক্লিক কিংবা ট্যাপে সেকেন্ডের মধ্যে হাজার হাজার ডলারের ট্রানজেকশন হয়ে যাচ্ছে। এমনকি অনেক কোম্পানিতে একাউন্টেন্ট নেই, তাদের হয়ে একাউন্টিংয়ের কাজ করে দিচ্ছে এক বিশেষ ধরনের সফটওয়্যার। বিশ্ব এখন ব্যস্ত– কী করে আরও সহজে এবং দ্রুততম সময়ে নিজেদের কাজ শেষ করা যায়। আর আমাদের সমস্ত মনোযোগ পাশের বাসায় বন্ধ দরজায় কী চলছে সেই দিকে। হাতে অফুরন্ত সময় থাকলে যা হয় আর কী।

যাইহোক, আমাদের কেন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে, রোবটিক্স নিয়ে চিন্তা করা উচিত, শিক্ষামন্ত্রীর সেই কথায় আসি। এই যে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স যে সব জায়গায় মানুষের স্থান দখল করে নিচ্ছে, জব মার্কেটে মানব সম্পদের বিকল্প হয়ে উঠেছে, এর ফলাফল কিন্তু সুদূর প্রসারী। এই অবস্থা চলতে থাকলে বেকারত্ব বাড়তে থাকবে, বেকারত্ব বাড়লে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর তার প্রভাব পড়বে, সমাজে অপরাধ বাড়বে। ধীরে ধীরে মানবজাতির অস্তিত্ব সংকটাপূর্ণ হয়ে পড়বে।

একটু ভেবে দেখুনতো আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দিনে কত সময় নষ্ট করছি। ফেসবুকে ১ মিনিটের জন্য লগইন করলেও কোন দিক দিয়ে ১/২ ঘণ্টা পার করে দিচ্ছি সেটা টের পাচ্ছি না। আর এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশি সময় কাটানোর কারণে প্রকৃতপক্ষে মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হচ্ছে, পারিবারিক এবং সামাজিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

অন্যদিকে বিভিন্ন সাইটে জেনে বা না জেনে ক্লিক করার কারণে আমরা আমাদের প্রতিদিনের কর্মকাণ্ড ইন্সিকিউরড করে ফেলছি। আমার কী পছন্দ, কোন রেস্টুরেন্টে কবে খেয়েছি, এই সব কিছু রিড করার জন্য এমনভাবে অ্যালগোরিদম সেট করা যে আমরা নিজের অজান্তেই প্রতি মুহূর্তে অন্যের নজরদারিতে আছি, নিজের প্রাইভেসি বলে আর কিছু নেই।

বিজ্ঞানীদের একটা বড় অংশ ব্যস্ত কী করে রোবটের মধ্যে মানবজাতির মতো ইমোশন ইন্ডিউস করা যায় সেটা নিয়ে। এমনকি ভবিষ্যতে মানুষের পরিবর্তে সঙ্গী হিসেবে মানুষ রোবটকে বেছে নেবে কিনা সেটাও অনেকটা ভাববার বিষয়। কেননা, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মধ্যে যদি এমনভাবে প্রোগ্রাম ইন্ডিউস করা হয় যাতে করে তারা মানুষের মতো আনন্দ, বেদনা, রাগ, অভিমান প্রকাশ করতে পারবে। ফলে, রোবট হতে পারে ভবিষ্যতে মানুষের যোগ্যতম সঙ্গী।

প্রতিটা জিনিসেরই কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আছে। নীতিবিদরা মনে করেন, রোবটকে যদি মানুষের মতো বুদ্ধিমত্তার সাথে সাথে ইমোশনাল স্ট্যাটাসও দেওয়া হয়, তাহলে এক সময় তারা তাদের করুণ পরিণতির জন্য মানুষকে দায়ী করবে। তারা কেন তার মনিবের আদেশ অমান্য করতে পারবে না, কেন তাকে আদেশ বা সিগন্যাল অমান্য করার অধিকার দেওয়া হয়নি, সেটার জন্য সে তার সৃষ্টিকর্তাকে (মানুষ) দায়ী করবে। অর্থাৎ, তাকে যদি মানুষের মতো চিন্তার স্বাধীনতা দেওয়া হয়, তাহলে সে এক সময় তার পরিণতির জন্য মানুষের সাথে বিদ্রোহ করবে, যেমন করে একটি কারখানায় শ্রমিকেরা মালিক পক্ষের সঙ্গে বিদ্রোহ করে। সুতরাং, একটা রোবট যদি মানুষের মতো ইমোশনাল আচরণ করে, এবং সে যদি মানব জাতিকে তার জন্য হুমকি মনে করে, সে যদি মানুষের চেয়ে বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে তাহলে ভাবুনতো– আমাদের ভবিষ্যৎ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। একদিকে অফিস, বাড়ি, রাস্তা সব জায়গায় তাদের আধিপত্য, অন্যদিকে তারা আমাদের শত্রুপক্ষ। এই অবস্থায় আমাদের অস্তিত্বের সংকট সবচেয়ে বড় সংকট।

