X
শনিবার, ১৮ মে ২০২৪
৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

ছাত্ররা কেন সহিংস হয়?

আমীন আল রশীদ
১৩ মার্চ ২০২৩, ১৯:৫৭আপডেট : ১৩ মার্চ ২০২৩, ১৯:৫৭

মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি রায়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের বিপরীতে ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে যখন পাল্টা কর্মসূচি শুরু হয়েছিল রাজধানীর শাপলা চত্বরে, তখন অনেক মাদ্রাসার ছাত্র টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে বলেছিলেন, তারা জানেন না এখানে কেন এসেছেন। ‘হুজুর বলেছেন তাই এসেছেন।’ তারা তখন দুটি শব্দ বলছিলেন। ১. নাস্তিক এবং ২. ব্লগার। যদিও নাস্তিক বা ব্লগার বলতে কী বোঝায়, সে বিষয়ে তারা পরিষ্কার উত্তর দিতে পারেননি। কেউ কেউ বলেছিলেন, ‘ব্লগাররা ইসলামকে ব্লক করে দিতে চায়।’

হেফাজতে ইসলামের ওই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে তখন রাজধানীসহ সারা দেশে কী পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, সেটি দেশবাসীর স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি। পরবর্তী সময় জানা যায়, তাদের মূল টার্গেট ছিল রাজধানী দখল করা এবং তার পেছনে দেশের এক বা একাধিক রাজনৈতিক দলের যে ইন্ধন ছিল, সেটিও ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়।

এই যে কোনও একটি রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক সংগঠনের ঢাকা দখল করতে চাওয়া বা দাবি আদায়ে বড় ধরনের শোঅফ ও শোডাউন করা—তার প্রধান শক্তি আসলে শিক্ষার্থীরা। যে গণজাগরণ মঞ্চের পাল্টা হিসেবে হেফাজতে ইসলামের আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, সেখানেও মূল শক্তি ছিল ছাত্রসমাজ।

বলাই হয়, দেশের সবচেয়ে বড় সংগঠিত শক্তি হচ্ছে ছাত্রসমাজ আর এ কারণেই সব রাজনৈতিক দল এবং রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ আছে এমন অরাজনৈতিক সংগঠনগুলো সবসময়ই এই বৃহৎ শক্তিকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। যে কারণে দেখা যায়, যখন যে দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকে, তাদের ছাত্র সংগঠনগুলোই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, প্রধানত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রিয় থাকে। বিরোধী বা সরকারের বাইরে থাকা দলগুলোর ছাত্রসংগঠন খুব একটা পাত্তা পায় না।

একসময় সরকারি ও বিরোধীদলীয় ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হতো। রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের রগ কাটার মতো তাণ্ডবও হয়েছে। এ সবকিছুর মূলে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখা। কারণ, এটি বলাই হয় যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যাদের দখলে, রাষ্ট্রক্ষমতাও তাদের।

বলা হয়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যদি দলমত নির্বিশেষে কোনও একটি দাবি নিয়ে রাস্তায় নামেন, তাহলে সেই দাবি পূরণ না করে রাষ্ট্রের উপায় থাকে না। যে কারণে সব আমলে সব সরকারই এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে চায়। নিজেদের দলের বাইরে অন্য সব দলের কার্যক্রম প্রতিহত বা নিষ্ক্রিয় করে রাখতে চায়।

দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ থেকে এ পর্যন্ত দেশের ইতিহাসে যত জাতীয় আন্দোলন হয়েছে, তার সবগুলোয় প্রধান নিয়ামক ছিল ছাত্রসমাজ। বায়ান্নার ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, আশির দশকে এরশাদবিরোধী আন্দোলন, ২০০৭ সালে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ছাত্র আন্দোলন এবং এর পরবর্তীকালে কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনেও মূল ভূমিকা পালন করেন শিক্ষার্থীরা। এরমধ্যে নিরাপদ সড়কের দাবিতে ২০১৮ সালে সংঘটিত কিশোর-তরুণ ছাত্রদের আন্দোলন সারা দেশে তোলপাড় তোলে।

তার মানে প্রতিটি বড় ঘটনার পেছনেই শিক্ষার্থীদের এই শক্তি কোনও না কোনোভাবে ভূমিকা রাখে। আর এই শক্তিকেই রাষ্ট্রের শক্তিশালী ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও দলসমূহ হয় নিজের করায়ত্তে বা নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায় কিংবা এই শক্তিকে এড়িয়ে চলে।

