X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

তবু ঈদ

আহসান কবির
২৩ এপ্রিল ২০২৩, ১১:৫৩আপডেট : ২৩ এপ্রিল ২০২৩, ২২:৪৬

ঈদ প্রতিবছর আসে কিন্তু আনন্দ কিংবা উৎসবের রঙ নাকি একই থাকে। বানান বদলে ‘ঈদ’ হয়ে যায় ‘ইদ’ কিন্তু আনন্দ নাকি বদলায় না। করোনার সময়ের ঈদকে কেউ কেউ বলেছিলেন ‘গৃহবন্দি ঈদ’, কেউ কেউ ‘ঈদ মোবারকের’ ডিজাইনে ‘মাস্ক’ পরিয়ে দিয়েছিলেন। তবে একটা মন্তব্য আজও মনে আছে। একজন লিখেছিলেন– ‘মাস্ক দিয়ে জীবাণু আটকানো যায়, ঈদের আনন্দ আটকানো যায় না!’

ঈদের আনন্দ আগেও আটকানো যেত না। বরং যা অন্য কোনও সময়ে সহজে করা যায় না তা ঈদের জন্য তুলে রাখতো আমাদের অনেকেই। যেমন, (নিজের দেখা, অনেকের কাছ থেকে শোনা!)

এক. বাসা থেকে অনেক দূরে ঘুরতে যাওয়া। এখন ঈদের ছুটিতে অনেকেই দেশের বাইরে ঘুরতে যান।

দুই. প্রথম সিগারেট খাওয়া, প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করা কিংবা সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখার চল ছিল ঈদে। আশির দশকে ঈদের দিন রাতে ভিসিআর ভাড়া করে ইংরেজি বা হিন্দি ছবি দেখার চল ছিল। এখন ভিসিআরের যুগ নেই তবে সিনেপ্লেক্সের যুগ চলছে। বন্ধুবান্ধব নিয়ে কেউ কেউ এখনও ‘মাস্তি’ করে চাঁদরাতে, কেউ কেউ ঈদের দিন। ঈদের দিনে ‘ডেটিংয়ের’ মজাই নাকি আলাদা। সিনেমা হলের সংখ্যা কমে যাওয়া ও পরিবেশের কারণে মফস্বল শহরগুলোতে ঈদে নতুন ছবি দেখার আনন্দ আগের মতো আছে কিনা জানি না।

তিন. ঈদের সালামি পাওয়ার আকুতি আগের মতোই আছে। নতুন টাকায় সালামি দেওয়ার রেওয়াজ  জনপ্রিয় হয়েছে। চাঁদা তুলে ‘নিষিদ্ধ’ জিনিস খাবার ঝোঁকও বেড়েছে।

চার. ঈদের দিন যারা নতুন লাটিম বা মার্বেল খেলতো তাদের ঈদ অনুভূতি কি আগের মতো আছে? লাটিম বা মার্বেল কি এখনও শিশুদের খেলনা? নাকি প্লাস্টিকের খেলনাই এখন জনপ্রিয়?

পাঁচ. আগে পটকা ফুটানোর চল ছিল। যেমন, মরিচ বাত্তি কিংবা হাতুড়ি বোম। কেন এই নামকরণ হয়েছিল জানি না। এখন পটকা বা বাজির আধুনিকায়ন হয়েছে। নতুন করে ‘ফায়ার ওয়ার্কস’ বা আতশবাজির মহড়া দেখা যায় ঈদে।

এমন উদাহরণ হয়তো আরও দেওয়া যাবে। আগে পাড়া মহল্লায় একদিনের জন্য ভিউকার্ড, ঈদ কার্ড কিংবা পোস্টারের দোকান বসতো। মেলার মতো পরিবেশ বা আবহ তৈরি হতো। ঘোড়া বা হাতির দেখা মিলতো, লাঠিখেলা ও স্পোর্টস হতো সংঘ বা ক্লাবের ব্যানারে। রাস্তায় বা বাড়ির ছাদে ডেকসেটে গান বাজতো, হয়তো এখনও বাজতে শোনা যায়।

কিন্তু একবারে শুরুতে ঈদ উৎসবের প্রথম চিত্র কেমন ছিল? নিজের পুরনো লেখা থেকে সামান্য অংশ তুলে ধরছি–

বাংলাদেশে (অবিভক্ত বাংলা ও পরবর্তীতে পূর্ববঙ্গ) ঈদ উৎসবের স্মৃতি বেশি দিনের না। প্রথম ঈদ পালনের তথ্য মেলে মদিনাতে ৬২৪ সালের ৩১ মার্চ। ঈদে মদিনায় বসবাসরত হাবসিরা (আবিসিনিয়া বা বর্তমান ইথিওপিয়ার একাংশের অধিবাসী) লাঠিখেলার আয়োজন করতো এবং নবী (সা.)-এর স্ত্রী আয়েশার সেই লাঠিখেলা দেখার স্মৃতিও রয়েছে ইসলামের ইতিহাসে। নবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর আতর মাখা, সুন্দর ও পরিষ্কার পোশাক পরা এবং মিষ্টান্ন খাবারের উল্লেখ রয়েছে ঈদ উৎসবের একেবারে প্রথম দিকের দিনগুলোতে। উৎসবের আঙিনায় নতুন গল্প সৃষ্টি বা কবিতা লেখা ছিল হাজার হাজার বছর ধরে বাস করে আসা আরব অঞ্চলের মানুষের ঐতিহ্য।

