X
শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪
১৯ বৈশাখ ১৪৩১

সরকারের পথে দুই কাঁটা: মূল্যস্ফীতি আর বিদ্যুৎ

প্রভাষ আমিন
১০ জুন ২০২৩, ১৩:৩৮আপডেট : ১০ জুন ২০২৩, ১৩:৪৩

টানা তৃতীয় মেয়াদের শেষ প্রান্তে আছে বর্তমান সরকার। টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা সরকারের দৃঢ় নীতি এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কারণে অর্থনীতিতেও এক ধরনের স্থিতিশীলতা এসেছে। গত ১৪ বছরে সরকারের অর্জনের তালিকা অনেক লম্বা। নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, টানেল, এক্সপ্রেসওয়ে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, সাবমেরিন, স্যাটেলাইট- দৃশ্যমান উন্নয়নের তালিকাও অনেক লম্বা। তবে এসব উন্নয়নের চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মানি ভেতর থেকে বদলে যাওয়া অর্থনীতিকে। মাথাপিছু আয় বেড়েছে, জিডিপি বেড়েছে, প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। বাংলাদেশে আগেই স্বপ্লোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন করেছে। অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে বাংলাদেশের মর্যাদাও।

তবে এই ১৪ বছরের সরকারের ব্যর্থতার তালিকাও কম লম্বা নয়। আর আমার বিবেচনায় ব্যর্থতার বড় অংশই অর্থনীতিতে। আর্থিক খাতে, বিশেষ করে ব্যাংক ও শেয়ার বাজারে সুশাসনের ঘাটতি সরকারের একটা বড় দুর্বলতা। আর এই সুশাসনের ঘাটতির কারণেই আমরা বিভিন্ন সময়ে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অনিয়মের খবর শুনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে এখন খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকা। অবশ্য সব ছাড় বাদ দিলে এবং কার্পেটের নিচে লুকিয়ে রাখা হিসাব যোগ করলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ চার লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে কারও কারও ধারণা। টাকা পাচারেও এই কয়েক বছরে আমরা দারুণ সাফল্য দেখিয়েছি। কানাডার বেগমপাড়ায় বাড়ি কেনার ক্ষেত্রে ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ আর আমলাদের মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলে। মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, দুবাইতেও বাংলাদেশি ধনকুবেরদের জয়জয়কার।

শেয়ার বাজারে অস্থিতিশীলতা আর সুশাসনের অভাব। ১৪ বছরের এই সাফল্য-ব্যর্থতার পুরোটাই সরকার করতে পেরেছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কারণে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কারণে তো সাফল্য এসেছে, ব্যর্থতার সঙ্গে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কী সম্পর্ক? আসলে সংসদে বা রাজপথে প্রবল বিরোধিতা ছিল না বলেই সরকার একের পর এক আর্থিক অনিয়ম দেখেও না দেখার ভান করতে পেরেছে।

তবে তৃতীয় মেয়াদের শেষ প্রান্তে এসে সরকার সত্যিকারের বিপাকে পড়েছে। যে সাফল্য-ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তাতে দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতিতে পড়লেও সাধারণ মানুষ সরাসরি তার সুফল-কুফল কোনোটাই ভোগ করে না। যেমন ধরুন সাবমেরিন বা স্যাটেলাইটে আমাদের মর্যাদা বেড়েছে বটে, তবে সাধারণ মানুষের তাতে তেমন কিছুই যায় আসে না। এমনকি এত গর্বের পদ্মা সেতুর কারণেও সাধারণ মানুষের পকেটে নগদ কোনও সুবিধা যুক্ত হবে না। আবার বিপুল খেলাপি ঋণ বা টাকা পাচারেও সাধারণ মানুষের কিছু যায় আসে না। সরকারের টাকা, ঘুরে ফিরে সেটা জনগণের টাকাও বটে। তবে খেলাপি ঋণ বা পাচার করা অর্থের কোনোটাই সরাসরি কোনও ব্যক্তির পকেট থেকে যায়নি। তাই আমরা সমালোচনা করলেও আমাদের গায়ে তার উত্তাপ লাগে না।

সাধারণ মানুষের গায়ে সরাসরি উত্তাপ লাগে দুটি জিনিসের, বিদ্যুৎ আর বাজার দর। এই দুই খাতেই সরকার এমন এক বিপাকে পড়েছে, যা থেকে উদ্ধার পাওয়ার শর্টকাট কোনও উপায় নেই। নির্বাচনের মাত্র ৬-৭ মাস বাকি থাকতে এমন গ্যাঁড়াকল সরকারের জন্য হতাশার। রেসের শেষ প্রান্তে এসে এমন হোঁচট খাওয়া যে কারও জন্যই দুঃখজনক। বাজার দর আর বিদ্যুতে ম্লান হতে বসেছে সরকারের বড় বড় অনেক অর্জন।

