X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

গুজবের রাজনীতি আর কতদিন?

আশরাফ সিদ্দিকী বিটু
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৮:১৩আপডেট : ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৮:১৩

সবাই বড় হওয়ার সময় কমবেশি গল্প বা রূপকথা বা কল্পকথা শোনে বা শোনানো হয়। এসবের মধ্যে হাসিঠাট্টা, মজার এমনকি নির্মম কথাও থাকে। ছোটবেলায় এক রাজার মেয়ের বিয়ের গল্প আমরা অনেকেই শুনেছি। গল্পটা অনেকটা এমন যে রাজার মেয়ের বিয়ে, কার সঙ্গে বিয়ে, একজন বললো এক কালো লোকের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। কেমন কালো? আরেকজন বললো, কাকের মতো কালো। এই গল্প শেষমেশ রাজ্যের প্রজাদের কাছে ছড়ালো এমন যে রাজার মেয়ের কাকের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। প্রজাকুলও তা-ই বিশ্বাস করলো যে রাজার মেয়ের কাকের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে।

এখন আধুনিক যুগ, প্রযুক্তিনির্ভর যুগ। তবু কথা ছড়ায় দ্রুতই, অনেকটা হাওয়ার আগে। এই বিষয়টি খুবই প্রবলভাবে সমাজে এখনও চলছে। মিথ্যা নাকি ছড়ায় খুব তাড়াতাড়ি, বাতাসের আগে। কয়েক দিন আগে একটা ওয়েব সিরিজ দেখছিলাম, নাম “Peaky blinders” - ওই ওয়েব সিরিজের এক পর্বে নায়ক একজনকে বলছিল- “ But lies travel faster than the truth”।  যদিও সত্যই চিরস্থায়ী এবং সত্যই প্রতিষ্ঠিত হয় বা হবেই, তা যত সময়ই লাগুক। নির্মমতা হলো, সত্য প্রতিষ্ঠিত হবার আগে অনেক সময় ক্ষতি হয়ে যায় বা সত্য উদঘাটনে সময় লেগে যায়।  এই বর্তমানকালেও মিথ্যা নিয়ে মানুষের নানান মাতামাতি। আধুনিক প্রযুক্তি যেন নতুনতর গুজব ছড়াতে সহযোগিতা করছে। মুহূর্তের দ্রুত ছড়িয়ে যায় গুজব। অনেকেই মিথ্যা বানাচ্ছেন ও ইচ্ছাকৃত মিথ্যা ছড়াচ্ছেন। ইচ্ছাকৃত এসব অসত্য, ভ্রান্ত বিষয়, গল্প এখন লোকমুখে না ছড়িয়ে সোশাল মিডিয়া, এমনকি গণমাধ্যমকেও ব্যবহার করা হচ্ছে। তার চেয়েও দুঃখজনক ব্যাপার হলো, একশ্রেণির তথাকথিত শিক্ষিত মানুষ এসব ব্যবহার করছে, অপরকে বিশ্বাস করাতে ছড়াচ্ছে নানাভাবে। একটা শ্রেণি আবার ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকেও এসব ভ্রান্ত অসত্য তথ্য, গল্প বা ফেক ভিডিও ছড়াতে ব্যবহার করছে।

এই দেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় নানা এমন কল্পকথা, মিথ্যাচার ছড়ানো হয়েছিল। এর ধারাবাহিকতা এখনও চলছে। নিয়মিত বিরতির পর পর সোশাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে এসব মিথ্যা ছড়ানো হচ্ছে। এতে মূলত বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারকে বিব্রত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। মানুষ যাতে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে আস্থা হারায় তার জন্যই এসব মিথ্যাচার। এসব সংঘবদ্ধ হীন উদ্দেশ্যে মিথ্যাচার ছড়ানোই হলো গুজব। গুজবের নানান ব্যাখ্যা আছে। সমাজবিজ্ঞানীরা উপযুক্ত সংজ্ঞায়নও করেছেন। গুজব উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং অসৎ উদ্দেশ্যে ছড়ানো হয়, কোনও পক্ষকে ঘায়েল করা বা কাউকে বা কোনও গোষ্ঠীকে হেয় করা বা ক্ষতি করার লক্ষ্যে গুজব ছড়ানো হয়। অসত্য ও ভুল তথ্য বা বিষয় একটা শ্রেণিকে দিয়ে নানাভাবে ছড়ানো হয় এবং বিশ্বাস করানো হয় যে যা ছড়ানো হয়েছে তা ঘটেছে বা ঘটবে; যদিও এর পুরোটাই ভ্রান্ত ও মিথ্যা।