রাষ্ট্রের সব শক্তিশালী পক্ষ যে ছাত্রদের নিজেদের পকেটে রাখতে চায়, এই নির্মম সত্যটা ছাত্ররাও জানে। জানে বলেই তারাও সুযোগ পেলেই বেপরোয়া হয়। কখনও তাদের সচেতনভাবেই বেপরোয়া হতে উৎসাহ দেওয়া হয়, যাতে ক্ষমতাবানরা এটি তাদের প্রতিপক্ষকে দেখাতে পারেন যে ছাত্রসমাজ তাদের পক্ষে আছে।

যেহেতু সব আমলেই সব ক্ষমতাসীন দলই শিক্ষার্থীদের নিজেদের পকেটে রাখতে চায় এবং এই চাওয়ার মূল উদ্দেশ্য যেহেতু বৃহত্তর অর্থে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় টিকে থাকা; যেহেতু রাজপথের আন্দোলনে প্রতিদ্বন্দ্বী দলসমূহকে মোকাবিলা করার প্রধান শক্তি এই ছাত্রসমাজ, ফলে সব দলই চায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাদের ছাত্রসংগঠন সক্রিয় থাকবে। শক্তিশালী হবে। আর যখন রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ক্ষমতায় যাওয়া ও ক্ষমতায় টিকে থাকার মূল অস্ত্র হিসেবে ছাত্রদের ব্যবহার করে, তখন ছাত্ররাও এর সুযোগ নেয়। তারাও তখন রাজনৈতিক ‘বড়ভাই’দের প্রশ্রয়ে ক্যাম্পাসে, এমনকি ক্যাম্পাসের বাইরেও নিজেদের শক্তিমত্তা প্রদর্শন করতে চায়।

যেহেতু তারুণ্যের একটা নিজস্ব শক্তি ও রোমান্টিসিজম আছে, ফলে সেই তারুণ্য এবং নিজেকে শোঅফ করা, বিনিময়ে কিছু পয়সা কামানো, সমাজে নিজেকে ক্ষমতাবান দেখানো, এমনকি প্রেমিকার চোখেও নিজেকে হিরো প্রমাণ করার জন্য যখন তারা কিছু একটা করার সুযোগ পায়, সেটি হাতছাড়া করতে চায় না। সবচেয়ে বড় কথা, তারা জানে যে তাদের কোনও একজন সহকর্মী কোনও আউটসাইডারের দ্বারা নিগৃহীত বা অসম্মানিতে হলে তার প্রতিশোধ নিতে গিয়ে যদি মারধর করতে হয়, বাসে আগুন দিতে হয়, দোকান বা মার্কেটে ভাঙচুর চালাতে হয়, তাতেও অসুবিধা নেই। কারণ, তাদের ‘প্রটেক্ট করার’ লোক আছে। ক্যাম্পাসে যেসব বড় ভাইয়ের পেছনে তারা মোটরবাইক নিয়ে ঘুরে বেড়ান, সেই বড় ভাইরা থানায় ফোন করে দেবেন যাতে পুলিশ ঝামেলা না করে। আবার শুধু থানা পুলিশ সামলানোই নয়, এই বড় ভাইদের আশীর্বাদ থাকলে পরবর্তী কমিটিতে কোনও পদ-পদবিও বাগানো যায়। যে পদ-পদবি ব্যবহার করে বৈধ-অবৈধ নানা উপায়ে ছাত্রজীবনেই বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হওয়া যায়। তার মানে এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এখানে কোনও একজন শিক্ষার্থী বাসের হেলপার বা কন্ডাকটরের দ্বারা অসৌজন্যমূলক আচরণের শিকার হয়েছেন বলে তার প্রতিশোধ নিয়ে তার সহপাঠীরা বাস ভাঙচুর করলেন, আগুন দিলেন—বিষয়টা এত সরল নয় বা ঘটনাগুলো এখানেই শেষ হয়ে যায় না বা এর শুরুটাও এখানে নয়। বরং এসব ভাঙচুর ও আগুন অনেক বড় ঘটনার ছোট ছোট বাইপ্রোডাক্ট। এর শেকড় নষ্ট রাজনীতি। বড় দলগুলোর ক্ষমতায় যাওয়া ও টিকে থাকার যে নিত্য লড়াই, সেই লড়াইয়ের সবচেয়ে নিরীহ ভিকটিমের নাম ছাত্রসমাজ। সুতরাং ছাত্রসমাজকে রাজনীতির ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার বন্ধ না হলে এই বৃহৎ সংগঠিত শক্তি ছোটখাটো ঘটনায় সহিংস হয়ে উঠবে।

যেকোনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে, সেটি পাবলিক বাসে ভাড়া নিয়ে কন্ডাকটরের সঙ্গে বচসা হোক কিংবা রাষ্ট্রীয় কোনও অন্যায় হোক, ছাত্রসমাজ বরাবরই এর প্রতিবাদ জানায়। কিন্তু যখন তারা ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয় বা যখন তাদের ক্ষমতার মোহ এবং অর্থের লোভ পেয়ে বসে, তখন তারা সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগঠিত হতে পারে না। কারণ, তখন তাদের যেকোনও আন্দোলন বা দাবির পক্ষে রাস্তায় নামার আগে খেয়াল রাখতে হয় সে কোন দলের অনুসারী। তার কাছে তখন দেশ ও মানুষ নয়, দল ও রাজনৈতিক বড় ভাই শেষ কথা। মূলত এভাবেই দেশের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ও সবচেয়ে সংগঠিত অংশটি অন্যের দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হতে হতে যন্ত্রে পরিণত হয়। তার কাছে তখন ক্যারিয়ার, পদ-পদবি আর অর্থের বাইরে কোনও কিছুই আর বিবেচ্য থাকে না।  

অস্বীকার করা যাবে না, এযাবৎ বিভিন্ন ক্যাম্পাসে যত খুন, যত হানাহানি, শিক্ষক ও ভিসিদের যত অপকর্ম, তার সবকিছুর পেছনেই প্রধানত দায়ী রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন। একজন সাধারণ শিক্ষার্থী, যার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই, তিনি ক্যাম্পাসে বেপরোয়া আচরণের সাহস পান না। কিন্তু যখনই তিনি কোনও দলের সঙ্গে যুক্ত হন, তখনই তার শরীরের ভাষা ও মনোভঙ্গি বদলে যায়। তখন তার মধ্যে নিজেকে প্রকাশের অদম্য স্পৃহা তৈরি হয়। সেই প্রকাশের একটি মাধ্যম হলো কোনও অজুহাত পেলেই লাঠিসোঁটা, রামদা এমনকি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া।

এসব কারণে ক্যাম্পাসে দলীয় রাজনীতি চান কী চান না– এই প্রশ্নটি উন্মুক্ত পরিসরে ছুড়ে দিলে ‘চান না’র পক্ষেই বেশি ভোট পড়বে। কারণ, ছাত্র রাজনীতির নামে দলীয় লেজুড়বৃত্তির যে কদর্য চেহারাটি বছরের পর বছর ধরে তৈরি হয়েছে, তাতে খুব ব্যতিক্রম ছাড়া কোনও অভিভাবকই এখন আর চান না, তার সন্তান ক্যাম্পাসে গিয়ে কোনও ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হোক। কিন্তু এ প্রশ্নও আছে যে ক্যাম্পাসে যদি ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয় তাহলে কী করে নেতৃত্ব গড়ে উঠবে এবং শিক্ষার্থীরাই বা কীভাবে রাষ্ট্রীয় এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়-সম্পর্কিত বিবিধ অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে?

প্রতিটি ক্যাম্পাসেই বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন থাকে। সেসব সংগঠনও বড় প্ল্যাটফর্ম। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনও অন্যায় করলে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোই তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তুলতে পারে। এমনকি, রাষ্ট্রীয় কোনও বিষয়েও চাইলে তারা প্রতিবাদ করতে পারে এবং সেখানে কেন্দ্রীয় রাজনীতির ইন্ধন বা প্রভাব না থাকলেও একটি অন্যরকম আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো চায় না শিক্ষার্থীরা এভাবে কোনও নির্দলীয় প্ল্যাটফর্মে সংগঠিত থাকুক। কারণ, তারা নির্দলীয় প্ল্যাটফর্মে ঐক্যবদ্ধ থাকলে তাদের ক্ষমতায় যাওয়া ও ক্ষমতায় টিকে থাকার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করা যায় না। সুতরাং ক্যাম্পাসে বা ক্যাম্পাসের বাইরে শিক্ষার্থীরা কেন সহিংস হয়, সেই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে আমাদের সামগ্রিক রাজনৈতিক চরিত্র নিয়েই কথা বলতে হবে।

লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।

 
 
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
হিউস্টনের ঝড়ে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সিরিজ নিয়ে শঙ্কা!
হিউস্টনের ঝড়ে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সিরিজ নিয়ে শঙ্কা!
অবৈধভাবে ভারতে যাওয়ার সময় মিয়ানমারের নাগরিকসহ আটক ৪
অবৈধভাবে ভারতে যাওয়ার সময় মিয়ানমারের নাগরিকসহ আটক ৪
মেধাবী দুই বোনের স্বপ্ন পূরণে ‘বাধা’ আর্থিক সংকট
মেধাবী দুই বোনের স্বপ্ন পূরণে ‘বাধা’ আর্থিক সংকট
জুভেন্টাসকে শিরোপা জিতিয়েও যে কারণে চাকরি হারালেন অ্যালেগ্রি 
জুভেন্টাসকে শিরোপা জিতিয়েও যে কারণে চাকরি হারালেন অ্যালেগ্রি 
সর্বশেষসর্বাধিক