প্রথমে আসি বিদ্যুতের কথায়। বিএনপি-জামায়াত শাসনামলের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা ছিল বিদ্যুৎ। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে সেই ব্যর্থতাকেই তাদের মুকুট বানানোর উদ্যোগ নেয়। সর্বোচ্চ প্রায়োরিটি দিয়ে ৫ হাজার মেগাওয়াট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা তুলে আনে ২৫ হাজার মেগাওয়াটে। ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয় বিদ্যুৎ। শতভাগ বিদ্যুতায়নের উৎসবও হয় জমকালো। এখনও বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা আছে, ঘরে ঘরে বিদ্যুতের সংযোগও আছে। সমস্যা হলো বিদ্যুৎ নেই। বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা কমে গেছে, তা কিন্তু নয়। আসলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি কেনার টাকা নেই সরকারের কাছে। টাকার অভাবে ডিজেল, ফার্নেস অয়েল আর এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন কমানো হয়েছিল আগেই। কয়লার অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রও। বিদ্যুতের সংকট যখন চরমে, তখন প্রকৃতিও আমাদের বিরুদ্ধে। রেকর্ড তাপমাত্রায় বিদ্যুৎবিহীন সময় হয়ে উঠছে অসহনীয়। সরকার এখন তাকিয়ে আছে প্রকৃতির দিকে। বৃষ্টি এলে, তাপমাত্রা কমলে বিদ্যুতের চাহিদাও কিছুটা কমে আসবে। তবে নির্বাচনের আগে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি আবার আগের জায়গায় নিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। আর মানুষ শেষটাই মনে রাখবে। তাই যে বিদ্যুৎ আওয়ামী লীগ সরকারের সাফল্যের মুকুটে সবচেয়ে বড় পালক হতে পারতো, সেটাই সবচেয়ে বড় কাঁটা হয়ে যেতে পারে।

তবে বিদ্যুতের চেয়েও বড় কাঁটা হতে পারে বাজার দর। করোনার সময় বিশ্ব অর্থনীতির মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও প্রবল চাপে পড়ে। তবে বাংলাদেশ সাহসিকতার সঙ্গে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করে। কিন্তু করোনা পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতি আবার টালমাটাল অবস্থায় পড়ে। বাংলাদেশও বিশ্বের বাইরে নয়। তাই সেই প্রবল ঢেউ বাংলাদেশকেও গ্রাস করে নেয়। ডলারের দাম হু হু করে বাড়তে থাকে, কমতে থাকে রিজার্ভ। এই অবস্থায় বাড়তে থাকে মূল্যস্ফীতি। বাড়তে বাড়তে মূল্যস্ফীতি এখন ১০ ছুঁই ছুঁই, সঠিক হলো ৯ দশমিক ৯৪।

গত ১১ বছরের মধ্যে এটা সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি। বাংলাদেশের অর্থনীতির এখন সবচেয়ে বড় সংকট এই মূল্যস্ফীতি। গত ১ জুন অর্থমন্ত্রী সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেন। বাজেট পরবর্তী সব আলোচনায় মূল্যস্ফীতি মোকাবিলার চ্যালেঞ্জটাই সবচেয়ে বড় হয়ে এসেছে। আর এই বাজেট পেশের পরই মূল্যস্ফীতি ১১ বছরের রেকর্ড ভাঙার খবর আসে। যদিও বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬-এর ঘরে নামিয়ে আনার উচ্চাভিলাষী স্বপ্নের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সেই স্বপ্নপূরণের কোনও রোডম্যাপ নেই। পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানও স্বীকার করেছেন, মূল্যস্ফীতি ৬-এ নামিয়ে আনা সম্ভব নয়। মূল্যস্ফীতির প্রভাবে বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে হু হু করে। সীমিত আয়ের মানুষের জীবন এখন দুর্বিষহ। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত আর মধ্যবিত্তের জীবন এখন টানাটানিতে জেরবার।

প্রধানমন্ত্রী নিজেও জানেন সমস্যাটা। একাধিক অনুষ্ঠানে তিনি মূল্যস্ফীতির চাপ ও বিদ্যুৎ পরিস্থিতির জন্য মানুষের কষ্টের কথা স্বীকার করে সহানুভূতি নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও বিদ্যুৎ পরিস্থিতি উন্নয়নে সর্বোচ্চ চেষ্টার নির্দেশনা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর চেষ্টা ও আন্তরিকতার কোনও ঘাটতি নেই। কিন্তু যুদ্ধের প্রভাব ও আন্তর্জাতিক অর্থনীতির লাগাম তার হাতে নেই। আর বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতির বেশিরভাগই আমদানি করা। তবু ১৪ বছরের সাফল্যের ফসল ঘরে তুলতে হলে চলার পথ থেকে শেষ সময়ের এই দুই কাঁটা- মূল্যস্ফীতি আর বিদ্যুৎ দূর করতেই হবে। সামনের পথ বড় বন্ধুর আর কণ্টকাকীর্ণ।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
অপহৃত ১০ বাংলাদেশিকে ফেরত দিয়েছে আরাকান আর্মি
অপহৃত ১০ বাংলাদেশিকে ফেরত দিয়েছে আরাকান আর্মি
ধানমন্ডিতে ছাদ থেকে পড়ে গৃহকর্মী আহত 
ধানমন্ডিতে ছাদ থেকে পড়ে গৃহকর্মী আহত 
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে সকার স্কুলের বাছাইয়ে ৩ বাংলাদেশি কিশোর
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে সকার স্কুলের বাছাইয়ে ৩ বাংলাদেশি কিশোর
দীর্ঘ অপেক্ষার পর ঢাকায় স্বস্তির বৃষ্টি, কমলো তাপমাত্রা
দীর্ঘ অপেক্ষার পর ঢাকায় স্বস্তির বৃষ্টি, কমলো তাপমাত্রা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