X
শুক্রবার, ০৯ মে ২০২৫
২৬ বৈশাখ ১৪৩২

একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক মূল্যায়নের ঘোষণা

নাসরীন সুলতানা
০৮ নভেম্বর ২০২২, ১৯:৫০আপডেট : ০৮ নভেম্বর ২০২২, ১৯:৫০

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এতদিনে একটা যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ধন্যবাদ। কিছু দিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শতবর্ষ উপলক্ষে একটা গবেষণা মেলার আয়োজন করেছিল। সবাই যদিও বিষয়টিকে বাহবা দিয়ে প্রশংসার জোয়ারে ভাসিয়েছে, আমার কাছে মনে হয়েছে এই মেলা বিশ্ববিদ্যালয়কে জাতীয়করণ এবং রাষ্ট্রের অর্থ অপচয়ের নামান্তর মাত্র। কেন সেটা মনে করছি অন্য একটি লেখায় তা বিশদভাবে তুলে ধরবো। আমি মনে মনে অনেক কিছু ভাবছিলাম। ভাবছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে অনেক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিতে পারতো। দেরিতে হলেও দুটি সিদ্ধান্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করেছে। তার একটি হলো ছাত্রদের দ্বারা শিক্ষক মূল্যায়ন পদ্ধতি প্রবর্তন আর অন্যটি স্নাতকোত্তরে বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে ছাত্র ভর্তির সুযোগ। এই দুটি সিদ্ধান্তই ছিল সময়ের দাবি।

গত ১২ অক্টোবর প্রথম আলো অনলাইনে ‘ঢাবিতে শিক্ষকদের মূল্যায়ন করার সুযোগ পাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। মূল খবরে একজন  জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকের বরাত দিয়ে বলা হয়, শিক্ষক মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু হলে কোন শিক্ষক কেমন পড়ান, তাঁর কোর্সের বিষয়বস্তু কেমন, তিনি সময় মতো ক্লাসে যান কিনা, সার্বিক বিষয়ে শিক্ষার্থীদের মতামত দেওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। কোনও একটি কোর্স অধ্যয়ন শেষে শিক্ষার্থীদের একটি করে ফরম দেওয়া হবে। সেখানে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের বিষয়ে শিক্ষার্থীদের মতামত জানতে চাওয়া হবে।

শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন মানদণ্ডে শিক্ষকদের পারফরম্যান্সের ওপর নম্বর দেওয়ার সুযোগ পাবেন। সেগুলোর গড় করে শিক্ষকের সামগ্রিক স্কোর নির্ধারণ করা হবে। শিক্ষার্থীদের এসব মতামতের কথা সংশ্লিষ্ট শিক্ষক জানতে পারবেন না। শুধু বিভাগীয় প্রধান ও অনুষদ-ইনস্টিটিউটের প্রধানেরা এটি জানতে পারবেন (প্রথম আলো অনলাইন, অক্টোবর ১২, ২০২২)।

প্রতি বছর যখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‌্যাংকিং প্রকাশ করা হয় তখন আমাদের দেশের সুশীল সমাজ একটু নড়েচড়ে বসেন, পরে আবার সবকিছু আগের মতো হয়ে যায়। র‌্যাংকিংয়ের কথা আমরা ভুলে যাই। অনেকে তো আবার বলেন এসব র‌্যাংকিং আসলে কিছু না। যাহোক, সারা পৃথিবীতে সভ্য দেশে যত বিশ্ববিদ্যালয় আছে তার বেশিরভাগেই ছাত্রদের দ্বারা শিক্ষক মূল্যায়নের ব্যবস্থা আছে। এই মূল্যায়নের ওপর শিক্ষকের প্রমোশন থেকে শুরু করে টেনিউর প্রাপ্তির সিদ্ধান্ত অনেকটাই নির্ভর করে। এতে একদিকে শিক্ষক যেমন ক্লাস, পরীক্ষা, উত্তরপত্র মূল্যায়নসহ অনেকে ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা এবং ন্যায়পরায়ণতা বজায় রাখেন, তেমনি অন্যদিকে শিক্ষকের মাধ্যমে হেনস্তা হওয়ার ঘটনা থেকে ছাত্ররা রক্ষা পায়। কারণ, প্রতিনিয়ত পরস্পর নজরদারিতে থাকায় ছাত্র-শিক্ষকের আন্তসম্পর্কে এক ধরনের ভারসাম্য পরিলক্ষিত হয়। বস্তুত ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে কেউ কারও বস নয়। বরং তাদের মধ্যে রয়েছে জ্ঞান প্রদান এবং গ্রহণের সম্পর্ক। এই ক্ষেত্রে অনেক সময় শিক্ষকের জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে একজন শিক্ষার্থী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ক্লাসে শিক্ষার্থীকে কথা বলার সুযোগ প্রদান, তার মত প্রকাশের সুযোগদানের মাধ্যমে একদিকে ছাত্র যেমন নিজের স্কিল ডেভেলপ করতে পারে, তেমনি শিক্ষকও নিজেকে ডেভেলপ করার তাগিদ অনুভব করবেন।

