X
রবিবার, ১১ মে ২০২৫
২৮ বৈশাখ ১৪৩২

গুম-হত্যার অভিযোগ কার মুখে শুনি

মোস্তফা হোসেইন
০২ অক্টোবর ২০২২, ১৬:৩৯আপডেট : ০২ অক্টোবর ২০২২, ১৬:৫৬

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের কিছু শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাকে সে দেশে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। নিজ দেশে অহরহ বিচারহীন হত্যা হলেও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ তাদের। এদিকে দেশের রাজনৈতিক মঞ্চগুলো দিনের পর দিন কঠোর সুরে ‘গুম-হত্যা-অপহরণের’ বিরুদ্ধে সরগরম। সুযোগ পেলেই আওয়ামী লীগ সরকারকে গুমের রাজনীতির প্রবর্তক বানাতে কসুর করছে না। এই মুহূর্তে যে মানুষটি পত্রিকা পড়ছেন কিংবা বিএনপির সমাবেশে গিয়ে বক্তৃতা শুনছেন তারা স্পষ্টতই ধরে নেবেন, গুম নামক বিশেষণটি তৈরিই হয়েছে আওয়ামী লীগের হাতে। তারা এমনও ভাবতে পারেন, ইতোপূর্বে প্রতিটি সরকারের আমলই এমন অমানবিক বিষয়টি থেকে অনেক দূরে ছিল। বিশেষ করে বিএনপি যখন বলে, আওয়ামী লীগ টিকে আছে গুমের রাজনীতি মাধ্যমে তখন কারও কারও এমনটাই বিশ্বাসও হতে পারে।

খুব আগ্রহ জাগে এই অক্টোবরে কি গুম খুন নিয়ে তারা কোনও কথা বলবেন? অক্টোবর প্রসঙ্গটি আনার কারণ আছে। ১৯৭৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিন থেকে শুরু হয়েছিল ব্যাপক আকারে রাষ্ট্রীয়ভাবে গুম আর হত্যা। তার আগেও হয়েছে, তবে সংখ্যায় কম। আর তখন এই দেশের প্রেসিডেন্ট এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ছিলেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। ৩০ সেপ্টেম্বর বগুড়ায় একটি অভ্যুত্থান হয়েছিল জিয়া বাহিনীর বিরুদ্ধে। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নির্বিচারে খুন শুরু করলেন। এন্থনি ম্যাসকারানহাস ‘অ্যা লিগেসি অব ব্লাড’ বইয়ে স্পষ্ট উল্লেখ করলেন, বগুড়া অভ্যুত্থানের সূত্র ধরে পরবর্তী দুই মাসে ১১৪৩ জন সৈনিককে মৃত্যুদণ্ড ভোগ করতে হয় একজন জেনারেলের এক কলমের খোঁচায়।  

অক্টোবরের ২ তারিখে হলো আরেকটা অভ্যুত্থান। বিমান বাহিনীর ইতিহাস বইয়ে তথ্য প্রকাশ হয়েছে, সেই অভিযোগে ৫৬১ জনকে হত্যা করা হয়। অন্যান্য গ্রন্থে উল্লেখ আছে সেনাবাহিনী ও অন্যদের নিয়ে এই অভিযোগে ১৩০০ জনকে হত্যা করা হয়। কতটা নৃশংস ছিল সেই চিত্র।

১৯৭৭ সালের ৯ অক্টোবর থেকে এই ফাঁসি কার্যকর হতে থাকে। তখন ভারপ্রাপ্ত ডিআইজি প্রিজন ছিলেন ফয়েজ আহমেদ চৌধুরী। জায়েদুল আহসানের লেখা ‘রক্ত পিচ্ছিল অন্ধকার’ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে, ফয়েজ আহমদ চৌধুরী এই গণহত্যা নিজ চোখে দেখার পর অসুস্থ হয়ে পড়েন। শুধু তাই নয়, তাকে বাধ্য হয়ে ছুটি নিতে হয়। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান রাতারাতি জেল কোড পরিবর্তন করেন হত্যাকাণ্ড চালানোর জন্য। নতুন জেল কোড অনুযায়ী ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্টকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ফাঁসিগুলো কার্যকর করতে। অন্থনি মাসকারানহাস-এর লেখা ‘অ্য লিগেসি অব ব্লাড’, আনোয়ার কবিরের লেখা ‘সশস্ত্র বাহিনীতে গণহত্যা’ ও জায়েদুল আহসানের লেখা ‘রক্ত পিচ্ছিল অন্ধকার’ বই থেকে নেওয়া তথ্যগুলো নিবন্ধে উপস্থাপন করা হচ্ছে।

