X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষার্থীদের মানসিক কষ্ট ও আত্মহত্যা:  ‘আমরা’ কি হাত বাড়িয়ে দিতে পারি?

ড. রাশেদা রওনক খান
২১ মে ২০২৩, ০৯:৩৯আপডেট : ২১ মে ২০২৩, ০৯:৩৯

বুয়েটের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রাফি গত বুধবার রাতে তার বাসায় আত্মহত্যা করেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। সেদিনই রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র  তানভীর আহমেদও তার হলের নিজ কক্ষে আত্মহত্যা করেছেন। ইদানিং শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০২২ সালে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ৫৩২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। কিছুদিন আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের ছাত্র সিয়াম ছাত্রাবাসে তার রুমেই আত্মহত্যা করেন, তার সুইসাইডাল পোস্ট বেশ আলোড়ন তোলে শহরজুড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্র হাফিজ ডাব বিক্রেতার ব্যবহৃত দা দিয়ে ‘আত্মহত্যা’ করেন, মনে আছে নিশ্চয়ই সবার।  বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের এভাবে আত্মহত্যার ঘটনার পেছনের কারণ গুলো কী, কেন মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়, সেসব নিয়ে নানা তাত্ত্বিক আলোচনা হতে পারে।

এমিল ডুর্খেইম সামাজিক সংহতি এবং সামাজিক সচেতনতার সঙ্গে আত্মহত্যা সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করেছেন।  তিনি বলেন, ‘যারা সমাজের সঙ্গে অতিমাত্রায় সম্পৃক্ত তারা যেমন আত্মহত্যা করতে পারে, তেমনই  যারা সমাজ থেকে অতিমাত্রায় বিচ্ছিন্ন তারাও করে। নিজের একান্তই ব্যক্তিগত, সমাজ, রাজনীতি ও পারিপার্শ্বিক নানা কারণেই হয়তো তাদের এই আত্মহননের পথ বেছে নেওয়া। ব্যক্তিগত কারণে কিংবা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নানাবিধ সমস্যা নিয়েই হয়তো মূল সমস্যাটা শুরু হয়, কিন্তু এসব সমস্যা তো ছিল, আছে এবং থাকবে। পরিবার কেবল একটি প্রতিষ্ঠান, তাই তা কোনও কোনও ক্ষেত্রে ভেঙে যেতেই পারে,  সমাজ ও রাষ্ট্র সবার সমস্যার সমাধান নাও দিতে পারে। তাই বলে আত্মহত্যাই কি এসব সমস্যা থেকে মুক্তির পথ হতে পারে? যারা আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছেন, কেন করছে সেই নিয়ে ডুর্খেইমের পর আরও অনেকেই গবেষণা করেছেন। আত্মহত্যার পেছনে কারণ আছে—  হতে পারে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় মানসিক রোগ, সিজোফ্রেনিয়া-সহ নানারকম উপসর্গ থাকতে পারে।  তবে আমি আজ  সেই দিকে আলোচনা করবো না, বরং আলাপ করতে চাই— আমরা আশেপাশের মানুষ,  এই ‘আমরা’ আত্মহননের পথ বেছে নেওয়া মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াতে পারি না কেন? কোথায় ‘আমাদের’ ব্যর্থতা।

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ক্লাস রুমের বাইরের আলাপ থেকে এটুকু ধারণা স্পষ্টতই পাই যে, অনেক কারণের মাঝে একটা বড় কারণ— শিক্ষার্থীদের অনেকেই ‘ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশ’। আচ্ছা, তাদের ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশাগ্রস্ত হবার কারণগুলো কী— কখনও কি জানতে চেয়েছি আমরা, তাদের  শিক্ষক কিংবা পরিবারের সদস্যরা? কেন অনেক স্বপ্ন নিয়ে তীব্র প্রতিযোগিতায় নিজেকে টেনে এনে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোতে এসে অসীম সম্ভাবনার সামনে দাঁড়িয়েও শেষ পর্যন্ত একজন শিক্ষার্থী এতটাই হতাশ হয়ে যাচ্ছে যে, আত্মহননের পথ বেছে নেয়?