আমাদের সমাজ শিক্ষককে গুরুর আসন দিয়ে সবার থেকে এক আসন ওপরে জায়গা করে দিয়েছে। স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহির অভাবে অনেক সময়ই শোনা যায় শিক্ষকের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর হেনস্তা হওয়ার খবর, শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে উঠে এসেছে যৌন-নিপীড়নের মতো অভিযোগ। সময় মতো ক্লাস পরীক্ষা না হওয়ায় সেশনজটের কবলে পড়ে মূল্যবান সময় এবং অর্থ দুটোরই অপচয় হয়। এছাড়া অনেক শিক্ষক ক্লাসরুমে পর্যাপ্ত সময় ব্যয় করেন না। ফলে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাক্ষেত্রে ঘাটতি থেকেই যায়।

ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধীরে ধীরে পুঞ্জীভূত হচ্ছে শিক্ষকদের প্রতি ক্ষোভ। এই অবস্থার উত্তরণে শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে শিক্ষক মূল্যায়ন সময়োপযোগী সূচনা বলা যেতে পারে।

তবে এ ক্ষেত্রে সংকট যে নেই তা কিন্তু নয়। পাশ্চাত্যে আর আমাদের দেশে শিক্ষার্থী-শিক্ষকের সম্পর্ক কিন্তু একরকম নয়। আমি যদি কানাডার কথা বলি তাহলে এখানে একজন গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট মানে একজন মাস্টার্স এবং পিএইচডি স্টুডেন্টকে শিক্ষকের সমকক্ষ না হলেও কাছাকাছি মনে করা হয়, ইংলিশে যাকে বলে নেক্সট টু। তাই একজন শিক্ষকের সঙ্গে সঙ্গে গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্টদের জন্য থাকে অফিস কক্ষ। একই লাউঞ্জ ব্যবহার থেকে শুরু করে তাদের একসঙ্গে বসে অ্যালকোহল পান করতে দেখা যায়। এমনকি তারা একসঙ্গে পার্টিও অ্যাটেন্ড করতে পারেন। আর উভয়ের নামের প্রথম অংশ অর্থাৎ ফার্স্ট নেইম ধরে ডাকার নিয়ম। এক্ষেত্রে কোনও ছাত্র যদি প্রফেসর এক্স বলে সম্বোধন করেন বা ইমেইলে যদি এভাবে সম্বোধন করেন তাহলে প্রফেসর তাকে সতর্ক করে দেন ফার্স্ট নেইম ধরে ডাকার জন্য এবং এটাই যে এখানে প্রচলন সেটাও তাকে শিখিয়ে দেন।

অন্যদিকে, আন্ডারগ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্টদের সঙ্গে থাকে তাদের পর্যাপ্ত দূরত্ব। আমি যখন ইউনিভার্সিটি অব আলবারটাতে টিচিং অ্যাসিসটেন্ট ছিলাম তখন আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে– বাসে, এলআরটিতে কোনও অবস্থাতেই নিজের কোর্সের আন্ডারগ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্টদের সঙ্গে যেন পাশাপাশি না বসি, কোনও কফি শপে বসে একসঙ্গে যেন কফি না খাই। এবং একজন আন্ডারগ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট প্রফেসরকে ‘প্রফ’ অথবা ‘প্রফেসর এক্স’ বলে সম্বোধন করবেন। তাহলে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও দুটি শ্রেণির সঙ্গে শিক্ষকের সম্পর্কে রয়েছে বিশাল ভিন্নতা। তাই একজন আন্ডারগ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট যখন প্রফেসরকে মূল্যায়ন করেন তখন একেবারে নিরপেক্ষভাবে কেবল তার শিক্ষক সত্তাই মূল্যায়ন করেন। গ্রাজুয়েট এডুকেশন কেবল এডুকেশন নয়, বরং একটা ট্রেনিং। তাই একজন গ্রাজুয়েট স্টুডেন্ট মূল্যায়নের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ পেশাদারি মনোভাব নিয়ে শিক্ষকের মূল্যায়ন করেন।

অন্যদিকে, আমাদের দেশে ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে এক ধরনের ব্যক্তিগত হৃদ্যতা পরিলক্ষিত হয়। সেই সঙ্গে আছে শিক্ষকদের হল প্রশাসনে অংশগ্রহণ। আবার শিক্ষক রাজনীতি এবং ছাত্র রাজনীতির কারণে তাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে এক সেতুবন্ধন। ফলে শিক্ষক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা এবং পক্ষপাতিত্বের ঘাটতির বিষয়টা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

