X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

সন্তানদের দিকে পর্যাপ্ত নজর কি দিচ্ছি?

শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন
১৭ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৭:৪৩আপডেট : ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৭:৪৩

করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হওয়ার পরে জাতীয়, ও সামাজিক জীবনের সর্বত্র নানা ধরনের সংকট শুরু হয়। প্রধান চেষ্টা ছিল জীবন রক্ষা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও অর্থনীতির চাকা সচল রাখা। শিক্ষা, পারিবারিক জীবন-জীবিকা, যোগাযোগ, উৎপাদন, রাজনীতি, পর্যটন, বিচার, ও পুলিশি সেবা– সকল ক্ষেত্রেই নানা ধরন ও মাত্রার সংকট তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সবচেয়ে কম গুরুত্ব পেয়েছে স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা। আরও বেশি নজর এড়িয়ে গেছে শিশু ও কিশোরদের আবেগ, অনুভূতি, চাওয়া-পাওয়া, হতাশা ও প্রত্যাশা। বাবা-মা ও গুরুজনেরা সারাক্ষণ বকাঝকা করেছেন– ‘পড়ো, পড়ো, আর পড়ো, পরীক্ষায় ভালো করতেই হবে, জিপিএ ৫ পেতেই হবে।’

শিশু-কিশোরেরা স্কুলে যেতে পারছে না, বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে পারছে না, খেলার মাঠে যেতে পারছে না, করোনার কারণে গৃহবন্দী। এদিকে ঘরের মধ্যে বাবা-মায়ের ঝগড়া, অনেক পরিবারে বাবা পেটাচ্ছেন সন্তানদের মাকে। বাচ্চাদের ওপর পড়ার চাপ, মানসিক চাপ, খেলাধুলার ব্যবস্থা নেই। এত এত স্ট্রেস অনেক বাচ্চা নিতে পারেনি। তার মর্মান্তিক ফলাফল হচ্ছে গত ৮ মাসে ৩ শ’ ৬৪ জন শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা। নানা কারণে শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যা করেছেন। প্রধান কয়েকটি কারণ হচ্ছে – প্রেমঘটিত সম্পর্কের টানাপোড়েন, বাবামায়ের প্রতি অভিমান, শিশু-কিশোরদের প্রত্যাশা পূরণ না হওয়া। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, ছেলে মোবাইল ফোন বা মোটরসাইকেল চেয়েছে, বাবা সেটি দিতে পারেননি বলে অভিমান করে ছেলে আত্মহত্যা করে ফেললো।

করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হওয়ার পরে লকডাউন, নানা ধরনের উৎকণ্ঠা, ঘর থেকে বেরুতে না পারা– এসব কারণে হাজার হাজার শিশু ও কিশোর শিক্ষার্থী হিসবে তাদের সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের যে ছন্দ সেটি হারিয়ে ফেলেন। প্রতিদিন সকালে বা দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে স্কুল বা কলেজে যাওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে আদান-প্রদান, ঘরে ফিরে পরের দিনের হোম টাস্ক সম্পন্ন করা– এভাবে তরুণ শিক্ষার্থীরা তাদের সময় কাজে লাগাতেন, কালের নিয়মে চলে যেত সপ্তাহ, মাস ও বছর। কিন্তু করোনার ফলে শিশু কিশোরদের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদের সামনে চলে আসে অফুরন্ত অবসর। এই অবসর তারা কীভাবে কাজে লাগাবেন, তাদের অধিকাংশ এটি জানতেন না। অনেকে ঘরে বসে থেকে নিঃসঙ্গতার ফলে বিষণ্ণতায় ভুগতে শুরু করেন। অনেকে মাদকের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন। নানা শিক্ষার্থীর নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়।