আমরা কি খেয়াল করেছি, কেন কীভাবে কখন ছেলেমেয়েদের ভেতরে ক্যরিয়ার নিয়ে ভয়ংকর এক প্রতিযোগিতার বীজ বপন করে দিচ্ছি?  কেন তাদের শেখাচ্ছি যে, আমাদের সবচেয়ে উঁচু সিঁড়িতেই পৌঁছাতেই হবে? এই উঁচু-নিচুর সংজ্ঞা কি কেবল টাকার পরিমাণ, আর স্ট্যাটাসের সঙ্গে যুক্ততা নয়?   পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র আমাদের জীবন উপভোগ করতে শিখায়নি, শিখিয়েছে কেবল এই টাকা ও স্ট্যাটাস তৈরির প্রতিযোগিতায় দৌড়াতে। গাড়ি-বাড়ি ছাড়াও যে জীবন সুন্দর হতে পারে, কেউ কি আমরা তাদের শিখিয়েছি? সেই স্কুলে ভর্তির পর হতে যে ফরেস্ট গাম্পের নায়কের মতো সাদা কেডস পরে দৌড়াচ্ছি, সেই দৌড় চলে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত! কী চরম বিভ্রান্তিতে আমরা আমাদের স্বল্পায়ু, অথচ অমূল্য  এই জীবন কাটিয়ে পরপারে যাচ্ছি চলে। এই একজীবনের দৌড়ে আমরা কখনও জীবনের গভীরতা নিয়ে ভাবি না, বুক ভরে বাতাসের অস্তিত্ব অনুভব করি না, নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে মেঘের রঙ কিংবা গতিপথকে অবাক বিস্ময় নিয়ে দেখি না। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কেবল দৌড়ে যাচ্ছি— অর্থ-বিত্ত আর স্ট্যাটাস নামক এক মরীচিকার পেছনে।

এই দৌড়ের মাঝে প্রকৃতিকে যেমন দেখার সময় মিলে না, তেমনই দেখি না আশেপাশের মানুষজনকেও। আমাদের পাশের মানুষটি আমার চেয়ে কতটা দুঃখ নিয়ে একটি জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে, তা দেখার মতো আমাদের চোখ তৈরি করে না শিক্ষা ব্যবস্থা ও পারিবারিক শিক্ষা। ফলে, আমরা না বুঝি অন্যের দুঃখ, না হতে পারি মানবিক, না নিজের অবস্থান নিয়ে তৈরি হয় সন্তুষ্টি। সব সময় এক তীব্র প্রতিযোগিতায় দৌড়ে যাওয়া জীবনে বরং আশেপাশের  এই মানুষজনকেই বেছে নেই প্রতিযোগী হিসেবে। কী হাস্যকর আমাদের ভাবনা, আর আমাদের বেড়ে ওঠার সংস্কৃতি! আর দৌড়াতে দৌড়াতে ক্লান্ত মানুষ এই প্রতিযোগিতায় হেরে যাচ্ছে ভেবে— অনেকেই জীবনের চলার পথকে থামিয়ে দিতে চায়, নিজেকে ব্যর্থ মানুষ ভেবে।

ছোটবেলা থেকে আমাদের পাশ-ফেইল, সফল- বিফল, ধনী-গরিব, কমফোর্টেবল লাইফ খুঁজে নেবার নেশা ধরিয়ে দেওয়া সমাজ— আমাদের মনোজগতকে এতটাই সংকীর্ণ করে দিয়েছে যে, এর বাইরে যে জীবন উপভোগের, নিজস্বতায় ভরা, ‘আমার জীবন, আমার ইচ্ছায়’ তা আমরা যাপনই করতে শিখিনি! ফলে অল্পতেই ভেঙে পড়ি, নিজেকে হতাশায় ডুবিয়ে দেই, আত্মবিশ্বাসটাই নষ্ট হয়ে যায়। সমাজের পিয়ার প্রেশারের কাছে হার মেনে ফেলেন অনেকেই।  ফলে আমাদের বাঙালি ব্যক্তিত্বে না থাকে আত্মবিশ্বাস, না থাকে অন্যকে জায়গা করে দেবার প্রবণতা। কীভাবে অন্যকে ফেলে কিংবা ডিঙিয়ে লক্ষ্যস্থলে পৌঁছাবো, সেই চিন্তায় জীবন নামক রাস্তায় দৌড়াতে দৌড়াতে একদিন যখন বুঝি, এই রাস্তার আসলে নাই কোনও শেষ, ততদিনে জীবন উপভোগেরও সময় শেষ হয়ে যায়, নিজেকেই বিদায় নিতে হয় পৃথিবী থেকে। কী বাজে ছকে বেঁধেছি আমাদের এই জীবন!