গুজব ছড়ানো হয় মানুষকে ভুল বোঝাতে বা জনমতে ভীতি তৈরি করতে। কিছু অনিশ্চয়তাকে পুঁজি করে গুজবের ট্যাবলেট খাওয়ানো হয়। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, গুজব হলো প্রচারণা, একটি উপসেট। আমাদের দেশে কয়েকটি বিরোধীদল এই উপসেটকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। রাজনৈতিক গুজবগুলোর উৎস কোথায় বা কী করে এসব তৈরি করে ছড়ানো হচ্ছে তা কমবেশি আমরা সবাই জানি-বুঝি ও অনুমান করতে পারি। অতীতে রাজাকার সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে বলে মাইকে গুজব ছড়িয়ে সহিংসতা করা হয়েছিল। যদিও পরে সবই পরিষ্কার হয়ে যায় সবার কাছে। কিন্তু নিয়মিত এসব মিথ্যাগল্প ও গুজব নিয়ে পড়ে থাকে বেশ কিছু রাজনৈতিক কর্মী, যেন এসবই তাদের কাজকর্ম।

সমস্যা হলো দলীয়ভাবেও এই দেশে এসব মিথ্যাকে উসকানি দেওয়াসহ গুজব সুকৗশলে ছড়ানো হয়। বিএনপির কেন্দ্রীয় এক নেত্রী অন্য দেশের মিছিলের ছবি ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট রাস্তায় প্রতিবাদের ছবি বলে চালিয়ে দিয়েছিলেন। দৈনিক আমার দেশ ও  দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা কাবা শরিফের গিলাফ পরিবর্তনের ছবি নিয়ে অসত্য সংবাদ প্রকাশ করে বলেছিল, ‘আলেমদের নির্যাতনের প্রতিবাদে কাবার ইমামদের মানববন্ধন।’ এসব কারণে পরে দৈনিক সংগ্রাম দুঃখ প্রকাশ করেছিল। উভয় পত্রিকা অনলাইন সংস্করণ থেকে খবরটি সরিয়ে নেয়। ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধী  সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে গুজব ছড়িয়ে সহিংসতা করা হলো। যার উদ্দেশ্য ছিল দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করা। ২০১৪ সালেও গুজব ছড়িয়ে দেশে সহিংসতা করা হয়। যদিও পরে সহিংসতাকারী ও অবরোধকারীরা পিছু হটে। কিন্তু দুই শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটে, কয়েক হাজার নিরীহ মানুষ অগ্নিদগ্ধ হয়। সম্প্রতি ব্যাংকে টাকা নেই বলে গুজব ছড়ানো হলো, সেগুলো আবার একটি দলের নেতাকর্মীরা বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার করলো। পরে ঠিকই গুজব সৃষ্টিকারীরা আটক হলো।

লক্ষ করা যাচ্ছে, বাংলাদেশে রাজনীতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে পাশ কাটিয়ে গত কয়েক বছর ধরে গুজবের মাধ্যমে সরকার বা আওয়ামী লীগকে বিব্রত করার অপচেষ্টা চলছে। রাজনীতিতে পক্ষ-বিপক্ষ থাকবে, জনগণের কল্যাণে রাজনীতি। নীতিগত মতপার্থক্য রাজনীতির বৈশিষ্ট্য, কিন্তু ভালোকে ভালো বলার মানসিকতা বাদ দিয়ে, রাজনীতির চলমান রীতি বা রেওয়াজ বাদ দিয়ে অশুভ গুজব নির্ভরতা একাধারে হাস্যকর ও দেশের জন্য ক্ষতিকর। কিছু হলে যৌক্তিক সমালোচনা বাদ দিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। এমনকি এক্ষেত্রে ধর্মকে বাদ দেওয়া হচ্ছে, ধর্মের অপব্যবহার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করার এই অপরুচি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