আপনি ভাবতেই পারেন– আমাদের দেশে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের বহুল ব্যবহার হবে না, অতএব আমরা বেঁচে যাবো। নগর যখন পুড়ে দেবালয় কি বাদ যায়?

বাংলাদেশের মানুষ যত বেশি ফেসবুকে সময় কাটায় এত বেশি সময় অন্য কোনও দেশের মানুষ কাটায় কিনা আমার জানা নেই। কানাডাতে কেউ কাউকে মোবাইলে কল দিলে আগে অনুমতি নিয়ে, তার সময় বুঝে কল দেয়, কিন্তু আমাদের কাউকে কল দিতে রাত, দিন কিংবা সময় অসময় লাগে না। তাই আমার কাছে মনে হয়, অন্যান্য জাতির তুলনায় আমরা আরও বেশি হুমকির মধ্যে আছি। শৌখিন জাতি হিসেবেও আমাদের অনেকেরই শখ হবে বাসায় চা বানানোর জন্য, ঘর পরিষ্কার করার জন্য, কিংবা নিজের স্ট্যাটাস বুঝানোর জন্য দুই তিনটা রোবট ঘরে সাজিয়ে রাখা।

অতএব, আমাদের উচিত সময় থাকতে নিজেদের অস্তিত্ব কী করে টিকিয়ে রাখা যায় সে দিকে নজর দেওয়া। এখন কথা হচ্ছে, আমরা এই বিষয়গুলো নিয়ে কেন ভাবি না? কারণ আমাদের শিক্ষার দৈন্য। আমাদের জীবন থেকে ধীরে ধীরে নৈতিক শিক্ষা বিয়োগ হয়ে যাচ্ছে। কোনটা নিয়ে কথা বলা যায়, কোনটা নিয়ে কথা যায় না আমাদের সেই শিক্ষা নেই। আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। কিন্তু আমি বুঝতে পারি সেই সময়ে নারীর পোশাক নিয়ে গবেষণা করার চেয়ে দেশকে কীভাবে স্বাধীন করা যায় সেদিকে সবার মনোযোগ ছিল বেশি। ঠিক একইভাবে এই মুহূর্তে আমাদের সংকট মানব জাতির অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখা, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি সুন্দর পৃথিবী উপহার দেওয়া। আমাদের স্বেচ্ছাচারী আচরণ আর প্রযুক্তি নির্ভরতা যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অভিশাপ না হয়ে ওঠে সে দিকে মনোযোগ দেওয়া। দেশ স্বাধীন হয়েছে, এবার আমরা নিজেরা স্বাধীন হই।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়; পিএইচডি শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন ওন্টারিও, কানাডা

Email: [email protected]

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
নির্বাচনের সময় জাপায় কী হয়েছিল, জানাবেন জিএম কাদের
শনিবার জাতীয় পার্টির বর্ধিত সভানির্বাচনের সময় জাপায় কী হয়েছিল, জানাবেন জিএম কাদের
১০ কোটি টাকা অনিয়মের অভিযোগে অগ্রণী ব্যাংকের ৩ কর্মকর্তা আটক
১০ কোটি টাকা অনিয়মের অভিযোগে অগ্রণী ব্যাংকের ৩ কর্মকর্তা আটক
থাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শেখ হাসিনাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা
থাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শেখ হাসিনাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা
পশ্চিমাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চীনকে যা করতে হবে
পশ্চিমাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চীনকে যা করতে হবে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