মদিনার উৎসবের ধারাবাহিকতা পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন দেশে এসে সামান্য পরিবর্তিত হয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন এলাকার ঐতিহ্য বা লোকজ সংস্কৃতির কিছু কিছু উপাদান এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। খুব সাধারণ মানুষের ভেতর এই উৎসব জনপ্রিয় হওয়ার পর প্রতিবছর পালনের আগ্রহ বেড়েছে।

আমরা এখন যেভাবে ঈদ পালন করি সেই অভ্যাস ক্রমশ গড়ে উঠেছে ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর থেকে। মুঘল আমলের আগে ঈদ পালনের ঐতিহ্য তেমনভাবে ইতিহাসে পাওয়া যায় না। এছাড়া বহুদিন ধরে ঈদ পালনের উৎসব দেখা যেত শুধু শাসকদের মাঝে। বিশিষ্ট জনের লেখায় ব্রিটিশ শাসনামলে যতটা পূজা ও জন্মাষ্টমীর যে মিছিল বা আয়োজনের কথা রয়েছে সেখানে ঈদ পালনের কথা নেই বললেই চলে। তবে মহররমের মিছিল বা শোভাযাত্রার কথা আছে।

১৬৪০ সালে ঢাকার ধানমন্ডিতে ঈদগাহ তৈরি করেন বাংলার সুবেদার শাহ সুজার অমাত্য মীর আবুল কাশেম। এই ঈদগায় ঈদের নামাজ হতো যেখানে নায়েব-সুবেদার-জমিদার এবং অমাত্যরা অংশ নিতেন। সাধারণ মানুষের সেখানে প্রবেশাধিকার ছিল না। আজও এই ঈদগার অংশবিশেষ রয়েছে ধানমন্ডিতে। ১৮৯০ থেকে ১৯৪০-এ ঈদের কিছু কিছু রেওয়াজ ঢাকার নবাবদের আয়োজনে দেখতে থাকে ঢাকাবাসী। হাতি ঘোড়া উটের সমাহার, রংবেরংয়ের পতাকা, কাড়া নাকাড়া তথা ব্যান্ড পার্টির বাজনাবাদ্যি, রাস্তার দুইধারের মানুষকে টাকা বিলানো এবং পায়েস-জর্দা ও ফিন্নি খাওয়ানো ছিল আয়োজনের অংশ। এসব সাধারণের চোখে চোখধাঁধানো উৎসব ছিল, যেখানে সাধারণের অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল না। মোগলরা ভারতীয় মুসলিম ছিলেন না, আবার ঢাকার নবাবরা নিজেদের নবাবই মনে করতেন। সাধারণ মানুষেরা ঈদ উৎসবকে ক্রমশ আপন মনে করেছিল শাহজালাল, শাহজামাল, শাহ মখদুম, শাহপরান, খান জাহান আলীদের ধর্ম প্রচারের সময়ে। সুফি মুসলিমদের ধর্ম প্রচার বা ঈদগাহ নির্মাণের সময়গুলোতে সুফিদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের যোগ ছিল, শাসক শ্রেণির সঙ্গে কোনও যোগ ছিল না।

সাধারণ মানুষের যোগ না থাকলে উৎসব কখনও উৎসব হয়ে ওঠে না। ঈদে এখন আধুনিকতা যোগ হয়েছে। হতে পারে সেটা মেলার আধুনিকায়ন, আতশবাজির মহড়া কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাহারি ঈদ মোবারকের ডিজাইন প্রকাশ। আগে রঙিন কাগজে ঈদ মোবারক লিখে সেটা বাড়ির দেয়ালে টানানো হতো। আগে তেমনভাবে ঈদ পুনর্মিলনী হতো না, এখন ঈদ পুনর্মিলনী হয়, সঙ্গে থাকে ডিজে বা কনসার্টের ব্যবস্থা। আগে মুড়ি মুড়কি ফিন্নি পায়েস পোলাও মাংস খাওয়া যেত আত্মীয় বা প্রতিবেশীর বাড়িতে। এখন ঈদে পিৎজা বা বড় কোনও রেস্টুরেন্টে খেতে যায় কেউ কেউ। সালামির টাকা দিয়ে বিদেশ ভ্রমণও চলে!

তবু খুব সাধারণ মানুষের জন্য ঈদের আনন্দ থাকুক চিরকালীন ঐতিহ্যের ধারক হয়ে।

লেখক: রম্যলেখক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দুর্নীতির অভিযোগে ইসলামপুর পৌর মেয়র বরখাস্ত
দুর্নীতির অভিযোগে ইসলামপুর পৌর মেয়র বরখাস্ত
মাটি কাটার সময় ‘গরমে অসুস্থ হয়ে’ নারী শ্রমিকের মৃত্যু
মাটি কাটার সময় ‘গরমে অসুস্থ হয়ে’ নারী শ্রমিকের মৃত্যু
সাকিবের সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সাক্ষাৎ
সাকিবের সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সাক্ষাৎ
স্বর্ণপামে ৯ বিচারক: সর্বকনিষ্ঠ আদিবাসী লিলি, আছেন বন্ডকন্যাও
কান উৎসব ২০২৪স্বর্ণপামে ৯ বিচারক: সর্বকনিষ্ঠ আদিবাসী লিলি, আছেন বন্ডকন্যাও
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