ইদানিং যেটা শুনতে পাচ্ছি, তীব্র প্রতিযোগিতার এই যুগে পরীক্ষার নম্বর কিংবা রেজাল্ট নিয়ে মানসিক চাপে ভুগে অনেক শিক্ষার্থী আত্মহননের পথ বেছে নেয়। আমি ক্লাসে প্রায়ই বলি, নম্বর, পরীক্ষা— এইসব আসলে জীবনের গভীরতার কাছে কচুরিপানার চেয়েও তুচ্ছ ভাসমান এক বিষয়, এসব নিয়ে এতটা গভীর সংকটে যাবার কোনও মানেই হয় না। পরীক্ষার নম্বর, ক্লাস টেস্ট— এসব নিয়ে সরাসরি শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলতে হবে, জিজ্ঞাসা করে জানতে হবে| আমাদের কোথায় যেন পারস্পরিক  যোগাযোগের জায়গাটা ক্রমশ সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সুন্দর সম্পর্কটিকে আবারও ফিরিয়ে আনতে হবে। দুই পক্ষকেই এগিয়ে আসতে হবে এই সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে। ক্লাসের প্রথম দিনই আমি বলে দেই— যেকোনও রকমের সংকটে যেন আমার সঙ্গে এসে কথা বলে তারা, তা সে পরীক্ষায় কম নম্বর পাওয়া নিয়ে হতাশা হোক, কিংবা অর্থনৈতিক সংকট বা ব্যক্তিগত কোনও কষ্ট, অথবা কোনও সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণেই হোক।

চরম পুঁজিবাদী উত্তর আধুনিক এই সমাজে পরিবারের সদস্যদেরও মোবাইল ফোনসহ নানা কারণেই পরস্পরের মাঝে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। পরিবারে একসঙ্গে এক ছাদে বেড়ে উঠলেই যে একজন মানুষ পারিবারিক মানুষ তা কিন্তু নয়, হয়তো আমাদের অগোচরেই সে তার এক নিজস্ব জগৎ গড়ে তুলেছে, যেখানে সে শূন্যতাকে খুঁজে, কষ্টকে লালন করে, শূন্যতাকে উপভোগ করে!  সেই শূন্যতা ধীরে ধীরে তাকে গ্রাস করে, সেখানে অন্য যেকোনও কিছু তুচ্ছ মনে হয়। কিন্তু আমরা পরিবারের লোকজন ভাবছি— সে কখন বিসিএস দেবে, অফিসার হবে, শিক্ষক হবে, চাকরি পাবে, বিয়ে করবে, সন্তান হবে, সমাজের বেঁধে দেওয়া আপনার-আমার এই সামাজিক-পারিবারিক অঙ্কের সঙ্গেও হয়তো কোনোদিন সূত্র মেলাতেই চায়নি, চেয়েছে অন্য কিছু, যা আপনি আমি আমরা পরিবারের মানুষজন কোনোদিন অনুধাবনই করিনি, কিংবা করতে চাইওনি, কেবল মাত্র আমাদের অন্যকে বুঝার কিংবা অন্যের কষ্টকে অনুভব করার শিক্ষা পাইনি বলে!

মানুষ আসলে মানুষের জন্যই, প্রতিযোগিতার জন্য নয়। মনে রাখা দরকার যে, পড়া লেখা, প্রতিযোগিতা, নম্বর, পরীক্ষা— এসবের বাইরেও অনেক সুন্দর এক জগত আছে, সেই জগতকে উপভোগ করতে হবে, মানুষকে ভালোবাসা। আমি ছাত্রদের প্রায়শই বলি, বন্ধু বা ক্লাসমেটদের জন্মদিনে থাকতে না পারলে, উপহার দিতে না পারলে দোষ নেই, কিন্তু চেষ্টা করো তাদের কষ্টের সময়ে প্রচণ্ডভাবে কাছে থাকার, তার মাঝেই আমাদের জীবনের আসল সার্থকতা লুকিয়ে থাকে। আনন্দের দিনে সঙ্গে থাকার মানুষের অভাব হয় না, কিন্তু দুর্দিনে পাশে থাকে কেবল মানবিক মানুষ। সেই মানবিক মানুষ হয়ে ওঠাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ|

হয়তো আমাদের সেই পাশে থাকাটাই একজন মানুষকে নতুন করে উঠে দাঁড়াতে উৎসাহ জোগাবে। আমরা মানুষের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে শিখেছি, শিখিনি কীভাবে মানুষের দুর্দিনে নিজের সময়, আবেগ ও ভালোবাসা দিয়ে তাকে আবার উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করতে হয়। আমাদের সময়ের অভাব, তাই  এসব কাজকে সময়ের অপচয় ভাবি। সেখানেই বুঝি ‘আমাদের’ আত্মার মৃত্যু ঘটে, আর এই মৃত্যু, আত্মহত্যা-প্রবণ দুর্বল চিত্তের মানুষের মৃত্যু ভাবনাকে আরও ত্বরান্বিত করে। তাই আশে-পাশের সব ‘আমরা’ যদি তাদের প্রতি ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দেই, তাহলেই হয়তো এই আত্মহত্যার প্রবণতা কমে আসবে।  জয়ী হোক ‘আমাদের’ মানবিক দিক, আর হেরে যাক দুর্বল চিত্তের মানুষগুলোর আত্মহত্যার প্রবণতা।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

/এপিএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