X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিলাসী প্রকল্প বনাম নেশাগ্রস্ত পথশিশু

লীনা পারভীন
২৩ অক্টোবর ২০২২, ১৯:৩৮আপডেট : ২৩ অক্টোবর ২০২২, ১৯:৩৮

দেশের সাধারণ মানুষের জীবনে এখন ‘বিলাসী’ শব্দটি উচ্চারণ করাই এক ধরনের বিলাসিতার মতো হয়ে উঠেছে। নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যের যে অবস্থা তাতে কোনোরকম তিনবেলা খাবারের সংস্থানের লড়াইয়ে আছে বেশিরভাগ মানুষ। বিপরীতে আয়ের হিসাবটি কিন্তু একদমই তলানীতে আছে। আয় তো গত আড়াই বছরে বাড়েইনি বরং অনেকের কমেছে। তবে মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে তুলনা করলে প্রায় সবারই আয় কমেছে বলেই বিশ্বাস। মুদ্রাস্ফীতি ও মূল্যস্ফীতি যেন লাগামছাড়া হয়ে যাচ্ছে।

আমরা বুঝি যে এটা কেবল একা বাংলাদেশের সমস্যা নয়। বৈশ্বিক সংকটকালে আপনি চাইলেও কোনোভাবেই ভালো থাকতে পারবেন না। কিন্তু বৈশ্বিক সংকটের সময়ে যখন আমরা সাধারণ মানুষ দিন গুজরান করতেই ত্রাহি ত্রাহি অবস্থায় চলে যাচ্ছি। লাইফ স্টাইলের বেসিক স্তরে আছে এখন বেশিরভাগ মানুষ। অথচ ঠিক সেই সময়েই যখন সংবাদে প্রকাশিত হয় যে আমাদের দুইজন সরকারি কর্মকর্তার বাসভবন নির্মাণের ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৩ কোটি টাকা যেখানে ৫ কোটি টাকা ব্যয় হবে কেবল বিলাসবহুল সুইমিংপুল নির্মাণে। ঠিক এমন একটি সংবাদ আমাদের সাধারণ মানুষের মনে অসন্তোষ সৃষ্টি করে।

আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত বিচক্ষণ একজন নেতা ও দিকনির্দেশক। তিনি অনেক আগে থেকেই বৈশ্বিক মন্দার ইঙ্গিত দিয়ে সবাইকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে সচেতন হবার অনুরোধ করে যাচ্ছেন। সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যয় সংকোচন নীতির ওপর নির্দেশনা জারি করেছেন। এর সবগুলোই প্রশংসনীয় উদ্যোগ এবং আমরা সাধারণ মানুষ সান্ত্বনা পাই যে আমাদের মাথার ওপর যিনি আছেন তিনি অন্তত সহানুভূতিশীল সবার প্রতি। সরকারের অনেক প্রকল্প স্থগিত করা হয়েছে। অনেক প্রকল্পের ব্যয় কমানো হচ্ছে। কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ কমানো হয়েছে। এর সব উদ্যোগই আগামীর সংকট মোকাবিলায় সরকারের সচেতনতাকে ইঙ্গিত করে।

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন আমাদের তেল ব্যবহারের বিকল্প খুঁজতে। বিদ্যুতের সংকট ইতোমধ্যে প্রকট। লোডশেডিংয়ের শিডিউল মানা সম্ভব হচ্ছে না। আছে গ্যাসের সমস্যা। ধীরে ধীরে এমন সংকট আরও তীব্রই হবে হয়তো। কিন্তু সেই সংকট মোকাবিলার দায় কি কেবল একার সাধারণ মানুষের, যাদের আয় কম ব্যয় বেশি? আর যাদের নানা উপায়ে আয় অনেক বেশি তাদের দায়টা কোথায়? আসলে কে কোথায় কত খরচ করবে সেটা অবশ্যই তার ব্যক্তিগত আয় ও ব্যয়ের সামঞ্জস্যতার সঙ্গে যুক্ত কিন্তু সরকারি পর্যায়ে যখন এমন বিলাসিতার সংবাদ আসে, তখন প্রশ্ন না তুলে থাকা যায় না।

সরকারের সর্বোচ্চ দুটি পদ হচ্ছে মন্ত্রী পরিষদ সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব। বেসামরিক পর্যায়ের দুটি বড় পদের জন্য স্থায়ী বাসস্থান দরকার সেটিও সত্য। কিন্তু এত এত সরকারি বাসভবনের মধ্যে কি এই আপৎকালীন সময়ে দুজন মানুষের জন্য কোনও আবাসস্থল খালি নেই? আমরা এটাও দেখেছি যে সরকারি কর্মকর্তারা অনেকেই সরকারি বাসভবন দখল করে রাখেন, কিন্তু নিজেরা থাকেন না। এমন সংবাদ কিন্তু এসেছে নানা সময়ে। সংকটকালে কিন্তু নিয়মই হচ্ছে সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা। এমন কিন্তু না যে তারা এখন কোথাও বাসা পাননি। দুজনেই রাজধানীর অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও বিলাসবহুল এলাকার বাসিন্দা। তাহলে কেন জনগণের টাকার এই শ্রাদ্ধ করার আয়োজন?