এসব মিথ্যাচার বিষয়ে ইসলাম ধর্মেও সতর্কতা রয়েছে। আল্লাহ তায়াআলা বলেন, ‘হে মুমিনরা, যদি কোনও পাপাচারী তোমাদের কাছে কোনও বার্তা নিয়ে আসে, তোমরা তা পরীক্ষা করে দেখবে। যাতে অজ্ঞতাবশত তোমরা কোনও সম্প্রদায়ের ক্ষতিসাধনে প্রবৃত্ত না হও এবং পরে যাতে নিজেদের কৃতকর্মের জন্য তোমাদের অনুতপ্ত হতে না হয়।’ (সুরা: হুজরাত, আয়াত: ৬)। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যা শুনবে, তা-ই (যাচাই করা ছাড়া) বর্ণনা করা মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য যথেষ্ট।’ (মুসলিম শরিফ: ১/১০)। আবার পবিত্র কোরআনে আরও বলা হয়েছে- ‘যে বিষয়ে তোমার কোনও জ্ঞান নেই, তার অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই কান, চোখ, অন্তর- এগুলোর প্রতিটি সম্পর্কে কৈফিয়ত তলব করা হবে।’ (সুরা বনি ইসরাঈল, আয়াত: ৩৬) [সূত্র- গুজব যখন গজব, লেখক মুফতি কাসেম শরীফ, দৈনিক কালের কণ্ঠ, ১২ ডিসেম্বর ২০১৯]

অথচ আমাদের দেশে অনেক ইসলামি দল এসব বিষয়ে জেনেও ইচ্ছাকৃত মানুষকে ধর্মের দোহাই দিয়ে গুজবে আকৃষ্ট করে, এমনকি পাঠ্যপুস্তকে যা নেই তা নিয়েও কয়েকজন ধর্মীয় নেতা অপব্যাখ্যা দিয়েছেন।  ধর্মবিরোধী কিছু পাঠ্যপুস্তকে নাই, তথাপি মানুষকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। কমবেশি আমরা সবাই বুঝি এসবের উৎস কোথায় বা কারা এসব করে বা করছে। এসব গুজব ছড়িয়ে রাজনীতির মাঠে দীর্ঘকালীন সুবিধা পাওয়া যায় না, বরং মানুষের কাছে হেয় হতে হয়, যখন সত্য প্রকট হয়।

বছর খানেকের মধ্যে দেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নানামুখী কার্যকলাপ, জোট গঠন ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। এসবের সঙ্গে সঙ্গে গুজব ছড়ানোও শুরু হয়ে গেছে। সম্প্রতি দেশে গুজব ও অপপ্রচার বেড়েছে, ২০২৩-এ আরও বাড়বে। কারণ, সামনে জাতীয় নির্বাচন।

রাজনীতি আর গুজবকে অনেকে একাকার করে ফেলেছেন। দলের জনসমর্থন থাকলে গুজব বা মিথ্যাচারের প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু জনগণকে আকৃষ্ট না করে গুজবের অস্ত্র ব্যবহার প্রতিদানে ভালো কিছু দিবে না। গুজবকে নতুন ধরনের সন্ত্রাসবাদ বললে ভুল হবে না। গুজবের বিরুদ্ধে আইনকে আরও কার্যকর করতে হবে। তবে আইনের অপব্যবহার যাতে না হয় সেদিকেও নজর রাখতে হবে। তবে এগিয়ে যাওয়া, না গুজব, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জনগণকেও নিতে হবে এবং সত্য-মিথ্যা যাচাই করতে হবে কোনও কিছু বিশ্বাস করা বা প্রচারের আগে। গুজব মিথ্যাচারের রাজনীতি দলকে পিছনে ঠেলে, এসব সঙ্গে নিয়ে রাজনীতি করলে রাষ্ট্র মেরামতের চটকদার ফর্মুলা বেশি দূর গড়াবে বলে মনে হয় না। তাই প্রশ্ন রাখলাম, এভাবে দেশে গুজবের রাজনীতি আর কতদিন?

লেখক: রাজনৈতিক কর্মী

 

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পানিতে ডুবে ভাইবোনসহ ৩ শিশুর মৃত্যু
পানিতে ডুবে ভাইবোনসহ ৩ শিশুর মৃত্যু
‘এমপি হতে ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা খরচ হয়েছে, এটা তুলবো, এটুকু অন্যায় করবো-ই’
‘এমপি হতে ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা খরচ হয়েছে, এটা তুলবো, এটুকু অন্যায় করবো-ই’
ইডি হেফাজতে আরও ৪ দিন কেজরিওয়াল
ইডি হেফাজতে আরও ৪ দিন কেজরিওয়াল
ভাইস চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে নারী উন্নয়ন ফোরামের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ
ভাইস চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে নারী উন্নয়ন ফোরামের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