‘আমি যদি বন্ধুদের সঙ্গে ভালোভাবে মিশতে পারতাম, তাহলে এটা হতো না। এখন আমি অধঃপতিত হলাম। আমি আপনাদের কাছে একদম ক্ষমার অযোগ্য, তবুও সবার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।’– এমন একটি চিরকুট লিখে গত জানুয়ারি মাসে আত্মহত্যা করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন সায়েন্সেস ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী অনিক চাকমা। এ ঘটনায় দেখা যাচ্ছে যে, সহপাঠী বা ভালো বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মিশতে পারলে অনিক চাকমার মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক থাকত। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তিনি ‘কোয়ালিটি টাইম’ বা মানসম্পন্ন সময় কাটাতে পারতেন। সহপাঠীদের সঙ্গে পড়াশোনা নিয়ে যেমন আলোচনা করতে পারতেন, তেমনি তাদের সঙ্গে আড্ডা দিতে পারলে তার মনও ফুরফুরে থাকত। ফলে তিনি আর আত্মহননের পথে পা বাড়াতেন না। করোনা মহামারি আমাদের এমন সব ভয়াবহ ক্ষতি করেছে, যার অনেক কিছু দৃশ্যমান, এবং যা পরসিংখ্যান দিয়ে বোঝা যায় বা টাকার অংকে পরিমাপ করা যায়। আবার করোনা এমন অনেক ক্ষতি করেছে যেটি চোখে দেখা যায় না। তার মধ্যে একটি হচ্ছে মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি। এটি সব বয়সের মানুষের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেললেও শিশু ও কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এটির পাশাপাশি গ্রামঞ্চলের অনেক কিশোরী বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছেন।

আঁচল ফাউন্ডেশন নামের একটি বেসরকারি সংস্থার জরিপ অনুযায়ী, ২০২১ সালে দেশে ১ শ’ ১ জন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। ২০২০ সালে এই সংখ্যা ছিল ৪২জন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপ বলছে, দেশে বছরে প্রায় ১৩ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করেন। সংস্থাটির হিসেব অনুযায়ী, শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার এই প্রবণতা বাড়ছে। আর দেশে করোনা মহামারি শুরুর পর এ প্রবণতা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে।

আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারাকে আত্মহত্যার অন্যতম বড় কারণ হিসেবে দায়ী করেন আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, করোনার সময়ে দীর্ঘদিন ঘরে বসে থেকে অনেকের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন এসেছে। অনেকের রাগ বেড়ে গেছে, মানসিকভাবে সহজেই ভেঙে পড়ার হারও বেড়েছে, সেই সঙ্গে বেড়েছে পড়াশোনার চাপ। শিক্ষার্থীরা সবকিছু একসঙ্গে সামাল দিতে পারছে না বলেই তুলনামূলক আত্মহত্যার হার বাড়ছে।

আঁচল ফাউন্ডেশনের জরিপে এ বছরের প্রথম আট মাসে আত্মহত্যা করা তিনশ ৬৪  শিক্ষার্থীর মধ্যে একশ ৯৪ জন (৫৩ দশমিত ৩০ শতাংশ) স্কুলের। কলেজ শিক্ষার্থী ২০ দশমিক ৮৮ শতাংশ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩ দশমিক ৭৪ শতাংশ এবং মাদ্রাসার ১২ দশমিক ০৯ শতাংশ। ২০২১ সালে ছাত্রীদের চেয়ে ছাত্রদের আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি ছিল। আর নতুন তথ্য বলছে, ছাত্রীদের মধ্যে এই হার বেশি। এবছর আত্মহত্যা করা ৬০ দশমিক ৭১ শতাংশই (২২১ জন) ছাত্রী। বাকি ১৪৩ জন ছাত্র।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান জোবেদা খাতুনের মতে, করোনার দুই বছর শিক্ষার্থীরা ঘরে বসে থাকার পর স্কুল-কলেজ খুলেই পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু মানসিকভাবে তাদের প্রস্তুত করা হচ্ছে না। নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘অন্তত ১৫ জন শিক্ষার্থী আমার কাছে বলেছে, তাদের পরীক্ষার প্রস্তুতি নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আছে পরিবারের চাপ। এত চাপ তাদের সামাল দেওয়ার মানসিক অবস্থা তো থাকতে হবে। ফলে হতাশা থেকেই তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা তৈরি হচ্ছে।’’ (ডয়েচে ভেলে, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২২)