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বা গণপূর্ত বিভাগ কোন বিবেচনায় এই সময়ে এমন ব্যয়বহুল দুটি প্রকল্পের সুপারিশ পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অনুমতির জন্য পাঠালো? ৪৩ কোটি টাকা কি কোনও টাকা নয়? এই টাকায় কতজন মানুষকে ভর্তুকি দেওয়া যেতো?

বাংলা ট্রিবিউনের সংবাদে প্রকাশিত হয়েছে যে পথশিশুরা ক্ষুধার যন্ত্রণা ভুলে থাকার জন্য নেশায় ডুবে থাকে। ঢাকা শহরে প্রায় ২ লাখ পথশিশু আছে। তাদের বেশিরভাগ এখন “ড্যান্ডি” নামক এক ধরনের নেশায় আসক্ত। পার্কে পার্কে ঘুরে বেড়ানো সেসব শিশুর থেকেই জানা গেছে তারা ক্ষুধার যন্ত্রণা থেকে নিজেদের ভুলিয়ে রাখতেই ঝুঁকে পড়ছে এই জাতীয় নেশার দিকে। একজনের হাত থেকে আরেকজনের হাতে ছড়িয়ে পড়ছে নেশার দ্রব্য।

বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ২০২২ সালের হিসাবে বাংলাদেশের অবস্থান আগের বছরগুলোর তুলনায় নিচে নেমে এসেছে। ১২১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৪তম। আগের বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে ১১৭টি দেশের মধ্যে আমাদের অবস্থান ছিল ৭৬। অর্থাৎ, ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণে আমাদের দেশ দিনে দিনে পিছিয়ে পড়ছে। যদিও অনেকেই তর্কের খাতিরে বলবেন পিছিয়ে থেকেও আমরা ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছি, কিন্তু আমাদের তো লক্ষ্য কেবল ভারত বা পাকিস্তানকে পেছনে ফেলা নয়। ২০৪১ সালে উন্নত দেশের তালিকায় পৌঁছানো আমাদের লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যেই সাজানো আমাদের সকল রাজনৈতিক কর্মসূচি। আগামীর বাংলাদেশ গড়ে তোলা হবে আজকের তরুণ ও কিশোরদের মাথায় রেখে। অথচ, আমাদের একটি বিশাল প্রজন্ম রয়ে যাচ্ছে কোনও প্রকার পরিকল্পনার বাইরে।

আমি ব্যক্তিগতভাবে সরকারি কর্মকর্তাদের বিলাসী জীবনযাপনের বিরোধী নই, কিন্তু বাস্তবতা যখন এমন যে আমাদের শিশুদের একটি বড় অংশ নেশায় ডুবে ভাতের অভাব মিটায় তখন এমন বিলাসিতা বড্ড কটু লাগে। বিবেকের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয় এমন পরিকল্পনা।

আমরা আশায় থাকি আমাদের মাথার ওপর যিনি দায়িত্ব নিয়ে বসে আছেন তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণ ও তীক্ষ্ণ চিন্তার মানুষ। তিনি মানবতার এক অনন্য উদাহরণ। আমি জানি না আমার এই লেখা তার কাছে পৌঁছাবে কিনা। আমি একজন বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি হিসাবে তাঁর কাছেই আবেদন করতে চাই, এই ৪৩ কোটি টাকা থেকে অতি সামান্য কয় কোটি টাকা খরচ করলেই সম্ভব আমাদের এই দুই লাখ শিশুর মুখে হাসি ফোটানো। 

লেখক: কলামিস্ট

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
স্ত্রীকে নিয়ে ঘুমিয়ে ছেলে, রান্নাঘরে পুড়ে মারা গেলেন মা
স্ত্রীকে নিয়ে ঘুমিয়ে ছেলে, রান্নাঘরে পুড়ে মারা গেলেন মা
২৫ দিনেও গ্রেফতার হয়নি কেউ, পুলিশ বলছে সিসিটিভির ফুটেজ পায়নি
কুমিল্লা শিক্ষা প্রকৌশল কার্যালয়ে ঠিকাদারকে মারধর২৫ দিনেও গ্রেফতার হয়নি কেউ, পুলিশ বলছে সিসিটিভির ফুটেজ পায়নি
উপজেলা নির্বাচন: অংশ নিতে পারবেন না পৌর এলাকার ভোটার এবং প্রার্থীরা
উপজেলা নির্বাচন: অংশ নিতে পারবেন না পৌর এলাকার ভোটার এবং প্রার্থীরা
ভারতে লোকসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপের ভোট শুরু
ভারতে লোকসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপের ভোট শুরু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