তবে যত সংকটই থাকুক না কেন, আমি মনে করি এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য এক মাইলফলক হয়ে থাকবে। এই মূল্যায়নকে যথাযথভাবে কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজন একটু সুনির্দিষ্ট নীতিমালা। এটা যেন কেবলই লোক দেখানো মূল্যায়ন না হয় সে বিষয়টিও বিবেচনায় আনতে হবে। তাই শিক্ষকের প্রমোশনের ক্ষেত্রে এই মূল্যায়নকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। কোর্সের ফলাফল শেষে শিক্ষক যাতে মূল্যায়নের রিপোর্ট দেখতে পারেন সে ব্যবস্থা থাকতে হবে, যাতে শিক্ষক বুঝতে পারেন তাঁর কোথায় সংশোধন করা দরকার, কোন জায়গায় ডেভেলপমেন্ট দরকার।

এই ব্যবস্থার সুফল পেতে হলে শিক্ষাঙ্গনকে রাজনীতিমুক্ত করার বিকল্প নেই। অর্থাৎ, শিক্ষক রাজনীতি এবং ছাত্র রাজনীতি থেকেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে মুক্ত করতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে ছাত্র রাজনীতির নামে যেমন চলে সাধারণ ছাত্রদের ওপর ছাত্রনেতাদের অত্যাচার, তেমনি শিক্ষকরাও নিজেদের রাজনৈতিক প্রয়োজনে ছাত্রদের ব্যবহার করতে দ্বিধা করেন না। ফলে শিক্ষকের রাজনৈতিক পরিচয় শিক্ষক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে অনেক সময়ই নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাই শিক্ষক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সব ধরনের ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক সম্পর্ক উভয় দিক থেকে দুইটা গ্রুপকে আলাদা করতে হবে। শিক্ষক এবং ছাত্রকে চরম পেশাদারি মনোভাব পোষণ করতে হবে, যাতে এই মূল্যায়নের ক্ষেত্রে কোনও ব্যক্তিগত কিংবা রাজনৈতিক ইস্যু প্রভাব বিস্তার করতে না পারে। সেই সঙ্গে হল প্রশাসনে অ্যাকাডেমিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তি তথা শিক্ষকদের নিয়োগদান বন্ধ করতে হবে। কারণ, অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম এবং আবাসন ব্যবস্থা দুটি দুইদিক।

আমার গত দশ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতায় দেখেছি ধীরে ধীরে শিক্ষার মান যেমন হ্রাস পাচ্ছে, তেমনি  ছাত্রদের মধ্যে রয়েছে প্রচণ্ড অ্যাকাডেমিক শিক্ষার প্রতি অনীহা। খুব অল্প সংখ্যক ছাত্র অ্যাকাডেমিক শিক্ষাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে। অ্যাকাডেমিক শিক্ষার শেষ বছরগুলোতে বেশিরভাগ ছাত্রই সময় ব্যয় করে বিসিএসের মতো চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতিতে। তাই অনেক ছাত্রের কাছেই ছাত্রবান্ধব শিক্ষক মানেই হলো পরীক্ষায় বেশি নম্বরদানকারী শিক্ষক। জবাবদিহির অভাবে অনেক শিক্ষকই কয়েকটি ক্লাস নিয়ে কোর্স শেষ এবং ছাত্রদের কাছে জনপ্রিয় হওয়ার জন্য অতিরিক্ত নম্বর প্রদান করেন। শিক্ষক মূল্যায়ন ব্যবস্থা শুরু হলে ছাত্ররাও দূরদর্শিতা এবং প্রজ্ঞার সদ্ব্যবহার করতে সক্ষম হবে। আর শিক্ষকরাও এই ধরনের মনোভাব থেকে সরে আসবেন।

পরিশেষে বলি, সংকট যতই থাকুক, শুরুটা করা জরুরি। ধীরে ধীরে ছাত্র-শিক্ষকরা এই সিস্টেমে অভ্যস্ত হয়ে যাবেন। এতে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা এবং আন্তরিকতা বৃদ্ধি পাবে। যৌন নিপীড়নের অবসান হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অনুসরণ করে দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় একই পদ্ধতি গ্রহণ করবে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, সেই সঙ্গে এগিয়ে যাবে আমাদের উচ্চশিক্ষার মান।  

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার, ঢাকা এবং পিএইচডি শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অন্টারিও, কানাডা

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
তিন শিক্ষক আর পাঁচ শিক্ষার্থী দিয়ে চলছে সরকারি বিদ্যালয়
তিন শিক্ষক আর পাঁচ শিক্ষার্থী দিয়ে চলছে সরকারি বিদ্যালয়
রাতে সমাধান হয়নি, যমুনার সামনে বিক্ষোভ অব্যাহত
রাতে সমাধান হয়নি, যমুনার সামনে বিক্ষোভ অব্যাহত
ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে পিএসএল সরে গেলো আমিরাতে
ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে পিএসএল সরে গেলো আমিরাতে
টিভিতে আজকের খেলা (৯ মে, ২০২৫)
টিভিতে আজকের খেলা (৯ মে, ২০২৫)
সর্বশেষসর্বাধিক