যারা মনে করেন, সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠার জন্য এমন হতেই পারে, তাদের উদ্দেশে বিএনপির সাবেক নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের লেখা ‘ডেমোক্র্যাসি অ্যান্ড দ্য চ্যালেঞ্জ অব ডেভেলপমেন্ট’ বইটি পড়তে অনুরোধ করছি। বিএনপির সাবেক স্থায়ী কমিটির সদস্য, বিএনপির অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ স্পষ্টত লিখেছেন, অভ্যুত্থানের দায়ে সেনাবাহিনীর ৪৮৮ জনকে ফাঁসি নয়তো ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। তিনি লিখেছেন, ‘জিয়া যাঁকে সন্দেহ করেছেন তাঁকেই ‘কঠোর’ শাস্তি দিয়েছেন।’ আশা করি যারা চেইন অব কমান্ডের যুক্তি দেখান তারা বিএনপির সাবেক নেতা ও প্রয়াত ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের উক্তিটি বিশ্লেষণ করতে পারেন।

আসলে জিয়াউর রহমান অভ্যুত্থানকে হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। এই হত্যাকাণ্ডগুলোর প্রধান শিকার হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা সৈনিকেরা। সেখানেও তার কূট রাজনৈতিক অভিলাষ বাস্তবায়নের লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে যায়। জিয়াকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে টিকে থাকতে হলে, এমনকি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবেও টিকে থাকতে হলে সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী ও নৌবাহিনীর সমর্থন প্রয়োজন হবে। তিনি সেনানিবাসের আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন, সশস্ত্র বাহিনীতে ৩৬ হাজার সদস্যের মধ্যে ২৮ হাজারই পাকিস্তান ফেরত। তারা মুক্তিযোদ্ধা সৈনিকদের পদোন্নতি এবং বেতন বৃদ্ধিকে মেনে নিতে পারেনি। যে কারণে মুক্তিযোদ্ধা সৈনিকদের প্রতি চাপা ক্ষোভ ছিল তাদের। মুক্তিযোদ্ধারা সংখ্যায় কম হলেও তাদের অবস্থান ছিল সঙ্গত কারণেই ঊর্ধ্বে। সেনানিবাসে এমন অবস্থাটাকেই তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করলেন জিয়া। নিজে মুক্তিযোদ্ধা হয়েও মুক্তিযোদ্ধাদের শায়েস্তা করতে মোটেও দ্বিধা করলেন না তিনি। তার কাছে তখন মুক্তিযুদ্ধের চেয়েও অধিক বড় মনে হতে থাকে প্রেসিডেন্টের সিংহাসন।

কতটা নৃশংস হতে পারে একজন মানুষ! ফাঁসি দেওয়া মানুষটির মৃত্যুর পর সে শত্রু-মিত্রের ঊর্ধ্বে চলে যায়। তাকে অন্তত ধর্মীয় রীতিনীতি অনুযায়ী দাফন-সৎকারের সুযোগ দেওয়া হয়। একাত্তরে যেমন পাকিস্তানি বাহিনী খুন কিংবা সৎকার-দাফনের কথা ভাবেনি, তেমনি জিয়াউর রহমানও ভাবেননি। একাত্তরে যেমন হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে, জিয়াউর রহমানের সেই গণহত্যা চালানোর সময়ও ধর্মীয় বিষয়গুলোও উপেক্ষা করা হয়েছে। সামরিক আইনে হয়তো আছে অপরাধী সাব্যস্ত হওয়ার পর কাউকে ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করা হলে তার লাশটি অন্তত নিকটজনের হাতে পৌঁছে দিতে হয়। অন্তত মানবিক বিষয়টি থাকার কথা। কিন্তু জিয়াউর রহমান সেই সাধারণ মানবিকতাটুকু পর্যন্ত দেখাননি সেসব হতভাগাকে।

মওদুদ আহমদের বক্তব্য অনুযায়ী যাকেই তার সন্দেহ হয়েছে তাকেই চোখ বেঁধে নিয়ে আসা হয়েছে। প্রহসনের বিচারালয়ে তাদের বিচার করা হয়েছে নির্দেশ অনুযায়ী। আর মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে।

এমন তথ্যও পাওয়া যায়, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জল্লাদরা ফাঁসি কার্যকরে কুলিয়ে ওঠতে না পারায় এবং দ্রুত ফাঁসি কার্যকর করতে কুমিল্লা কারাগারে নিয়ে অন্তত ৭২ জনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছে।

যাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তার পরিবার জানতে পারেনি, তার প্রিয়জনের পরিণতি কী হয়েছে। অনেক পরিবার আছে যারা আজও জানে না তাদের প্রিয়জন বেঁচে আছেন কিনা কিংবা হত্যা করা হলে কোন অপরাধে তাদের হত্যা করা হয়েছে। কিছু ভাগ্যবান পরিবারের সদস্য হয়তো তার প্রিয়জনের দাফনের দুই চার মাস পর জানতে পেরেছে তাদের  অভিযুক্ত করা হয়েছে এবং তাদের বিচার হয়েছে। এমন দু’চার লাইনের একটি চিঠি মাত্র। কিন্তু কোথায় তাদের দাফন হয়েছে কিংবা কবে হত্যা করা হয়েছে কিছুই জানানো হয়নি তাদের। চিঠিগুলোতে হত্যা কিংবা ফাঁসির বিষয়ও উল্লেখ ছিল না।