প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ্য যে, কয়েকটি ইংরেজি শব্দের শেষের অংশটি হচ্ছে ‘সাইড’ (‘cide’), আর এ প্রত্যেকটি শব্দের অর্থ ভয়ংকর; যেমন, ‘হমিসাইড’, ‘সুইসাইড’ ও ‘জেনোসাইড’। এর প্রথমটির অর্থ হত্যা, দ্বিতীয়টির অর্থ আত্মহত্যা, এবং তৃতীয়টির অর্থ অগণন মানুষের নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও গ্লোবাল বারডেন অব ডিজিজ স্ট্যাডির হিসাব অনুযায়ী নানা কারণে প্রতি বছর ৮ লাখ লোক আত্মহত্যা করেন। অর্থাৎ প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন মানুষ আত্মহত্যা করেন!

বয়স্ক ও তরুণ– এ দুই বয়সের মানুষের মধ্যেই আত্মহত্যার প্রবণতা অধিক পরিলক্ষিত হয়; আবার লিঙ্গভিত্তিক বিভাজনে বৈশ্বিকভাবে আত্মহত্যার প্রবণতা নারীর চেয়ে পুরুষের মধ্যে দ্বিগুণের বেশি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৭ সালে প্রতি লাখের মধ্যে নারী আত্মহত্যার হার ছিল ৬.৩, অথচ পুরুষ আত্মহত্যার হার ১ লাখের মধ্যে ছিল ১৩.৯। বিভিন্ন দেশের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, প্রতি বছর ৪ লাখের বেশি মানুষ ‘হমিসাইড’ বা হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। গ্লোবাল বারডেন অব ডিজিজের স্ট্যাডি অনুযায়ী ২০১৭ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৪ লাখ ৫ হাজার মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন যা সশস্ত্র সংঘর্ষ ও সন্ত্রাসী হামলায় নিহত মানুষের সম্মিলিত সংখ্যার তিন গুণ বেশি। এরপর আসা যাক জেনোসাইড বা গণহত্যা প্রসঙ্গে। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পৃথিবীর ১৫টি ভয়াবহতম গণহত্যায় ১৫ কোটি ৮৩ লাখ ৫০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়।

হত্যা, গণহত্যা ও আত্মহত্যার ইতিহাস হচ্ছে ব্যক্তিক, পারিবারিক ও সামষ্টিক বিয়োগান্ত ঘটনার আলেখ্য। হত্যার কারণ পারস্পরিক স্বার্থবিষয়ক দ্বন্দ্ব-সংঘাত, আর গণহত্যা হয়ে থাকে ধর্ম-বর্ণ, ও গোত্রভিত্তিক ঘৃণা-বিদ্বেষ, দেশ দখল, এবং বর্তমান সময়ে বাজার দখলকে কেন্দ্র করে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে– মানুষ আত্মহত্যা কেন করে? এমন কী পরিস্থিতি তৈরি হয় যখন মানুষ নিজেই তার নিজের জীবন নিয়ে নেয় বা নিয়ে নিতে বাধ্য হয়? কোনও সুইসাইড নোট বা প্রামাণিক কারণ না থাকলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে যে ব্যক্তি আত্মহত্যা করেছেন, সে ছাড়া আত্মহত্যার কারণ জানা সম্ভব নয়। তবে করোনা মহামারি চলার সময়ে এবং করোনা পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে আত্মহত্যাগুলো হয়েছে, সেগুলোর প্রধান কারণ হচ্ছে, শিশু-কিশোরদের মনের ওপর নানা ধরনের চাপ এবং সেই চাপ সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার ঘাটতি। আমাদের বুঝতে হবে যে, শিশুরা হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ। তাদের শারীরিক, মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের জন্য আমাদের যা কিছু করা দরকার, আমাদের সেটি করতে হবে।

লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
বাংলাদেশে আইসিটির ভবিষ্যৎ কেন হুমকির মুখে?  
বাংলাদেশে আইসিটির ভবিষ্যৎ কেন হুমকির মুখে?  
মস্কোতে কনসার্টে হামলা: ৯ সন্দেহভাজনকে আটক করলো তাজিকিস্তান
মস্কোতে কনসার্টে হামলা: ৯ সন্দেহভাজনকে আটক করলো তাজিকিস্তান
চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন
চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