সেনাবাহিনীর সিগন্যাল কোরের সৈনিক রণজিৎ কুমার বৈদ্য এবং সার্জেন্ট মৃণাল কান্তিকে যথাক্রমে ১৬ অক্টোবর এবং ২৩ অক্টোবর ফাঁসি দড়িতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়, তাদের পরিবারের সদস্যদের কাছে মৃতদেহ হস্তান্তর করা হয়নি। কিংবা সনাতন ধর্ম অনুযায়ী তাদের সৎকারও করা হয়নি। তাদের মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে আজিমপুর কবরস্থানে।

দ্রুততার সঙ্গে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানোর সময় অভিযুক্তের নামে নাম অন্য ব্যক্তিকেও ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হয়েছে। কী নৃশংসতার উদাহরণ হতে পারে এমনটি? কর্পোরাল আফতাব নামের একজনকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে, যেখানে অন্য কর্পোরাল আফতাব ছিল অভিযুক্ত।

অনেকেই জানে না জিয়াউর রহমানের পুরো শাসনামলে কেন রাতে কারফিউ বলবৎ ছিল। ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করার পর তাদের রাতেই দাফন করা হতো। যে কারণে গোপনীয়তা রক্ষায় সামরিক সরকার পুরো শাসনকালেই রাতে কারফিউ চালু রেখেছিল। শুধু তাই নয়, যাতে কোনও পরিবার পরিজন কবর চিহ্নিত না করতে পারে সেই জন্য কবরস্থানগুলোতে সেনারা পাহারায় থাকতো।

জিয়াউর রহমান প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে ফাঁসি দেওয়ার মধ্য দিয়ে যে হত্যাকাণ্ড শুরু করেছিলেন সেই হত্যাকাণ্ড জিয়াউর রহমানের মৃত্যুকে কেন্দ্র করেও চলতে থাকে। জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডে ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়, যাদের কেউ কেউ ঘটনাস্থলে তো নয়ই, নিজ গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। তাকে গ্রামের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে তথাকথিত কোর্ট মার্শালে তোলা হয়। তখন তিনি জানতে পারেন, জিয়া হত্যাকাণ্ডের তিনি একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি।

যাদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তাদের পরিবার পরিজন আজও জানেন না তাদের প্রিয়জনকে কীভাবে কোথায় দাফন করা হয়েছে। কিংবা তিনি আদৌ জীবিত আছেন কিনা, সেই পরিবারগুলোর সামনে তাদের আত্মীয়-স্বজনের সামনে গুম হত্যাকাণ্ডের উদাহরণ আর কী হতে পারে।

তবে এসব হত্যাকাণ্ডে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে বলে মনে করে না। বরং চুপ থেকে খুনিদের সমর্থন করেছে। অন্যদিকে পাকিস্তান তো মুক্তিযোদ্ধাদের ফাঁসি হতে দেখে কপট হাসিই হাসছে। তারা নিশ্চয়ই বলেছে, দেখো একাত্তরে আমাদের অসমাপ্ত কাজটি তোমাদের দেশের মানুষই করছে। একাত্তরে আমরা ছিলাম আর এখন আছে আমাদের আদর্শধারীরা, যারা দেখতে শুনতে এবং বলনে চলনেও তোমাদেরই মতো। শুধু তাই নয়, ওই হত্যাকাণ্ডের নায়কও একজন মুক্তিযোদ্ধা।

এমন পরিস্থিতিতে গুম হত্যার কথা বললে তাকে সেদিনের কথা ভাবতে হবে। বাংলাদেশে এত গুম হত্যা কি আর কখনও হয়েছে? ভয়াল অক্টোবরের কথা ভুলে গিয়ে বিএনপি কি এখনও বলবে, আওয়ামী লীগই গুম হত্যা অপহরণের রাজনীতি করে।

লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বিএনপির নেতার মারধরে যুবদল নেতা আহত
বিএনপির নেতার মারধরে যুবদল নেতা আহত
কালবৈশাখী ঝড়ে গাছ পড়ে দুই জনের মৃত্যু 
কালবৈশাখী ঝড়ে গাছ পড়ে দুই জনের মৃত্যু 
প্রথম বিদেশ সফরে মধ্যপ্রাচ্য যাচ্ছেন ট্রাম্প
প্রথম বিদেশ সফরে মধ্যপ্রাচ্য যাচ্ছেন ট্রাম্প
পাকিস্তান সফরের জন্য আমরা প্রস্তুত, বাকিটা বোর্ড জানে: সালাউদ্দিন
পাকিস্তান সফরের জন্য আমরা প্রস্তুত, বাকিটা বোর্ড জানে: সালাউদ্দিন
সর্বশেষসর্বাধিক